দিনের একসময় রোদ উঠলে খাঁচার কোণ থেকে বেরিয়ে আসে প্রাণীগুলো; শাবকদের নিয়ে উষ্ণতা পেতে গুটিসুটি হয়ে থাকে শুয়ে-বসে।
Published : 18 Jan 2024, 08:34 AM
এক সপ্তাহ ধরে ঘন কুয়াশা আর হিম হাওয়ায় দেশজুড়ে চলা শীতের প্রকোপে জড়সড় রাজধানীর মিরপুরের জাতীয় চিড়িখানার প্রাণীরাও।
শীতে চেনা জৌলুস নেই চিড়িখানায়; দর্শনার্থীদের ভিড় নেই, বাদরের বাঁদরামো নেই, বাঘের হুঙ্কারেও সেই তেজ নেই। সবকিছুতেই লাগাম টেনে ধরেছে শীত।
পৌষের শেষ সপ্তাহে থেকে সারা দেশে বেড়েছে শীতের তীব্রতা, বেশ কিছু এলাকায় চলছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। ঘন কুয়াশায় দেখা মিলছে না সূর্যের, ফলে সবুজে ঘেরা চিড়িয়াখানায় ঠান্ডা যেন একটু বেশিই।
দিনের একসময় রোদ উঠলে খাঁচার কোণ থেকে বেরিয়ে আসে প্রাণীগুলো, উষ্ণতা পেতে শাবকদের নিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে-বসে থাকে।
মাঘের প্রথম দিন সোমবার চিড়িখানা ঘুরে দেখা গেল, শাবকদের নিয়ে চুপচাপ রোদ পোহাচ্ছে বাঘিনী শিউলি। জড়সড় হয়ে বসে আছে চারটি প্রাণী, শীতে ‘গা ফুলে’ আছে হরিণের, কুমির আর জলহস্তীরাও পানি ছেড়ে উপরে। গাছের পাশে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে ময়ূর।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, শীত আসার আগেই প্রাণীদের শীত নিবারণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। এখন বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন শীতে কাবু প্রাণীদের দিকে।
পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত পাখি, বানর, শাপ এরা শীত সহ্য করতে পারে না। শীত আসার আগে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কৃমিনাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছে, ভিটামিন-মিনারেল সরবরাহ করা হয়েছে। কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে সরবরাহ এখনও চলছে।”
প্রাণীদের শীত নিবারণ ও দর্শনার্থীদের কথা ভেবে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছু পাখি উপরের দিকে থাকতে পছন্দ করে, সেগুলোর জন্য উপরের দিকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কিছু পাখির জন্য খাঁচায় বাসার মত তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কোনো খাঁচায় বাক্স করে দেওয়া হয়েছে, সাপের খাঁচায় খড়কুটো দেওয়া হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীদের দেখার সুবিধা হয়। কিছু প্রাণী বালুতে থাকতে পছন্দ করে, সেগুলোর
খাঁচায় বালু দিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
দর্শনার্থীদের জন্য দিনের বেলায় খাঁচা উন্মুক্ত রেখে, রাতে পুরোটা ঢেকে দেওয়া হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।
চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা যায়, কিছু খাঁচা হালকা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, বেশিরভাগ খাঁচাই উন্মুক্ত। অন্য সময় খাঁচায় চলাফেরা অনেক বেশি থাকলেও শীতে জড়সড় হয়ে এক কোণে বসে থাকতে দেখা যায় প্রাণীগুলোকে।
১৮৬ একরের মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় বর্তমানে প্রাণী রয়েছে সাড়ে ৩ হাজারের মত। আর গত ৮ মাসে সেখানে নতুন শাবক জন্মেছে ২৪৮টি।
এর মধ্যে রয়েছে- জলহস্তির একটি শাবক, জেব্রার তিনটি, বাঘের তিনটি, ঘোড়ার একটি, হরিণের ৮৫টি, ময়ূরের ৮০টি, চোখারের ৩৫টি, কবুতরের ১৬টি, বাজিগরের ১৫টি, ঘুঘুর পাঁচটি এবং লাভ বার্ড পাখির চারটি ছানা জন্মেছে।
চিড়িয়াখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিউলি ও কদম দম্পত্তির শাবক তিনটি কেয়ারটেকারদের কাছে বকুল, কসমস আর কদম নামে পরিচিত।
গেল ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাদের প্রথম ‘অ্যাডাপটেশন’ বা অভিযোজন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসে। সাধারণত ৬-৮ মাস সময় লাগে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে। এরপর তাদের আলাদা খাঁচায় দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
এর আগে কোভিড মহামারীর সময়ে জন্ম নিয়েছিল অবন্তিকা আর দুর্জয় নামের দুটি বাঘ শাবক। প্রায় সাত মাস পর তাদের মৃত্যু হয়, যদিও মৃত্যুর কারণ জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এবার তাই শাবকদের নিয়ে একটু বেশিই সাবধানী তারা।
শাবকগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নাম দেওয়া হয়নি জানিয়ে চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল বলেন, “প্রদর্শনীর সময়ে তাদের নাম দেওয়া হবে। কেয়ারটেকাররা এখন আদর করে একেক নামে ডাকে।”
শাবকগুলোকে দেরিতে বাইরে আনার কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, “এতে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। সেইসঙ্গে এত মানুষ দেখে তো তারা অভ্যস্ত না। শাবকগুলো যেন ভয় না পায়, আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য বাইরে আনা হয়েছে।
খাঁচাবন্দি সঙ্গীহীন জীবন
বছর তিনেক আগে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, পুরুষ সঙ্গীর অভাবে চিড়িয়াখানার কলি ও মুক্তা নামের দুটি সিংহী এবং একটি স্ত্রী জাতের গন্ডারের মধ্যে ‘নেতিবাচক পরিবর্তন’ দেখা গেছে। বর্তমানে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডেইজি নামের একটি সিংহী ও সিংহ দীপ।
সঙ্গীহীন প্রাণীদের স্বস্তি দিতে চেষ্টা চালালেও করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তখন সম্ভব ছিল না বলে জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। আর এখন আর সেই ভাবনা নেই তাদের।
রফিকুল ইসলাম বলেন, “এ বছরও আমরা গন্ডারের জন্য চিন্তা করছি না। যেহেতু নতুন করে করা হচ্ছে সব, তখন তার বাসস্থানটা নতুন করে শিফট করা লাগবে। এই প্রাণীগুলো শিফট করাও অনেক কঠিন কাজ, কারণ তারা ভারী হয়। দেখা গেল তখন শিফট করতে গিয়ে তার ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা চাচ্ছি তার বাসস্থানটাকে একেবারে তৈরি করে তারপর নিয়ে আসতে।”
চিড়িয়াখানায় ২০২২ সালে দুই জোড়া সিংহসহ নতুন ১৪টি প্রাণী আনা হয়। সিংহীদের জন্য নতুন করে সঙ্গী আনার পরিকল্পনা না থাকার কথা জানিয়ে চিড়িয়াখানা পরিচালক বলেন, “আমাদের কতগুলো বিষয় চিন্তা করতে হয়, যেমন বয়সে খাপ খাবে কিনা।
“কারণ আমরা যখন বাইরে থেকে প্রাণী নিয়ে আসি, তখন তো স্বভাবতই বয়স্ক প্রাণী আনব না। এসব কারণে আমরা আর এদের নিয়ে চিন্তা করছি না।”
ডেইজি নামের সিংহীটির জন্ম হয়েছির ২০২০ সালে চিড়িয়াখানায়, তার সঙ্গীর মৃত্যু হয়েছে চার থেকে পাঁচ মাস হবে। আর দীপের জন্ম হয় ২০০৯ সালে, তার সঙ্গী মারা গেছে তিন বছর আগে।
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মানো সিংহী মুক্তার পুরুষসঙ্গী মতি সাফারি পার্কে জন্মেছিল ২০১৫ সালে। জন্মগত ত্রুটির কারণে মতি মারা যায় ২০১৯ সালে, এরপর থেকেই সঙ্গীহীন মুক্তা। কলি নামের ১৭ বছর বয়সী এশিয়াটিক প্রজাতির স্ত্রী সিংহটিও প্রায় সাত বছর ধরে সঙ্গীহীন।
মিরপুরের এই চিড়িয়াখানায় বর্তমানে গণ্ডার আছে একটি। ২০১০ সালে স্ত্রী ও পুরুষ মিলিয়ে জোড়া গণ্ডারই আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু পুরুষ গন্ডারটি ২০১৩ সালে মারা যাওয়ার পর তার নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে সঙ্গী হিসেবে ভেড়া দিয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ভেড়াটি মারা যাবার পর নতুন ভেড়া দেওয়া হয়েছিল গন্ডারটিকে, তবে সেটিকে সে সেভাবে গ্রহণ করেনি। দীর্ঘদিন সঙ্গীহীন থাকার কারণে গণ্ডারটির মধ্যেও বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে।
আরও পড়ুন-