আগুনে ৪৬ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ানো গ্রিন কোজি কটেজের অনিরাপদ দিকগুলো দেখে এক পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, “সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি।“
Published : 03 Mar 2024, 11:31 PM
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে প্রাণহানির পর যারা একের পর খাবারের দোকানে ঠাসা ওই ভবনে গিয়েছেন তারাই বিস্মিত হয়েছেন। ব্যবসাবহুল এ এলাকার বাণিজ্যিক ভবনটির অনিরাপদ দিকগুলো এক নজরেই ধরা পড়েছে তাদের কাছে।
তাদেরই একজন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ চৌধুরী।
ওই ভবনে আগুন লাগার পরদিন শুক্রবার সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় এক দশক ধরে বোমা অপসারণ ও নিষ্ক্রিয় করার কাজ করে আসছেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকার কোথাও বিস্ফোরণ বা বড় অগ্নি দুর্ঘটনার পরই ছুটতে হয় তার দলের। তবে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তিনি আর কখনও দেখেননি।
এ ভবনের পরিস্থিতি নিয়ে দেওয়া এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি এটিকে গ্যাস চেম্বারের সঙ্গে তুলনা করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রহমত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা পরের দিন সেখানে গিয়ে একটি রুমে ঢুকতেই পারিনি, তখনও ওটা এত গরম। আর ওখান থেকে গরম বাতাস বের হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। পরদিন গিয়েও পোড়া গন্ধ ও ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে। একটা কক্ষে বাতাস ঢোকার যেটুকু ন্যূনতম ভেন্টিলেশন থাকার দরকার এখানে সেটাও নেই।”
বেইলি রোডের এ ভবনে বৃহস্পতিবার রাতের এক আগুনে প্রাণ গেছে ৪৬ জনের। ভয়াবহ এ ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আগুনে পোড়া সেই ভবনকে ঘিরে অনেকের আগ্রহ দেখা গেল রোববারও।
তিন দিন পরও গ্রিন কোজি কটেজের সামনে উৎসুক মানুষের ভিড়, চলছে ছবি তোলা। লাইভের ছড়াছড়িও চোখে পড়েছে।
আগুনে ব্যাপক প্রাণহানির ধাক্কা কাটিয়ে আবারও প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে বেইলি রোড। সড়কের দুই পাশের বিপনীবিতান আর খাবারের দোকানগুলো আবারও জমজমাট হতে শুরু করেছে। তবে ভবনটির আশপাশে এখনও পোড়া গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দেয়।
রোববার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সেখানে একজন এসে উপস্থিত এক সাংবাদিককে অনুরোধ করলেন, ‘একটা ছবি তুলে দেবেন’। তার কথা শুনে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের এক সদস্য বললেন, “যান তো ভাই, ওই পার থেকে ছবি তুলেন, আপনারা তো জ্যাম লাগায় ফেলছেন।”
কিছুটা সরে গিয়ে পরিপাটি পোশাকের সেই যুবক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ১০ বছর আগে তিনি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের বিক্রয় বিভাগে কাজ করতেন। আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ ভবনটির ডেভেলপারের কাজ করে। তখন ওই গ্রুপের বিক্রয় বিভাগে কাজ করতেন দাবি করে ওই যুবকের ভাষ্য, নিচতলার অনেকগুলো দোকান তার হাত দিয়েই বিক্রি হয়েছে। এ কারণেই পোড়া ভবনের সামনে ছবি তুলতে চাইছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে ওই যুবক চড়া মূল্যে ভবনটির জায়গা বিক্রির তথ্য দেন। তার দাবি করা হিসাবে প্রায় দুই হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবনটির আনুমানিক মূল্য শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এ কথোপকথনের মধ্যে গ্রিন কোজি কটেজের চারতলার একটি কাপড়ের দোকানের কর্মী পরিচয়দানকারী এজাজ নামের একজন বলেন, নিচতলার ছোট দোকানগুলোর ভাড়া লাখ টাকার কম নয়।
ভবনটি ব্যয়বহুল হওয়ায় এটির প্রতিটি ইঞ্চি ব্যবহারে সবাই ছিলেন তক্কে তক্কে। একটুখানিও যাতে পড়ে না থাকে সে চেষ্টা করেছেন এটির জায়গা ভাড়া নেওয়া কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো।
আগুনের ঘটনার পর ভবনটি ঘুরে আসা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, সামনের দিকটা ছিল কাচঘেরা। অনেকগুলো তলায় ভেতরের দিকে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে ইন্টেরিয়র করে কাচের পেছনের জায়গাটুকুও বন্ধ করে রেখেছিল। তিনতলায় কাচের সামনে ছিল বিরাট এক বিলবোর্ড। ভবনের পেছনে বা পাশের দিক দিয়েও বাতাস চলাচলের তেমন ব্যবস্থা নেই। ভবনের একপাশে দেখা গেছে অল্প কয়েকটি জানালা আর অনেকগুলো এসির আউটডোর ইউনিট লাগানো।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এরকম দমবন্ধ পরিবেশই মানুষের মৃত্যু তরান্বিত করেছে। মৃতদের বেশিরভাগই বিষাক্ত ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা যান। বৃহস্পতিবার রাতে আটতলা ওই ভবনে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত এক ডজন মানুষ।
ওই অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস বলেছে, ভবনটিতে অগ্নি নির্গমন পথ ছিল না। ভবনের সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডারসহ নানা ধরনের মালামাল রাখা ছিল। ফলে নিচতলায় যখন আগুন লাগে তখন ওই সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারেনি মানুষ। উপরে আটকা পড়ে ধোঁয়ার বিষক্রিয়ায় অধিকাংশের মৃত্যু হয়।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী জানান, শুধু ভবনটির দোতলার সিঁড়ির মুখেই স্তুপ হয়ে পড়ে ছিল ২০টিরও বেশি লাশ। যাদের শরীর পোড়েনি, এদের প্রায় সবাই ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন।
এ ভবনের পাশের একটি পুরনো খাবারের দোকানের কর্মী বলছেন, এখানকার প্রত্যেকটি ভবনের ছাদ পর্যন্ত ভাড়া দেওয়া। এই ভবনটির ছাদেও এমব্রোশিয়া লাইভ মিউজিক ক্যাফে নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল।
শুধু এ ভবন নয়, আশপাশের প্রতিটি ভবনে থাকা একেকটি দোকানের যে ভাড়া তা পোষাতে দোকান মালিকেরা চান প্রত্যেকটি ইঞ্চি জায়গায় চেয়ার টেবিল বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করতে। এখানে কোন রেস্তোরাঁরই আলাদা গুদাম নেই। অথচ একেকটি রেস্তোরাঁর প্রচুর জিনিসপত্র রাখার প্রয়োজন হয়। বাধ্য হয়ে এরা সবাই সিঁড়িসহ যে যেখানে পারে সিলিন্ডার, জিনিসপত্র রাখে।
ভবনের সাততলায় হাক্কা ঢাকা রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা স্টিভেন কস্তা বলছেন, ছয়তলার অর্ধেক ফ্লোরজুড়ে তাদের রেস্তোরাঁ। সাতশ’ বর্গফুটের কিছু বেশি হতে পারে এর আয়তন। ভাড়া সার্ভিস চার্জ মিলিয়ে মাসে দুই লাখ টাকা।
তবে তাদের রেস্তোরাঁয় আগুন পৌঁছায়নি জানিয়ে স্টিভেনের দাবি, “আমাদের রেস্তোঁরায় দুজন অতিথি ছিলেন। আগুন লাগার পরপরই ম্যানেজার তাদের নিয়ে ছাদে চলে যান। ফায়ার সার্ভিস ছাদ থেকে প্রথম যে নারীকে উদ্ধার করেছেন তিনিই আমাদের গেস্ট ছিলেন।
“পরে আমরা একটা টিভি চ্যানেলের ড্রোন ক্যামেরায় নেওয়া ফুটেজে দেখেছি আমাদের রেস্তোরাঁ অক্ষতই আছে। যেভাবে অতিথিদের খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল সেগুলো সেভাবেই পড়ে আছে।“
ভবনের আরেকটি খাবারের দোকানের ব্যবস্থাপক বলছেন, এখানে অতিথিরা সব লিফট ব্যবহার করেন। সিঁড়ি কমই ব্যবহার করা হয়। যার কারণে অনেকেই সিঁড়িতে জিনিসপত্র রাখতে পারে।
তার ভাষ্য, “আমরা লাখ লাখ টাকা ভাড়া দিই। আমার ব্যবসা শুরুর সময় জামানত হিসেবে প্রায় অর্ধকোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব দিয়ে আমরা ব্যবসা করি। বিল্ডিংয়ে কী আছে না আছে এসব দেখার দায়িত্ব তো মালিকের। এখন আমাদের নিয়ে যদি পুলিশ টানাটানি করে তাহলে তো সেটা ফেয়ার হবে না, আমরাও তো ভিকটিম।“
এই ব্যবস্থাপকের দাবি, কোভিড মহামারীর পর থেকে তিনি এখানে আছেন, কখনও দেখেননি ‘কর্তৃপক্ষে’র কেউ এসেছে। তবে ভবনের ম্যানেজার (গ্রেপ্তার বিপুল) তাদের বিভিন্ন সময় বলেছেন, ব্যবসা চালাতে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে চলতে হচ্ছে তাকে।
'এমন রুদ্ধদ্বার নরক এক জীবনে আর দেখিনি'
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ চৌধুরী রোববার তার ফেইসবুকে লিখেছেন, “পেশাগত কারণে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ও বীভৎস ক্রাইমসিনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। কিন্তু বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজটাকে আমার কাছে একেবারেই আলাদা মনে হয়েছে। এ অভাবনীয়। এ অকল্পনীয়। এমন রুদ্ধদ্বার নরক এক জীবনে আর দেখিনি বললেই চলে। এখানে দুর্ঘটনা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। এতদিন কেন যে দুর্ঘটনা ঘটেনি, সেটাই ভাগ্যি।
“হিটলারের গ্যাস চেম্বারকেও হার মানায় এই কথিত গ্রিন কোজি কটেজ। টাকার নেশা আর কিছু ইতর শ্রেণির লোকের লোভ আমাদেরকে দিন-দিন কই নিয়ে যাচ্ছে জানি না। নিয়মকানুন না মেনে নিজেরাই প্রতিনিয়ত তৈরি করছি নিজেদের বসবাসের জন্য বিল্ডিং নামের একেকটা গ্যাস চেম্বার, একেকটা টাইম বোমা। এর কোনটা কখন বিস্ফোরিত হয়ে কার মৃত্যু কখন হয়, কীভাবে হয় জানি না। তবে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি।”