“এই মুহূর্তে কলেরা স্যালাইন, স্যালাইন সেটসহ তিন চারটা জিনিসের সংকট আছে,” বলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
Published : 02 Sep 2024, 11:07 PM
তিন দিন ধরে ১৬ মাস বয়সী সন্তান আরাবকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন আনোয়ার হোসেন। অনবরত পাতলা পায়খানা আর বমি নিয়ে শনিবার তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এখন শিশুটির বমি কমলেও বন্ধ হয়নি পাতলা পায়খানা। এ অবস্থায় এখানেই ভর্তি রাখবেন নাকি অন্য কোনও চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না আনোয়ার।
সোমবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কথা হচ্ছিল বাবা আনোয়ারের সঙ্গে।
নাজিমপুর গ্রামের এই বাসিন্দা বলেন, "অন কিত্তাম, মাতায় ধরে না। কোনো কূলকিনারা পাই না।"
পেশায় রাজমিস্ত্রি আনোয়ারের আয়-রোজগার বন্ধ হয়েছে বন্যায়। তার উপর এখন ছেলে অসুস্থ্য; কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।
তিনি বলেন, "এইহা নতুন কিছু ওষুধ দিতেছে, কিছু বাইরেত্তুনও কিনি আনা লাগে।"
কেবল আনোয়ারের শিশু সন্তানই নয়, বন্যার পানি নামার সঙ্গে প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বেগমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে এখন মেঝেতে রেখেও ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এর বাইরে গুরুতর নয়- এমন ডায়রিয়া রোগীকেও বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অসীম কুমার দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এভারেজে প্রতিদিন একটা ৫০ বেডের এই হাসপাতালে শুধুমাত্র ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন প্রায় ৫০ জন। এর বাইরে আদারস রোগী আছে।"
৫০ শয্যার এই হাসপাতালটিতে বর্তমানে ১১৯ জন রোগী ভর্তি আছেন, এর মধ্যে ৯৮ জন রোগীই ডায়রিয়া আক্রান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, "গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ৫১ জন ভর্তি হয়েছেন। ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ৯৮ জনের মধ্যে কেউ দুই দিন কেউ তিনদিন, কেউ ৫ দিনও ভর্তি আছেন।"
বন্যার পর থেকেই হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে ডা. অসীম বলেন, "বেড কাভারেজ অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। গত ৩১ তারিখে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ১৫৭ জন রোগী।
"ডায়রিয়া আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ডায়রিয়ার ৫১ রোগীর মধ্যে ৩০ জনই শিশু। সবমিলিয়ে ডায়রিয়া আক্রান্তদের প্রায় ৭০ ভাগই শিশু।"
এছাড়া বন্যার সঙ্গে বেড়েছে বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ। বিপুল সংখ্যক রোগী বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ নিয়ে প্রতিদিনই হাসপাতালে এসে সেবা নিচ্ছেন।
বেগমগঞ্জের নরোত্তমপুরের বাসিন্দা জসীম ও তার স্ত্রী ৩-৪ দিন ধরে চুলকানি জাতীয় চর্মরোগে ভুগছেন। ডাক্তার দেখানোর পর ২ ধরনের ওষুধ হাসপাতাল থেকেই দেওয়া হয়েছে, আরেকটি ওষুধ কিনতে হবে বাইরে থেকে।
জসীম বলেন, "পানিতে আডি আডি এগুন অই গেছে।"
মাইজদি রোড এলাকার সাব্বিরও এসেছেন হাতে খোসপাঁচরা নিয়ে।
তিনি বলেন, "হানিত্তুন এগুন হই গেছে গত ৭-৮ দিন ধরি। এহন এইখানে আইছিআর ডাক্তার ওষুধ দিছে।"
আইসিডিডিআরবি'র ফিল্ড এটেন্ডেন্ট মো. শাহবুদ্দিন হাসপাতালে বলেন, "আগে রোগী বেডের বাইরে যাইতোনা এখন ফ্লোরেও ভর্তি, সব ডায়রিয়ার রোগী। ৩-৪ দিন ধরে এই সংখ্যা বাড়তির দিকে। এখন ডায়রিয়া চর্মরোগসহ পানিবাহিত রোগ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।"
বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে চিকিৎসকসহ গিয়ে গিয়ে সেবা দিচ্ছে ব্র্যাক। প্রতিদিনই তারা বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছেন এবং সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ ওষুধও সরবরাহ করছেন।
ব্র্যাকের প্রোগ্রাম অফিসার ইসমাইল হোসেন বলেন, "এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যা চর্মরোগ আর ডায়রিয়া। পানি টানের পর থেকে বাচ্চা-মহিলাদের চর্মরোগ বেশি দেখা যাচ্ছে।
“আমরা ফিল্ডে অনেক ডায়রিয়া রোগী পাচ্ছি। ইমার্জেন্সি সিচ্যুয়েশন হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছি।"
চর্মরোগ আর ডায়রিয়ার প্রকোপে নিজেদের প্রস্তুতির কথা জানাতে গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অসীম কুমার দাশ বলেন, "প্রিপারেশন এতোদিন সবকিছুই ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে কলেরা স্যালাইন, স্যালাইন সেটসহ তিন চারটা জিনিসের সংকট আছে।
"সিভিল সার্জন অফিসে কলেরা স্যালাইন আসছে। এছাড়া আমরা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আশা করি, সংকট হবে না।"
তিনি বলেন, "অনেক ডায়রিয়া রোগী আসছে ২০ টাকা ৫০ টাকাও পকেটে নিয়ে আসতে পারছে না। শূন্য হাতে যে আসছে, তাকে আমি বাইরে থেকে কিনাব কীভাবে? আর এখন কেনার মতো অ্যাবিলিটিতোও নাই।
"সেক্ষেত্রে স্যালাইন ২ হাজার (এমএল) লাগুক, ৫ হাজার লাগুক- তাকে দিতে হচ্ছে। আর যে কন্ডিশনে রোগী আসছে ১ হাজারে (এমএল) কাভার করছে না। ২-৩ হাজার থেকে ৪-৫ হাজার পর্যন্ত স্যালাইন দিতে হচ্ছে।"
এ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী এসেছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. অসীম বলেন, "এখন পর্যন্ত ৩-৪ জন আসছে, কিন্তু তাদেরকে বিষাক্ত কোনো সাপে কাটেনি। তাই এটা নিয়ে কোন ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।"