স্বাধীনতা দিবসে দশমবারের মত অভিযাত্রীর অদম্য পদযাত্রা

আয়োজকরা জানান, এবছর রোজার মধ্যে স্বাধীনতা দিবস পড়ায় পদযাত্রার দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে নৌপথকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 March 2023, 07:49 AM
Updated : 22 March 2023, 07:49 AM

আসছে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে অভিযাত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজন করতে যাচ্ছে ‘শোক থেকে শক্তি: অদম্য পদযাত্রা’।

ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত অদম্য এই পদযাত্রা এবার ১১ বছরে পড়ছে।

মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক সংবাদ সম্মেলনের এবারের আয়োজনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্টজয়ী নারী ও অভিযাত্রী নিশাত মজুমদার, অভিযাত্রী সমন্বয়ক মির্জা জাকারিয়া বেগ উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

আয়োজকরা জানান, এবছর রোজার মধ্যে স্বাধীনতা দিবস পড়ায় পদযাত্রার দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে নৌপথকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

২৬ মার্চ ভোরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় সংগীত গেয়ে শুরু হবে পদযাত্রা। হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে টিএসসি হয়ে পদযাত্রী দল পৌঁছাবে ১৯৭১ সালে ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি-বিজরিত রমনা কালিমন্দির প্রাঙ্গণে। সেখান থেকে পদযাত্রী দল স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াবে শিখা চিরন্তনের পাশে।

সেখানে পদযাত্রী দল কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবে। তারপর ছবির হাটের গেইট দিয়ে বের হয়ে মধুর ক্যান্টিনের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে স্মরণ করবে সেই উত্তাল দিনগুলোকে। সেখান থেকে পদযাত্রী দল অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ হয়ে এগিয়ে যাবে স্মৃতি চিরন্তের পাশে। সেখানে কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে পদযাত্রী দল শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের পাশ দিয়ে নীলক্ষেতে পৌঁছে যাবে।

তারপর সিটি কলেজ, পিলখানা গেট, সাত মসজিদ রোড হয়ে মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে। একাত্তরে সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর আল-বদরের নির্যাতন কেন্দ্র ছিল। অমানুষিক নির্যাতন শেষে বুদ্ধিজীবীদের সেখান থেকে নেওয়া হত রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। নীরবে খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে অভিযাত্রীদল হাঁটতে থাকবে বসিলার উদ্দেশ্যে।

বসিলা ব্রিজের নিচে অপেক্ষমাণ ট্রলারে করে পদযাত্রী দল তুরাগ, বুড়িগঙ্গা হয়ে ৩২ কিলোমিটার ধলেশ্বরী পাড়ি দিয়ে যাবে বংশাই শ্মশান ঘাটে। নদী অতিক্রমের সময় পদযাত্রীদলের মানসপটে ভেসে উঠবে একাত্তরের ঘটনা। সেদিন শরণার্থীরা এভাবেই নৌকায় চেপে পাড়ি দিয়েছিলেন অনিশ্চিতের পথে। শত্রুসেনা নিধনে গেরিলা যোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে রাইফেল কাঁধে পাড়ি দিয়েছেন এমনই পথ।

ঘাটে নেমে গোপীনাথপুর, চারিগ্রাম গ্রামের পথ ধরবে পদযাত্রী দল। পলাশের পাপড়ি ছিটানো পথ অতিক্রম করলেই দৃষ্টিপথে জেগে উঠবে শক্তির সেই উজ্জ্বল শিখর: জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

স্মৃতির মিনারের সামনে নবীন অভিযাত্রী দল দীপ্ত শপথ নেবে। ইফতারের আগেই শেষ হবে সেই আনুষ্ঠানিকতা।

এবছর ঢাকায় শোক থেকে শক্তিঃ অদম্য পদযাত্রা হবে দুই জায়গায়। মিরপুর রূপনগর থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত পদযাত্রা করবে সোহাগ স্বপ্নধরা পাঠশালা। সেখানে মিরপুরের স্থানীয় মানুষ এবং স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই পদযাত্রা সম্পন্ন করবে। 

রুপনগর থেকে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে এই পদযাত্রা শুরু হবে। হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে দুয়ারিপাড়া মেইন রোড দিয়ে শিয়ালবাড়ি মোড় হয়ে কমার্স কলেজ, সনি সিনেমা হল শাহআলী মাজার হয়ে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পৌঁছাবে পদযাত্রী দল। সেখানে শপথ নেবে নতুন প্রজন্মের পদযাত্রীরা।

ঢাকার পাশাপাশি মৌলভীবাজারেও প্রতি বছরের মত পদযাত্রার আয়োজন করেছে মৌলভীবাজার গার্লস গাইড।

স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরে ২০১৩ সালে বিয়াল্লিশ কিলোমিটার পথ হেঁটে একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলো স্মরণ করে অভিযাত্রীরা। ফিরে তাকায় বায়ান্ন থেকে পাড়ি দিয়ে আসা গৌরবের পথগুলোর দিকেও।

সেবার ৭ জন অভিযাত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু করে বাংলার স্বাধীনতা ও স্বাধীকার আন্দোলনের নানা ঐতিহাসিক স্থান স্পর্শ করে, কণ্ঠে মুক্তির গান নিয়ে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত হেঁটে যান। স্মরণ করেন একাত্তরের উত্তাল সেই সময়গুলোকে, যে সময়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা একটি স্বাধীন পতাকার জন্য পাড়ি দিয়েছে কত শত মাইল!

‘শোক থেকে শক্তি: অদম্য পদযাত্রা’ নাম দিয়ে ২০১৩ সালে অভিযাত্রী দল ইতিহাসের পথ ধরে যে পদযাত্রা করেছিল, পরের বছর তাতে অংশগ্রহণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। বছরের পর বছর বাড়তে থাকে পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। ২০১৬ সালে মুক্তিযুক্ত জাদুঘর যুক্ত হয় অদম্য এই পদযাত্রার সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তহবিল সংগ্রহের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য হাঁটি এক মাইল’, ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য, ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটি অদম্য’, এমন স্লোগানে দিনে দিনে পদযাত্রার পরিধি আরও বাড়তে থাকে। যোগ দেয় বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ।

আর বছর বছর পথচিত্র বদলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে কখনও জগন্নাথ হল, ফুলার রোড, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে; কখনো পলাশীর মোড়, পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা মেডিকেলের আমতলা, আজিমপুর হয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমি; কখনো ধানমণ্ডি ৩২, আসাদ গেট, মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জল্লাদখানা বধ্যভূমি, শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের মত ঐতিহাসিক জায়গাগুলো স্পর্শ করে শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে অভিযাত্রীরা।

ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও পৌঁছে গেছে এই পদযাত্রা। ২০১৮ সালে মেহেরপুরে, ২০১৯ সালে জামালপুরে, ২০২১ সালে পাবনার ভাঙ্গুড়া, জামালপুর ও মৌলভীবাজারে এবং ২০২২ সালে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসীরনগরে হয়েছে এই পদযাত্রা।

২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল, এগারো বছরে দশম বার হতে যাচ্ছে ‘শোক থেকে শক্তি: অদম্য পদযাত্রা’। ২০২০ সালে মহামারীর কারণে স্থগিত ছিল এ কর্মসূচি।