অবরোধকারীদের সামাল দিতে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমালোচনামুখর হয়েছে নগরবাসী। সামাজিক মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে।
Published : 02 Feb 2025, 10:36 PM
রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা হারুন অর রশীদ প্রতিদিনের মতো রোববার সকালে দুই নাতনীকে মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউয়ের স্কুলে দিয়ে আসেন। কিন্তু বেলা ১২টায় স্কুল ছুটির সময় তাদের আনতে গিয়ে পড়েন বিপাকে।
“সকালে দিয়া আসছি, রাস্তায় একটু জ্যাম ছিল। দুপুরে যহন যাইতে ধরলাম রিকশা-গাড়ি কিচ্ছু আগায় না। আমি তো বেশি হাঁটতেও পারি না। ৪৫ মিনিট পরে স্কুলে গিয়া দেখি ছোট নাতনিডা ভয়ে কান্না ধরছে,” এভাবেই ভোগান্তির কথা শোনান অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংক কর্মকর্তা।
হারুন অর রশীদের মতো রাজধানীর বহু মানুষ রোববার রাস্তায় একটি যন্ত্রণাময় দিন কাটিয়েছেন।
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে মহাখালী থেকে গুলশান ১ নম্বরমুখী রাস্তা অবরোধ করেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে শনিবার রাতেই শিশুমেলা থেকে আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত সড়কটি অবরোধ করেন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। রোববার সকালে তারা শিশুমেলা মোড়ে অবস্থান নিলে বন্ধ হয়ে যায় মিরপুর সড়ক। যার ফলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়ে স্কুল-কলেজ-অফিস-কর্মস্থলগামী মানুষেরা।
বিকালে সচিবালয় এলাকায় শিক্ষাভবনের মোড়ে পুলিশ ব্যরিকেড দিয়ে আটকে দেয় ইনকিলাব মঞ্চের একটি মিছিল। ফলে ওই সড়কটিও অফিস ছুটির সময় বন্ধ হয়ে যায়।
আন্দোলন-বিক্ষোভে ঢাকার তিন প্রান্তের প্রধান তিনটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় রীতিমত নাভিশ্বাস ওঠে মানুষের। সঙ্গে যোগ হয় টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত।
অবরোধকারীদের সামাল দিতে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমালোচনামুখর হয়েছে নগরবাসী। সামাজিক মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে।
পুলিশ কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “আমরা সবসময়ই বলে আসছি, যেকোনো আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে করা উচিৎ, জনগণের দুর্ভোগ যেন না হয়। এই চিন্তা মাথায় রেখেই যেন সবাই তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টা তুলে ধরে।”
ডিএমপির মুখপাত্র বলেন, “আমরা তাদের জনদুর্ভোগের কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছি।”
তবে ডিএমপির সেই চেষ্টাই যে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা করছে মানুষ।
তিতুমীরের আন্দোলনে দুর্ভোগে পুরো উত্তরে
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরসহ সাত দাবিতে আন্দোলনে নামা সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা রোববারও বেলা ১২টার থেকে মহাখালীতে কলেজের সামনের সড়কে বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকে অবস্থান নেন। এতে মহাখালী-গুলশান সড়কের দুইপাশেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তবে এদিন বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের কথা বিবেচনায় এনে পূর্ব ঘোষিত ‘বারাসাত বেরিকেড টু ঢাকা নর্থ সিটি’ কর্মসূচি শিথিল করেন আন্দোলনরতরা। এই কর্মসূচির আওতায় মহাখালীতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধের কথা ছিল তাদের।
দিনভর কলেজের সামনে থাকলেও সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে মহাখালী রেলগেটের দিকে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেন।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি তারেক মাহমুদ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বলেন, “পুলিশ মহাখালীর আমতলীতে রয়েছে। আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
সন্ধ্যায় দাঙা দমনের সাজে পুলিশ তিতুমীর শিক্ষার্থীদের মিছিলের আগে-পিছে থাকলেও তারা ছিল নিষ্ক্রিয়। আমতলীতে পুলিশের জলকামান, সাঁজোয়া যানও দেখা গেছে।
তিতুমীর শিক্ষার্থীদের কলেজের সড়ক অবরোধের কারণে ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়েন গুলশান-মহাখালীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। মূল সড়ক বন্ধ থাকায় দিনভর এই এলাকার অলিগলিতেও ছিল যানজট।
মহাখালী-গুলশানমুখী সড়কটি বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়ে বিমানবন্দর সড়কেও। দুপুরের দিকে ইজতেমার প্রথম আখেরি মোনাজাত শেষে শহরের দিকে আসতে থাকা জনস্রোতে অনেক রাস্তা একেবারে থমকে যায়।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপের গাড়ি চালক আশরাফ আলী বলেন, “সকালে একটা অফিসের ভাড়া নিয়া বারিধারা গেছিলাম। এরপরই আটকায় গেছি। সারাদিন খালি গ্যাসই পুড়াইলাম। টাকা পাইছি মোটে সাতশ’।”
তিতুমীর কলেজের অবরোধ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। জনগণের এতো তীব্র ভোগান্তির মধ্যেও পুলিশ কেন নিস্ক্রিয় ভূমিকায় এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। মানুষ বিভিন্ন সড়কের ‘আপডেট’ চেয়ে কিছুক্ষণ পরপর পোস্ট করেছেন বিভিন্ন ট্রাফিক গ্রুপে। এসব গ্রুপে পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ আর হতাশাও প্রকাশ করেছে মানুষ।
ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপে জারিফ মাহমুদ লিখেছেন, “দেশে কী পুলিশ নাই, সেনাবাহিনী নাই?”।
নাদিম জাওয়াদ আকিল লিখেছেন, “জনদুর্ভোগ ঠিক কী পরিমাণে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে তৎপর হবে? কিংবা, আদৌ হবে কি না?”
অচল মিরপুর সড়ক
উন্নত চিকিৎসার দাবি নিয়ে ফের আন্দোলনে নামা গণঅভ্যুত্থানে আহতরা রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর সড়কের শিশুমেলা মোড়ে অবস্থান নিলে উভয় দিকের পাশাপাশি শ্যামলী থেকে আগারগাঁও সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়কটিতে এই অবস্থা থাকে। সন্ধ্যায় আহতরা সড়ক ছেড়ে দিলে যান চলাচল শুরু হয়।
শ্যামলীর যানজটে নাজেহাল হয়ে সন্ধ্যা ৭টায় মৌসুমী নাজনীন ফেইসবুকে লিখেছেন, “স্কুল থেকে বাচ্চা আনতে পারি নাই। বোনের বাসায় রেখেছি। রাতেও কী মানুষ বাসায় ফিরবে না? আর কত?”
ক্ষোভ ঝেড়ে আন্দোলনকারী মোহাম্মদ শরীফ বলেন, “রাস্তা অবরোধ করে দেওয়ায় মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার রাস্তা বন্ধ করতে আমাদের বাধ্য করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা কী করছে, কী খাচ্ছে, কোথায় থাকছে- সেই খবর কেউ নিচ্ছে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা বুঝে গেছে সব শালারা বাটপার।”
শরীফ বলেন, “আমরা বলতে চাই আন্দোলন গতবারের আন্দোলনের মতো নয়। হাসিনার বন্দুকের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলাম। অন্ধ হয়ে গেছি, খোঁড়া হয়ে গেছি, ভয় করি নাই। যদি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে বেঈমানি করা হয়, হাসিনা গেছে যে পথে তারাও যাবে সেই পথে।”
উন্নত চিকিৎসার দাবি জানালেও এ বিষয়ে কেউ ‘গুরুত্ব দিচ্ছেন না’ এমন অভিযোগ তুলে শনিবার রাত ১০টার পর সড়কে নেমে আসেন পঙ্গু হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আহতরা।
লালমনিরহাট থেকে কিডনি রোগের চিকিৎসার জন্য এসেছেন জালালউদ্দীন। তিনি বলেন, শ্যামলীর সিকেডি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক দেখিয়েছেন। তাকে দুপুরে কিডনি হাসপাতালে যেতে বলা হয়েছিল। তিনি বেশিক্ষণ হাঁটতে পারেন না। রিকশাও পাননি। শেষ পর্যন্ত দেড় হাজার টাকায় একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিয়ে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানাধীন ওই এলাকায় পাশাপাশি অনেকগুলো সরকারি বড় হাসপাতাল। শিশু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, এর উল্টোদিকে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, তার পাশে যক্ষা হাসপাতাল, চক্ষু বিজ্ঞানের পিছনে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট, মিরপুর সড়কে এই পাশে এক সারিতে সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, কিডনি ইনস্টিটিউট ও মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। এইসব হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের দিনভরই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
ইনকিলাব মঞ্চের মিছিলে সড়ক বন্ধ
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদতে জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সেইফ এক্সিট দেওয়ার প্রতিবাদ ও ব্যর্থতার দায়ে উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখী ইনকিলাব মঞ্চের মিছিলটি শিক্ষা ভবনের সামনে আটকে দেয় পুলিশ। তাতে ওই রাস্তায় কিছু সময়ের জন্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
রোববার বিকাল পৌনে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিকে মিছিল বের করে ইনকিলাব মঞ্চ।
বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষাভবনের মোড় হয়ে সচিবালয়ের দিকে রওনা হলে শিক্ষাভবনের সামনে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের ব্যরিকেডের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা।
মহাখালীতে ফের সড়ক অবরোধে তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা, যান চলাচল বন্ধ