“আশা করছি দিন দিন অর্ডার আরও বাড়তে পারে, অন্য সময় তো এমন সময় অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিতে হয়,” বলেন একজন।
Published : 21 Mar 2025, 12:11 PM
রোজার কয়েকদিন যেতেই কাজ করাতে যেখানে অনুনয়-বিনয় করতে হতো, সেখানে ১৯ রোজাতেও হাসিমুখে কাজ নিচ্ছেন ঢাকার খলিফারা। কেউ বলছেন- কাজের চাপ নেই, কেউ আগের মতোই কাজ পাওয়ার কথা বলছেন, কেউবা কাজ পাওয়ার আশায় আছেন এখনও।
মিরপুর ১২ নম্বর রোডের ভিও টেইলার্সের কাটিং মাস্টার নজরুল খন্দকার মনে করছেন, মানুষের হাতে পয়সাকড়ি কম আছে, তাই কাজ কমে গেছে। আর এ অর্ডার কমেছে ছেলেদের কাজে।
“আমি যা দেখছি, যখনই দেশে কোনো অভাব-অনটন হয়, তখনই দেখছি ছেলেদের কাজটা কমে যায়। মেয়েদের কাজ কমে না। তুলনামূলকভাবে, আমি দেখলাম ছেলেদের কাজ কমে গেছে। যেখানে ২০-২৫ পিছ প্যান্টের কাজ হতো, সেখানে ৮-১০ পিছ পেয়েছি।”
ঈদের আগে সাধারণত এসময় দর্জিরা দম ফেলার ফুরসত না পেলেও এবার চিত্র ভিন্ন বলে জানাচ্ছেন নজরুল।
তার ভাষ্যে, “অন্যান্য বছর এই সময়ে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দেই। এবার যেহেতু কাজ কম, তাই অর্ডার নিচ্ছি এখনও। কাজের প্রেসার কম থাকার কারণে এখনও অর্ডার নিচ্ছি।”
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে তাদের ব্যস্ততা চলছে, তবে তা আগের মতন নয়। কাজের দাম ও মজুরি বাড়লেও ‘অর্ডার বাড়েনি’। হাতে গোনা কয়েকটি টেইলার্স ছাড়া বেশিরভাগ টেইলার্সেই এখনও কাজের ‘অর্ডার’ নেওয়া হচ্ছে।
কেরাণীগঞ্জের জিনজিরা, কালীগঞ্জ ও চুনকুটিয়া চৌরাস্তা, গার্লস স্কুল রোড এলাকা, পুরান ঢাকার সুরিটোলা, ডালপট্টি, সূত্রাপুর কাঠের পুল, বকশিবাজার, আজিমপুর, ঝিগাতলা, মোহাম্মদপুর, বসিলা, মিরপুর, পল্লবী, ভাটারা, শাহজাহানপুর, রামপুরা, মাতুয়াইল, দনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই মিলেছে।
টেইলার্সে টেইলার্সে নতুন কাজ যেমন আসছে, তেমনই আগের কাজ শেষ করার চাপও রয়েছে। কেউ মাপ নিচ্ছেন, কেউ কাপড় কাটছেন, কেউ আবার সেলাই করছেন, কেউ বোতাম লাগিয়ে ইস্ত্রি করছেন। আর এসব কাজ সময়মত বুঝিয়ে দিতে প্রায় সব টেইলার্সেই নিয়োগ করা হয়েছে অতিরিক্ত জনবল। সকাল থেকে শুরু করে তাদের এ কর্মযজ্ঞ চলে গভীর রাত পর্যন্ত।
লক্ষ্মীবাজারের সাগর টেইলার্সের কর্ণধার সেলিম রেজা বলছিলেন, “এবারের মৌসুমে অর্ডার মোটামুটি ভালোই পেয়েছি। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কাজের চাপ কিছুটা কম। গত বছর এই সময়ে প্রচুর অর্ডার ছিল, যার ফলে কর্মচারীরা দম ফেলার সময়ও পেত না।
“তবে এবারও আমরা ভালো পরিমাণে কাজ করছি এবং সময়মতো সব অর্ডার সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। আশা করছি, ঈদের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, অর্ডারের পরিমাণ আরও বাড়বে।”
প্যান্ট বানাতে ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা, সালোয়ার কামিজে ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা, ব্লাউজ বানাতে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা, পেটিকোটে ২০০ টাকা, ম্যাক্সি বানাতে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, গাউন বানাতে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা এবং বোরকা বানাতে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের বিসমিল্লাহ লেডিস অ্যান্ড জেন্টস টেইলার্সে পোশাক বানাতে এসেছেন আসমা আক্তার।
তিনি বললেন, “এই ঈদেই সবার জন্য নতুন জামা নিতে হয়। কিন্তু মজুরির দাম আগের থেকে বেড়েছে। আমরা যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের বাইরে থেকে থানকাপড় কিনে টেইলার্সে বানালে দাম কম পড়ে এবং পছন্দ অনুযায়ী কাপড় নিতে পারি।”
ওই টেইলার্সের মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “গতবারের মতো অর্ডার এখনও না হলেও কাজ কিন্তু কম নয়। এই কাজ উঠাতেও রাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে। ঈদের দুদিন আগেই জামা কাপড় ডেলিভারি করতে হবে, তাই চাপ একটু বেশি।”
ঈদে ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট ও পাঞ্জাবি তৈরিতে খরচ পড়ছে গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে দর্জির কাছে ছেলেদের ভিড় এবার তলানিতে ঠেকেছে।
কেরাণীগঞ্জের জিনজিরা চয়েজ লেডিস অ্যান্ড জেন্টস টেইলার্সের কর্ণধার মাহমুদুল হাসান বলেন, “বর্তমানে কাস্টমার নতুন নতুন ডিজাইন বলে, আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করি। অর্ডার আমাদের আছে, যা আছে এর বেশি আমরা কাজ করতে পারি না।
“লোকজন যা আছে- তার মধ্যেই শেষ করি। তবে এবার মেয়েদের তুলানায় ছেলেদের কাপড়ের অর্ডার কম পড়েছে।”
সূত্রাপুর থানার বিপরীত পাশের সূত্রাপুর টেইলার্সের কাটিং মাস্টার রহমত উল্লাহ বলেন, “কাজের অর্ডার এখন পর্যন্ত ভালো, তবে আশা ছিল আরও বেশি হবে। এবার কর্মচারী বাড়িয়ে দেখছি- বিপদ হবে।
“আশা করছি দিন দিন অর্ডার আরও বাড়তে পারে, অন্য সময় তো এমন সময় অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিতে হয়। এবার এখনও নিচ্ছি।”
শরীরের জন্য মানানসই পোশাক বানাতে অনেকেই তৈরি পোশাকে ভরসা রাখতে পারেন না। তাদের একজন পুরান ঢাকার ডাইল পট্টির বাসিন্দা রোকসানা বেগম বলেছিলেন, “রেডিমেড পোশাক কোনো সময়ই আমার ফিটিং হয় না, আবার ডিজাইন পছন্দ হলেও কালার মেলে না।
“এর চেয়ে দর্জির কাছে কাপড় নিয়ে গেলে পছন্দমতো পোশাক তৈরি করে নিয়ে আসি। এবারও আমি নিজের এবং মেয়ের জন্য কাপড় কিনে দর্জির কাছে দিয়ে এসেছি।”
অনেক টেইলরের কণ্ঠে হতাশার সুর শোনা গেলেও কেউ কেউ এতো কাজ পেয়েছেন যে নতুন অর্ডার নিতে পারছেন না।
ভাটারা বাজারের গলির দোকান খুকুমনি টেইলার্সের কর্ণধার রুস্তম আলী বলেন, “ঈদে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়। রমজানের শুরু থেকেই কাজের চাপ কিছুটা সবসময়ই বাড়ে, এবারও বাড়ছে। নির্ধারিত সময়ে পোশাক তৈরি করতে সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করা লাগছে।
“বিভিন্ন দোকানে কারিগররা ওভার টাইম করছে। কাজের ওপর ভিত্তি করে তাদের মজুরিও বেশি হচ্ছে। আমি যেই কাজ পেয়েছি- আর অর্ডার নেওয়া সম্ভব না, আজকে থেকে আর কোনো অর্ডার নেব না।”
অনেকেই শেষ সময়ের ঝুঁকি নিতে চান না বলে কাজের ফরমায়েশ দিয়েছিলেন রোজার শুরুতেই। তারা এখন পছন্দের পোশাক বুঝে নিচ্ছেন।
সুরিটোলার বাসিন্দা লাভলী আক্তার বললেন, “রমজানের শেষ দিকে টেইলার্সে কাজের চাপ থাকে বেশি। তাই আগেই দর্জির কাছে কাজ দিয়েছি, আজকে নিতে আসছি।”
সক্ষমতা থাকায় অনেক টেইলার্স সময় মতো কাজ বুঝে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, নিচ্ছে ফরমায়েশ।
সদরঘাটের কনফিডেন্স টেইলার্সের ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান বলছিলেন, “এবার ঈদে আগের তুলনায় বলা যায় সমান সমান কাজ পেয়েছি। যদিও আগের মত ভিড় নেই আমাদের এখানে।
“আমরা কাজের পরিসর বৃদ্ধি করায় এটা হয়েছে। আশা করি, আগের মতোই ভালো ব্যবসা করতে পারব। তবে কাজ বাড়লে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করব। এখনও অর্ডার নিচ্ছি।”