অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বহুতল আবাসন প্রকল্পটি কক্সবাজারের খুরুশকুলে নির্মিত হচ্ছে, বলেন শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2022, 01:32 PM
Updated : 11 Dec 2022, 01:32 PM

জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, “আমাদের এনএপি বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য বাংলাদেশ যাতে সমান সমান অর্থ বরাদ্দ করতে পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।”

রোববার সরকার প্রধান গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে যুক্ত হয়ে ‘গ্লোবাল হাব অন লোকালি লেড অ্যাডাপটেশন’ খোলার ঘোষণা দিয়ে এ কথা বলেন।

বাংলাদেশ সরকার এখন জিডিপির ৬/৭ শতাংশ জলবায়ু অভিযোজনে ব্যয় করে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “২০২৩-২০৫০ সালের জন্য সম্প্রতি ন্যাপ চালু করেছে বাংলাদেশ। কপ ১৫-এর পর বাংলাদেশ তার নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ২০০৯ সালে একটি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে।

“এই তহবিলটি জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমন- উভয় ক্ষেত্রেই এ পর্যন্ত ৮০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “ন্যাপ আমাদের বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার আওতায় যে কাজ হচ্ছে তার পরিপূরক হবে। আমি প্যারিস চুক্তির চেতনায় এই প্রচেষ্টায় আমাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি খাতকে থেকে আমাদের অংশীদারদের আমন্ত্রণ জানাই।”

একইসঙ্গে কার্বন নির্গমনকারী প্রধান দেশগুলোকে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের সুযোগ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের সকলকে অবশ্যই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য আমাদের প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করতে হবে।

“বাংলাদেশ সরকার আজ চালু হওয়া স্থানীয় নেতৃত্বাধীন অভিযোজন বিষয়ে গ্লোবাল হাবকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেবে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরেকটি অফার পেয়ে আমরা আনন্দিত।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে বসবাস করে আসছে এবং বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য বিপদের বিরুদ্ধে এক ধরনের স্থিতিস্থাপকতা অর্জন করেছে।

“তারা প্রকৃতির পরিবর্তনশীল গতিপথের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে একটি জলবায়ু অভিযোজন কেন্দ্রে পরিণত করেছে।”

বাংলাদেশের মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে যে সংগ্রাম করে, তার উপর বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি ১৯৭০ সালে ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ের পর মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেখানে ভয়াবহ দুর্যোগে লক্ষাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল।

“তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় জনগণকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি তাদের অবহেলার প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি নিজেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সহায়তায় কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছেন।”

সরকার প্রধান বলেন, “স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু উপকূলীয় অঞ্চলকে ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন শুরু করেছিলেন, যা স্থানীয়ভাবে ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিত।

“তিনি গাছ লাগানোর পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিও (সিপিপি) চালু করেছিলেন। সিপিপি এখন ৭৬ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠিত। আমরা এখনও জলবায়ু কর্মের পরিকল্পনা করার জন্য তার (বঙ্গবন্ধু) নির্দেশনা অনুসরণ করছি।”

বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহ্যগত জ্ঞান এবং জলবায়ু অভিযোজন সমাধানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের সরকার সম্পদ ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সেই সমাধানগুলোকে সমর্থন করে। এই সংমিশ্রণটি স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন ব্যবস্থাগুলোর একটি পুল তৈরিতে কাজ করেছে।”

মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সারাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এগুলো সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে কাজ করে।”

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতি বর্ষায় লক্ষাধিক চারা রোপণ করে উল্লেখ করে দলটির সভাপতি বলেন, “বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করা হচ্ছে। মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা ১০০টি ‘মুজিব কিল্লা’ স্থাপন করেছি।”

আধুনিক প্রযুক্তি গভীর সমুদ্রসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবহাওয়ার সতর্কবার্তা পৌঁছাতে সাহায্য করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে এখন দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ লবণাক্ত, খরা ও বন্যা-সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে। ভাসমান কৃষি এখন সবজি উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে।

“কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। আমরা খাদ্য উৎপাদন ও তাপ কমানোর জন্য ছাদে চাষাবাদকে উৎসাহিত করছি।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় নদী ড্রেজিং, উপকূলে সৌরবিদ্যুৎতের ব্যবস্থা, গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য প্রায় ১০ লাখ দুর্যোগ-সহনশীল বাড়ি নির্মাণের কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বহুতল আবাসন প্রকল্পটি কক্সবাজারের খুরুশকুলে নির্মিত হচ্ছে। সেখানে ১৩৯টি বহুতল ভবনে ৫ হাজার জলবায়ু-শরণার্থী পরিবারকে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন জিসিএ চেয়ারম্যান সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, জিসিএ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. প্যাট্রিক ভারকুইজেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন।