ব্যাপক কড়াকড়ির মধ্যে দিয়ে পুলিশের হেলমেট ও জ্যাকেট পরিয়ে তাকে আদালতে নেওয়া হয়; চারপাশে ঘিরে থাকেন পুলিশ সদস্যরা।
Published : 06 Sep 2024, 10:24 PM
আদালতে কড়া নিরাপত্তা, সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আর আইনজীবীদের হইচইয়ের মধ্যে দিয়ে শুনানি শেষে সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ।
মাদারীপুর থেকে আটবার নির্বাচিত সাবেক এ এমপিকে গ্রেপ্তারের পরদিন শুক্রবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয় নিরাপত্তার চাদরে।
তাকে পুলিশের হেলমেট ও জ্যাকেট পরানো হয়; চারপাশে ঘিরে থাকেন পুলিশ সদস্যরা।
দুপুর থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি আদালত প্রাঙ্গণে সেনা সদস্যদেরও দেখা যায়।
আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য জনসন রোড ও কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের দুটি মূল ফটক বন্ধ করে পাহারায় নিয়োজিত হন পুলিশ ও সেনা বাহিনীর সদস্যরা। এ দুটি ফটকের ছোট দরজা (পকেট গেইট) দিয়ে পরিচয়পত্র দেখে আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকানো হয় আইনজীবী ও সাংবাদিকদের।
বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে পুলিশের গাড়িবহরে করে শাজাহান খানকে আদালতে আনা হয়। সাদা রঙের ভবনটির ষষ্ঠ তলার ১২ নম্বর এজলাসে শুনানির কথা থাকলেও নিরাপত্তার কারণে তাকে একই ভবনের দ্বিতীয় তলার ২৮ নম্বর এজলাসে নেওয়া হয় দশ মিনিট পর। শুনানির জন্য ঢাকার মহানগর হাকিম মাহবুব আহমেদ এজলাসে ওঠেন বিকাল ৪টা ২৩ মিনিটে।
এর আগে শাজাহান খানকে এজলাসে আনার সঙ্গে সঙ্গে দোতলার সিঁড়ির পাশে লোহার গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ভেতর ঢুকতে চাইলেও পুলিশ তাদের সুযোগ দেয়নি। পরে পুলিশের এক কর্মকর্তা এসে শুধু প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের ঢোকার সুযোগ দেন। তবে যাদের হাতে ক্যামেরা ছিল তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
পুরনো খবর
রিমান্ড শুনানিতে এজলাস কক্ষে ছিলেন ডিএমপির লালবাগ জোনের নতুন ডিসি মোহাম্মদ জসিম। এজলাসে সাংবাদিকদের প্রবেশে তিনি কড়াকড়ি করেন। সাংবাদিকরা তার সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান। পরে এজলাসে ছবি না তোলার প্রতিশ্রুতিতে ভেতরে প্রবেশ করেন সাংবাদিকরা।
এজলাসে কড়াকড়ির ফলে অন্য দিনের চেয়ে শান্তিপূর্ণ ও হইচই কম হলেও আসামি পক্ষের আইনজীবী নিজেকে ‘ড. কামাল হোসেনের জুনিয়র’ পরিচয় দিলে হট্টগোল হয়।
তবে আগে এক দফা হইচই হয় কাঠগড়ায় শাজাহান খানকে বসার জন্য এক পুলিশ সদস্য চেয়ার এনে দিলে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের একজন বলছিলেন, “১৭ বছরে অনেক আরাম আয়েশ হয়েছে। কাঠগড়ায় কোনো চেয়ার দেওয়া যাবে না।”
আইনজীবীদের ক্ষোভের মুখে পরে চেয়ারটি নিয়ে বের হয়ে যান ওই পুলিশ সদস্য।
কাঠগড়ায় ‘স্বাভাবিক’ দেখা যায় শাজাহান খানকে। আদালতে তার পক্ষের আইনজীবীদের হাত উঁচিয়ে তিনি আশ্বস্ত করেন। শুনানির সময় আইনজীবীদের কথা শুনছিলেন। কে কে শুনানি করছেন, সেটিও দেখছিলেন তিনি। তবে শুনানির শেষভাগে তাকে কিছুটা ‘বিষণ্ন’ দেখা যায়।
রিমান্ড আবেদন
শাজাহান খানকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে ঢাকার ধানমন্ডির জিগাতলায় মোতালিব নামের এক কিশোরকে হত্যার মামলায়।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন ৪ অগাস্ট গুলিতে নিহত হয়েছিল ওই কিশোর। এরপর ২৭ অগাস্ট মোতালিবের বাবা আব্দুল মতিন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বৃহস্পতিবার রাতে ধানমন্ডি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে এ মামলা গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
পরদিন তার দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি মডেল থানার এসআই মো. খোকন মিয়া। আর আদালতে রিমান্ড আবেদন পাঠ করেন এসি প্রসিকিউশনের এএসপি নূরুল মোত্তাকিন।
তিনি বলেন, “শাজাহান খান এ মামলার ২৩ নম্বর আসামি। তিনি অন্য আসামিদের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপব্যবহারের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে ছাত্র-জনতার ওপর শটগানসহ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করান।
“তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও পলাতক আসামিদের অবস্থান জানার পাশাপাশি তাদের গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা আছে। এ কারণে তাকে দশ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।”
‘১৭ বছর ধরে পরিবহন ক্যু করেছেন’
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে সহযোগিতা করেন আইনজীবী মো. মাসুদুর রহমান বাদল, আনোয়ারুল ইসলাম ও মো. কাইয়ুম হোসেন নয়ন।
আইনজীবী বাদল বলেন, “এ আসামি ১৪ দলের নেতাদের পরিকল্পনায়, সরাসরি নির্দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ও শারীরিক নির্যাতন চালান। ধানমন্ডিতে আন্দোলনের মধ্যে নোয়াখালী বেগমগঞ্জ উপজেলার আব্দুল মতিনের ১৪ বছরের ছেলে আব্দুল মোতালিব বুকে ও গলায় গুলি লাগলে নিহত হন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য শাজাহান খানের রিমান্ড আবশ্যক।”
আইনজীবী আনোয়ার বলেন, “ধানমন্ডির যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি আওয়ামী লীগের অফিসের কাছেই। শাজাহান খান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়ে গণভবনে মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে আন্দোলন দমনের বিষয়ে কঠোর থেকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন।”
পুরনো খবর
সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান গ্রেপ্তার
অপরদিকে আইনজীবী কাইয়ুম হোসেন নয়ন বলেন, “২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলন এই শাজাহান খানের কারণেই সংঘটিত হয়। গত ১৭ বছর ধরে যতবার দেশে আন্দোলন হয়েছে, তিনি পরিবহন ক্যু করেছেন। তিনি পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে মিটিং করে করে গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছেন।”
পরে আসামিপক্ষে রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করতে আসেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ কামরুজ্জামান মাহবুব। আইনজীবী শ্রী প্রাণ নাথ এসময় তাকে ডক্টর কামাল হোসেনের জুনিয়র পরিচয় করিয়ে দিলে হইচই শুরু করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।
আইনজীবী কাইয়ুম হোসেন নয়ন বলেন, “তারা ১৭ বছর ধরে বিভিন্ন জনের নাম বিক্রি করে খাচ্ছেন। ড. কামাল আমাদের সকলের সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তিনি ৭২ সালের সংবিধানের রচয়িতা। এই আদালতে তার নাম বিক্রি করতে দেওয়া হবে না। তার নাম প্রত্যাহার না করলে আমরা শুনানি করতে দেব না।”
এসময় আইনজীবী সৈয়দ কামরুজ্জামান মাহবুব বলেন, “আমি এখানে আইনজীবী হিসেবে শুনানি করতে এসেছি। আমি শাজাহান খানের আইনজীবী হিসেবে শুনানি করব, আমার আর কোনো পরিচয় নেই।”
তিনি বলেন, “আমার মক্কেল একজন সাবেক মন্ত্রী এবং মাদারীপুর সদর আসন থেকে নির্বাচিত আটবারের এমপি। তিনি কোনো অপরাধ করেন নাই, কেবল হয়রানির উদ্দেশে এজাহারে তার নাম যুক্ত করা হয়েছে।”
শাজাহান খানের অসুস্থতার কথা জানিয়ে এ আইনজীবী বলেন, “আমার মক্কেল ডায়বেটিক, উচ্চ রক্তচাপ, গুরুতর হৃদরোগ সহ নানান রোগে আক্রান্ত। তিনি পাঁচ দিন আগে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করেন। এর আগে ডাক্তার তাকে ওপেন হার্ট সার্জারির পরামর্শ দিলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিনি করতে পারেননি।
“তার ছয়টি ধমনীতে ব্লক আছে, এর মধ্যে একটি ধমনীর ৯৯ ভাগ ব্লক হয়ে গেছে। তাকে ছয়টি রিং পরানো হয়েছে।তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর খারাপ। এ অবস্থায় তাকে ডাক্তারের কাছে না পাঠিয়ে রিমান্ডে পাঠানো হলে মৃত্যু ঘটতে পারে।”
অসুস্থতার বক্তব্যকে ‘মিথ্যা’ আখ্যা দিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা হইচই শুরু করলে আইনজীবী কামরুজ্জামান মাহবুব বিচারকের কাছে শারীরিক পরীক্ষার কাগজপত্র ও মেডিকেল সনদ জমা দেন।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হইচইয়ের কারণে পরে তিনি আর কিছু বলতে পারেননি। শুনানি শেষে বিচারক শাজাহান খানের সাত দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।