বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাইবার নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
Published : 19 Mar 2025, 12:09 AM
দেশে-বিদেশে কিছু গোষ্ঠীর বাংলাদেশ বিরোধী ‘মিথ্যা ও অপতথ্য’ ছড়ানোর কথা তুলে ধরে তা মোকাবেলায় ‘প্রকৃত চিত্র’ ধরার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর গ্যারি সি পিটারসকে আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সৌজন্য সাক্ষাতের সময় মিশিগান থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেট সেনেটর গ্যারি পিটারসের প্রতি তিনি এই আহ্বান জানান।
বৈঠকের পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আলোচনার বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, “পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, কিছু গোষ্ঠী দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশ বিষয়ে মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়াচ্ছে।
“এগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্রের উপর আলোকপাত করতে সেনেটরকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সেনেটর বিষয়টি নজরে নিয়েছেন।”
গ্যারি পিটারস এমন এক সময়ে বাংলাদেশ সফর করছেন, যখন ভারত সফর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের কিছু মন্তব্য ঘিরে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
সোমবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, “হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিনের দুভার্গ্যজনক নির্যাতন, হত্যা ও নিপীড়নের ঘটনা মার্কিন সরকার এবং ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের একটা বড় উদ্বেগের জায়গা।”
এনডিটিভির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ নিয়ে কথোপকথনের সময় ‘ইসলামি খিলাফত’ প্রসঙ্গও ওঠে।
এ বিষয়ে তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, “চরম ইসলামপন্থিদের হুমকি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক যে প্রচেষ্টা, তাদের সবার শিকড় একই আদর্শ ও উদ্দেশ্যে মিশেছে। তাদের সে উদ্দেশ্য হল ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা।
“এটা স্পষ্ট, তাদের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য ধর্ম’ ছাড়া অবধারিতভাবে বাকি সব ধর্মের অনুসারীদের তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। আর খিলাফতের মত মতবাদ তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায় সন্ত্রাস ও সহিংসতার মাধ্যমে।”
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক গ্যাবার্ডের এসব মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ‘গভীর উদ্বেগ ও হতাশা’ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বলেছে, ওই মন্তব্য ‘তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তিতে করা হয়নি’।
সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বলেছে, মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের এমন মন্তব্যের পেছনে কোনো তথ্যপ্রমাণ কিংবা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। তার এক বক্তব্য এক তুলিতে পুরো জাতিকে অযৌক্তিকভাবে চিত্রিত করেছে।
“বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশও চরমপন্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। কিন্তু আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবিরোধী অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশকে ‘ইসলামি খিলাফত ধারণার’ সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানানোর কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলেছিল, “রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত, তাদের মন্তব্য প্রমাণ ও বাস্তব জ্ঞানের ভিত্তিতে করা, যাতে ভুল ধারণা এবং ভীতি সৃষ্টি না হয় এবং সম্প্রদায়গত উত্তেজনা না বাড়ে।”
তার পরেরদিন পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে এ বৈঠকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগ, সাইবার নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগ এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয় সেনেটর পিটারসকে অবহিত করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
“চলমান উদ্যোগগুলোকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সেনেটর পিটারস এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পালাবদলের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।”
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, তা গ্যারি পিটারসের কাছে তুলে ধরেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। বাস্তুচ্যুত এই জনগোষ্ঠীর মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই বছর নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের অংশীদার হয়ে সহযোগিতাও চেয়েছেন তৌহিদ হোসেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিজের মিশিগান রাজ্যে এবং সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানের কথা স্মরণ করেছেন সেনেটর পিটারস। অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতা গভীর করার উপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অংশীদারত্ব এগিয়ে নেওয়া এবং সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনের প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে বৈঠক শেষ হওয়ার কথা বলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের এই সেনেটরের সম্মানে ইফতার ও নৈশভোজের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের নির্বাচন, মানবাধিকার, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বিভিন্ন সময় সরব হতে দেখা গেছে মিশিগানের ডেমোক্রেট সেনেটর গ্যারি পিটারসকে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর সংখ্যালঘু নির্যাতনের মধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর তিনি বলেছেন, “আমি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে আছি, যারা এখন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছে। রাজনৈতিক সহিংসতা কখনো কাম্য নয়। ওই অঞ্চলে শান্তির জন্য আমাদেরকে অবশ্যই প্রচেষ্টা চালাতে হবে।”
এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে সেনেটের আর্মড সার্ভিসেস কমিটির শুনানিতে ফেইসবুকে গুজব ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ নিয়ে জোরালো বক্তব্য দেন তিনি।
ওই সময় গ্যারি পিটারস বলেছিলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য বাস্তব জীবনে সহিংসতার ঘটনা ঘটাতে পারে এবং তার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর উদ্বেগজনক হামলার ঘটনা দেখেছি। আমি এ ধরনের হামলার নিন্দা জানাই।”
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই সেনেটর বলেছিলেন, “সাধারণ নির্বাাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সহিংসতার খবরে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশিরা ভয়ভীতি মুক্ত থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার অধিকার রাখেন।”