“মেধা, যোগ্যতা ও ফিটনেসের ভিত্তিতে যেখানে চাকরির ব্যবস্থা থাকে, সেখানে বয়স কোনো বিষয় নয়,” বলেন এক চাকরিপ্রার্থী।
Published : 04 Oct 2024, 01:56 AM
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে এক যুগ আগে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই দাবি জোরাল হয়েছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে।
বয়সসীমা বাড়ানোর প্রশ্নে এরই মধ্যে ইতিবাচক সংকেত দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার; তবে কত বছর বাড়ানো হচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বুধবার সচিবালয়ে বৈঠক শেষে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছেন, “বয়স বৃদ্ধি করার যৌক্তিকতা আছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”
১৬২টি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছরের বেশি থাকার কথা তুলে ধরে সে পথে বাংলাদেশকে হাঁটার দাবি বৈঠকে তুলে ধরেন আন্দোলনকারীরা।
বৈঠকের পর আন্দোলনকারীদের এক সমন্বয়ক রাসেল আল মাহমুদ বলেন, “আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ এবং শর্তসাপেক্ষে উন্মুক্ত করার দাবি নিয়ে এসেছি।”
তবে এই দাবি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবসর সুবিধা, চাকরিতে খাপ খাওয়ানো, চাকরিপ্রার্থী বেড়ে যাওয়ার মতো জটিলতা আছে বলে মনে করেন দুই বিশ্লেষক। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তারা সেইসব চ্যালেঞ্জের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
বয়সসীমাকে ৩৫ করার দাবিতে বেশ কয়েক বছর ধরে ‘চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ’র ব্যানারে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সেই দাবি একাধিকবার নাকচ করে দেয়।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মধ্যে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে নানা দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচির মধ্যে মাঠে নামে চাকরি প্রত্যাশীরাও।
বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে কী যুক্তি
স্বাধীনতার পর সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা আগের ২৫ থেকে বাড়িয়ে ২৭ বছর করা হয়েছিল। এরপর আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘ সেশনজট তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে ১৯৯১ সালে এসে বয়স ২৭ থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয়।
বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও আদিবাসী কোটায় আবেদনকারীদের জন্য বয়সসীমা আরও দুই বছর।
এর মধ্যে ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক এরশাদের সময়ে ৬৫০ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগে একবারের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫০ বছর পর্যন্ত করা হয়েছিল।
এখন যারা চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা ৩৫ করার পক্ষে লড়ছেন, তাদের অন্যতম সমন্বয়ক খাদিজা খাতুন মুক্তা বলেন, মূলত সেশনজট, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, কোভিড পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিয়োগে দুর্নীতি, এক সময়ে একাধিক নিয়োগ- এসব কারণে বয়স বাড়ানোর দাবি করছেন তারা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা সত্য সেশনজট আগের তুলনায় কমে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা ২৩-২৪ বছরের মধ্যে বের হতে পারে।
“কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও প্রচণ্ড পরিমাণ সেশনজট আছে। তারাও তো চাকরিপ্রার্থী। তারা চাকরি করবে কি- করবে না! কিন্তু তারাও তো চাকরিপ্রার্থী।”
নিজেও সেশনজটের ভুক্তভোগী জানিয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী মুক্তা বলেন, “আমার ২০১৮ সালের রেজাল্ট আমি পেয়েছি দেড় বছর পরে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে।
“কিন্তু কোভিডের কারণে আটকে যাওয়ার পর আমার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করতে পুরো তিনটা বছর লাগছে, রেজাল্টসহ সাড়ে তিন বছর। আমি কিন্তু ওই সময়ে নিয়োগ সার্কুলার কোনো কিছু পাইনি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ‘ব্যাপক সেশনজট’ থাকার কথা বলছেন মুক্তা।
আন্দোলনকারী হারুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও অনেক জায়গায় বিশাল একটা সেশনজট আছে। কোভিডের সময় দুবছর গ্যাপ হয়েছে, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ছয় মাসের মত গেছে পরীক্ষা হয় না, নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতায় সময় যায়- এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আমরা বয়স ৩৫ বছর করার দাবি জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “সরকারি চাকরিতে ঢোকার অধিক সময় পেলে (পাস করার পর) ৭-৮ বছর থাকবে, তখন আমি যদি একটা বেসরকারি চাকরি করি, সাথে সরকারি চাকরির চেষ্টা করছি- বেকার না; সরকারি কম বেতন হলে আমি বেসরকারি চাকরিতে নাও ছেড়ে যেতে পারি। যখন আমার হাতে চাকরি থাকবে, সরকারি চাকরির আগ্রহটা কম থাকবে, ঝোঁক কম থাকবে।”
এক আলোচনা অনুষ্ঠানে চাকরিপ্রার্থী আল কাউসার মিয়াজি বলেন, “৩৩ বছরে আমাদের আবেদনের বয়স একদিনও বাড়ানো হয়নি। ইতোমধ্যে ২০১১ সালে অবসরের প্রবেশের বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ করা হয়েছে।
“তাদের যৌক্তিকতা ছিল, তাদের নাকি গড় আয়ু বেড়ে গেছে। তাহলে আমরা কি বলতে পারি- যারা বেকার থাকে, তাদের গড় আয়ু কমে; আর যারা আমলা, তাদের বাড়ে।”
তিনি বলেন, “বহির্বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৬২টিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ এর উপরে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতে প্রদেশভেদে সেখানে ৪৫ আছে, শ্রীলঙ্কায় ৪৫, মালদ্বীপে ৪৫। শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ৩০ বছর।
“যুক্তরাষ্ট্র কানাডায় ৫৯ বছরে প্রবেশ করতে পারে। যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকংয়ে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত।”
মেধা, যোগ্যতা ও ফিটনেসের ভিত্তিতে যেখানে চাকরির ব্যবস্থা থাকে, সেখানে বয়স কোনো বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বয়স বাড়ানো কি জটিল বিষয়?
অবসর ও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়কে ‘ডেলিকেট ইস্যু’ হিসেবে বর্ণনা করছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান।
তিনি বলেন, “চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ানো এবং অবসরের বয়স বাড়ানোর বিষয়টা খুব ডেলিকেট ইস্যু। খুব চিন্তাভাবনা করে এগোতে হবে।”
শহীদ খান বলেন, “এটা গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে যে, আসলে বয়সসীমা কত বাড়াবেন। গ্র্যাজুয়েশন করে যারা বের হয়ে যাচ্ছেন, তারা ২৩-২৪ বছরে বের হয়ে যাচ্ছেন। তারপর সাত বছর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকে। তারা তিনটা পরীক্ষা দিতে পারেন।
“এখন বয়সসীমা বাড়িয়ে দিলে তারা হয়তো আরও দুইটা পরীক্ষা দিতে পারবে। তাদের জন্য সুযোগ তৈরি হবে। নতুনরা যোগ দেবেন, চ্যালেঞ্জও হবে।”
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্নাতকের পরীক্ষা ঠিক সময়ে হওয়ার কারণে আগের মতো বয়সসীমা থাকতে পারে বলে মত শহীদ খানের।
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার সিস্টেম চালু হওয়ার পরে সেশনজট ছিল না। এ বছর কয়েকটা মাস মিস করলাম।
“এর বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশনজট ছিল না। তার মানে গ্র্যাজুয়েশন করে তারা বের হয়ে যাচ্ছেন। গ্র্যাজুয়েশন মানে অনার্স পরীক্ষা দিয়েই চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন। বিএ বা বিএ অনার্স করেই চাকরির পরীক্ষা দিতে পারে।”
সাবেক এই সচিব বলেন, “৩০ বছর রাখার ফলে কী ধরনের প্রভাব পড়ছিল, তার কোনো পর্যালোচনা আমরা দেখি না। পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে যদি অ্যানালাইসিস পেতাম, তাহলে বোঝা যেত।
আন্দোলনকারীরা ভারত, পাকিস্তান বা অন্যান্য দেশের যে বয়সসীমা তুলে ধরছেন, সেই প্রসঙ্গে শহীদ খান বলেন, “তারা দাবি করছেন; দাবির যৌক্তিকতাও হয়ত থাকতে পারে।
“কিন্তু অভারঅল যখন আপনি চিন্তা করবেন, তখন তারা কত বছর চাকরি করবেন, সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ২৫ বছর চাকরি না করলে পুরো পেনশন আপনি পাবেন না।”
একজন সহকারী বেতার প্রকৌশলীর বিসিএস তথ্য ক্যাডার ছেড়ে নন-ক্যাডারের চাকরিতে যোগ দেওয়ার ঘটনা গত জুনে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়লে সরকারি এক চাকরি ছেড়ে আরেক চাকরিতে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়বে বলে মনে করেন শহীদ খান। সেক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীদের অনেকেই সুযোগ হারাবেন, আর সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনবল ঘাটতি থেকেই যাবে।
বয়সসীমা বাড়ালেও সেটা ‘সাময়িক সময়ের’ জন্য করার পক্ষে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিষয়ে বিভিন্ন বইয়ের লেখক ফিরোজ মিয়া।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা যে যুক্তি দিচ্ছে- করোনাভাইরাস মহামারি, বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ আছে, সরকারের নিয়োগ হচ্ছে না- এই কারণে সাময়িকভাবে বাড়ানো যেতে পারে। তবে সর্বক্ষেত্রে না। পাশাপাশি কোটা ব্যবস্থার কারণে যারা বঞ্চিত হয়েছে, তাদের স্বার্থেও এটা করা উচিত।
“তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির যে পদগুলো, ওরাতো ১৮ বছর থেকে যোগ্য হয়ে যায়। তো, ১৮ থেকে ৩০ বছর হলে ১২ বছর সময় পাইছে, তাদেরকে আর কত দিবেন! এ কারণে তাদেরটা ৩৫ করাটা অযৌক্তিক। ক্যাডার সার্ভিস বা অন্যান্য, সেখানে সাময়িকভাবে কিছুদিনের জন্য করা যেতে পারে। কিন্তু এটা স্থায়ীভাবে করা উচিত হবে না।”
কেন উচিত হবে না, সে বিষয়ে যুক্তি দিতে গিয়ে ফিরোজ বলেন, “কারণ এমনিতে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি, নিয়োগ পরীক্ষাগুলো ম্যানেজ করা যাবে না। আর তাছাড়া- একটা লোক যদি ৩৫ বছরই শুধু সরকারি চাকরির পেছনে ঘোরে, তারপরে যদি না পায়, তখন তো নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার আর কোনো বয়সও থাকবে না। এ সকল দিক চিন্তা করতে হয়।
“যেহেতু সাময়িক সময়ের জন্য, বিগত সরকারও তো দুই বছর বাড়ায়ছিল- করোনাভাইরাস মহামারীর জন্য, একটা সাময়িক সময়ের জন্য এটা করতে পারে। স্থায়ীভাবে করা ঠিক হবে না।”
বেশি বয়সিরা ফলে পিছিয়ে
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা না বাড়ানোর পেছনে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এবং অপেক্ষাকৃত কম বয়সিদের পরীক্ষায় ভালো করার তথ্যের কথা বলেছিলেন বিগত সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
গত ৩ জুলাই জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছিলেন, ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় বিভিন্ন স্তরে উত্তীর্ণ প্রার্থীগণের বয়স ও জেন্ডারভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী কম বয়সী (২৩-২৫) সুপারিশ করা প্রার্থীর সংখ্যা সব থেকে বেশি (৩৭.৬৮%) এবং বেশি বয়সী (২৯ এর ঊর্ধ্বে) সুপারিশ করা প্রার্থীর সংখ্যা সব থেকে কম (১.৭১%)।
পিএসসির ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪১তম বিসিএসেও চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৯ বছরের বেশি বয়সিদের সংখ্যা ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিপরীতে ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সি প্রার্থীর সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৯০ শতাংশ।
ফরহাদ হোসেনের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, “(বেশি বয়সিদের) এটা পারার কথাও না। কারণ ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের যে লেখাপড়া, তাদের যে প্রস্তুতি, এটা অবশ্যই বেশি ভালো হবে। এটা বললে- যারা ৩৫ বছরের জন্য লড়াই করছেন, তারা হয়ত একটু রাগ করতে পারেন।
“বেটার হবে এই কারণেই যে- উনি হয়ত ২-৩টা (বেশি) পরীক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু উনি তো লেখাপড়ার সাথে নাই। চাকরির বয়স ৩৫ বছর করে দিলেই যে অনেক বয়স্ক লোক চাকরি পাবেন, এটা প্রত্যাশা করাটা বোধহয় ঠিক হবে না। সম্ভাবনা খুব কম। শতাংশের হিসাবে খুবই কম হবে, আমিও তাই মনে করি।”
মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও এক্ষেত্রে তৈরি হয় বলে অভিজ্ঞতা থেকে বলেন শহীদ খান।
“যেমন ধরুন, একজন ২৫ বছর/২৭ বছরের যুবকের অধীনে যদি ৩৫ বছরের একটা লোক চাকরিতে যায়; যে ২৫ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকল, সে ইতোমধ্যে সুপারভাইজার লেভেলে ৩০ বছরে পৌঁছে যাবে, তখন আপনি বেশি বয়স দিয়ে কার অধীনে চাকরি করবেন, এটা অ্যাক্সপ্টে করতেও কিন্তু অনেকের অসুবিধা হয়।
সাবেক এই সচিব বলতে থাকেন, “দেখা গেল, আপনার বিভাগের যে ফার্স্ট ইয়ারে ছিল, সে চাকরি পেয়ে গেল, বস হয়ে গেল। আপনি তার অধীনে চাকরি করছেন, এই মানসিক ও সামাজিক বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে।”
১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের সময় ৫০ বছর পর্যন্ত বয়স বাড়িয়ে ৬৫০ জনকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের ফল ভালো হয়নি বলে জানান শহীদ খান।
তিনি বলেন, “সেখানে দেখা গেছে, বয়স্ক যারা- তাদের পারফর্মেন্স তেমন ভালো ছিল না। অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।”
বেশি বয়সে চাকরি হলে কর্মস্থলে খাপখাওয়ানোতে জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন ফিরোজ মিয়া।
তিনি বলেন, “সমন্বয়ে ঘাটতি দেখা দেবে। ২৬/২৭ বছর- আর ৩৫/৩৬ বছরের একজন; এখানে তো এনার্জিরও একটা ব্যাপার আছে।”
পেনশনে হবে জটিলতা
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে পুরো পেনশন সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হওয়ার কথা তুলে ধরেন শহীদ খান।
চাকরির বয়স ২৫ বছর না হলে যে পুরো পেনশন সুবিধা মেলে না, সেই কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তখন রিটায়ারমেন্টের বয়সসীমা হবে ৬০। একেবারে ২৫ বছর ধরে তো ঠিক করা যাবে না, আরও দুয়েক বছর দিতে হবে। তখন অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন আসবে, তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ছে না কেন।
“অবসরের বয়সসীমা বাড়লে সেটা কেবল যারা ৩৫ বছরে চাকরিতে ঢুকবেন- কেবল তাদেরটা বাড়বে এমন তো না। যদি ধরেন- অবসরের বয়সটা আমরা বাড়িয়ে দিলাম, তাহলে নিয়োগের পরের যে ধাপগুলো আছে, সেখানে পাঁচ বছরের পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যাবে।”
চলতি বছর প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার যে বাজেট পাস করা হয়েছে তার ১৬ শতাংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় হবে, যার পরিমাণ অন্তত ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।
নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করার চেষ্টা করা হলে সরকারের ওপর আর্থিক চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন আবু আলম মো. শহীদ খান।
“গণকর্মচারীর সংখ্যা, সেখানে কিন্তু বড়সড় রকমের একটা যৌক্তিক আপত্তি আছে যে, সরকারটা অনেক বড়। …এত বড় সরকার (দরকার) আছে কি না, সেটা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। যেখানে সরকারটা ছোট করার কথা আছে, সেখানে সরকারকে আমরা পেট মোটা করব কি না, সেই ব্যাপার আছে।”
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৯০ হাজার।
পেনশন প্রশ্নে জটিলতা এড়াতে যারা বেশি বয়সে চাকরিতে ঢুকবেন, কেবল তাদের জন্য অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে শহীদ খান।
তিনি বলেন, “সেক্ষেত্রে সমাধান হলো যে- ৩৫ বছরে চাকরিতে ঢুকবেন, তাকে একটা পিরিয়ড ঠিক করে দেওয়া হবে যে, ২৫ বছর না হলে তো পেনশন পুরোপুরি পাবেন না, তাহলে তার জন্য ৬৫ করা হতে পারে। কিন্তু সকলের জন্য ৬৫ করাটা যৌক্তিক হবে না। তাহলে চাকরির সুযোগ কমে যাবে।”
তবে পেনশন ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবি জানিয়ে আন্দোলনকারী খাদিজা খাতুন মুক্তা বলেন, যে যত বছর চাকরি করবে, সেই অনুযায়ী পেনশনটা পাবে- সেটা করলে বিষয়টা লাভজনক হবে। তা করা সম্ভব না হলে চাকরিতে প্রবেশের বয়সের সঙ্গে অবসরের বয়সসীমার সামঞ্জস্য রাখতে পারে।
সরকারি চাকরির সুযোগ কমলে কর্মসংস্থান নিয়ে আরও জটিলতা তৈরি হতে পারে মন্তব্য করে সাবেক সচিব শহীদ খান বলেন, “মোট চাকরি ১৯ লাখের কিছু বেশি। কয়েক লাখ শূন্য আছে। প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার বেরিয়ে যায় অবসর বা অন্যান্য কারণে।
“প্রতি বছর গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি লাখ লাখ। সরকারি হিসাবে ২৬-২৭ লাখ শিক্ষিত বেকার আছে, বাইরের হিসাবে ৪০-৪২ লাখ বেকার আছে। সে তুলনায় চাকরির সংখ্যা কত?”
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দেশে বেকারত্বের হার হচ্ছে ৩.৬ শতাংশ। এর মধ্যে যুব বেকারত্ব প্রায় ৮০ শতাংশ। কোনো প্রকার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কর্মসংস্থানে নিয়োজিত নেই- এমন যুবকের সংখ্যা ৩০ শতাংশ।
বেকার সমস্যা কাটাতে সরকারি চাকরির বাইরে অন্যদিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে শহীদ খান বলেন, “এখানেই যে সবকিছু করতে হবে, তা তো নয় আসলে; সেই জায়গায় আমাদের ফোকাস করতে হবে।
“কিন্তু আমাদের ফোকাস হচ্ছে, একটা সরকারি করতে হবে। ৯ থেকে ২০ গ্রেডের মধ্যে চাকরির সংখ্যাটা তো খুবই কম। এটাও চিন্তা করতে হবে।”
অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ালে বেসরকারি খাতও সে পথে হাঁটতে পারে বলে আশা প্রকাশ করে আন্দোলনকারী হারুন বলেন, “সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে যাওয়ার সুযোগ আমাদের সামনে বাড়বে।”
অন্য দেশে বয়সসীমা কত
ভারতের ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিতে প্রবেশের সর্বনিম্ন বয়স ২১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩২ বছর। এই কমিশনের অধীনে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের (আইএএস) নিয়োগ হয়ে থাকে।
তবে তফশিলি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমার সঙ্গে ৫ বছর পর্যন্ত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও আহত কমিশন অফিসারদের ক্ষেত্রে ৩ বছর এবং প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ১০ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
ভারতের রাজ্য সরকারের অধীনে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা একেক রাজ্যে একেক রকমের। যেমন- পশ্চিমবঙ্গে কিছুক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৪০ বছর এবং তেলেঙ্গানায় ৪৬ বছর পর্যন্ত এ সীমা রয়েছে।
শ্রীলঙ্কার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বনিম্ন সীমা ১৮ বছর। তবে উর্ধ্বসীমা ৪৫ বছর পর্যন্ত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা ৩০ বছর এবং ৩৫ বছরও রয়েছে।
এর আগে শ্রীলঙ্কায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩৫ বছর। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোটাবায়া রাজাপাকসে সরকার তা বাড়িয়ে ৪৫ পর্যন্ত করেছিল।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাকিস্তানেও সাধারণভাবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাংলাদেশের মতো ৩০ বছর।
তবে তফশিলি সম্প্রদায়, বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী, কোনো কোনো আদিবাসী, বেলুচিস্তান এবং জম্মু-কাশ্মিরের নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা ৩২ বছর।
নেপালে সরকারি ও সংসদীয় বিভাগে চাকরি প্রবেশের ক্ষেত্রে সাধারণ বয়সসীমা ন্যূনতম ১৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। তবে নারী ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে এই সীমা ৪০ বছর পর্যন্ত।
শূন্যপদে পূরণের ক্ষেত্রে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার পদে বয়সসীমা ৪৫ বছর পর্যন্ত করার বিধান রয়েছে নেপাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়মে।
স্বাস্থ্যখাতের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সর্বনিম্ন বয়সসীমা ২১ এবং সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫ বছর রয়েছে দেশটিতে।
ভুটানের রয়্যাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, তাদের অধীনে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ন্যূনতম বয়সসীমা ১৮ এবং সর্বোচ্চ ৪০ বছর রয়েছে।
যেসব কারণে বাড়ছে না সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স, সংসদে
সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ