কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজিরবিহীন সংঘাতে সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে গুলিবিদ্ধ অনেকে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
Published : 26 Jul 2024, 10:24 PM
২১ জুলাই দুপুর ২টা। নারায়াণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকার একটি ওয়ার্কশপের রং মিস্ত্রী মোহাম্মদ বিপ্লব কাজ শেষ করে বাইরে খেতে বের হয়েছিলেন। খাবার শেষ করে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতেই হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডান পায়ের উরুতে গুলি লাগে বিপ্লবের। তারপর সব অন্ধকার।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে-কাতরাতে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।
১৮ বছর বয়সি বিপ্লবের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর। কাজের জন্য থাকতেন সাইনবোর্ড এলাকায়। তার বাবা মোহাম্মদ রিপন রিকশাচালক। পাশে থাকা রিপন বারবার বলছিলেন, “আমাদের একটাই ছেলে।”
ছেলে আহত হওয়ায় তাকে নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি এখন সংসার কীভাবে চলবে তা নিয়েও কপালে চিন্তার ভাঁজ রিপনের।
চোখের পানি মুছতে-মুছতে রিপন বললেন, “এখন কী হবে আমার?”
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজিরবিহীন সংঘাতে আন্দোলনকারী-পুলিশের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন বিপ্লবের মত আরও অনেকেই।
তাদের অনেকেই আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যন্ত্রণাকাতর কেউ-কেউ কথা বলতেও পারছেন না ঠিকমত।
আহতদের মধ্যে কারও পেটে, কারও পিঠে, কারওবা পায়ে গুলি লেগেছে।
ফেনীর সোনাগাজীর ২৮ বছর বয়সি মিজান হোসেন ঢাকায় গাড়ি চালাতেন। ১৯ জুলাই ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনকারী-পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
ঢামেক হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মিজান। সেখানে তার স্ত্রী প্রিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি গাড়ি চালান। যাত্রী নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, তখন গুলি এসে লাগে তার বুকে। তার কী দোষ ছিল? এর দায় কে নেবে?”
“আমরা গবির মানুষ। সংসার চালানো নিয়ে এখন বিপদে পড়ে গেলাম।”
ঢাকার মুগদা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ রুবেল। ২০ জুলাই গুলিতে আহত হন তিনি।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি ওয়ার্কশপে কাজ করি। ডিউটি শেষ করে সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি পানি নেই। পানি আনতে গেছি। তখন তো লোকাল ফিল্টারের পানি বন্ধ। আসার পথে হঠাৎ গুলি এসে আমার পিঠে ঢুকে যায়। সাথে-সাথে আমি পড়ে যাই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের প্রথম দিক থেকে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংসতায় রূপ নেয়। ২১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত-সংঘর্ষে প্রাণ যায় প্রায় দুইশ মানুষের।
ঢাকার রায়েরবাগে থাকেন ১৮ বছর বয়সি সুজন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি এসে লাগে তার পেটে।
তিনি বলেন, “আমি পেশায় অটোরিকশা চালক। ১৮ জুলাই রায়েরবাগের জোড়খাম্বা এলাকায় আমি যাত্রী নিচ্ছিলাম গাড়িতে। এমন সময় হঠাৎ গুলি এসে লাগে পেটে। আমি পড়ে যাই। যাত্রীরা সবাই দৌড়ে পালায়।”
ঢামেকের ক্যাজুয়ালটি ব্লকের রেজিস্ট্রার মেহেদি আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আহত রোগীদের সাধ্য অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
সংঘর্ষ চলাকালীন আহত এই রোগীদের দেখতে শুক্রবার বিকালে ঢামেক হাসপাতালে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় গুলিতে আহত প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেন।
ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সব ধরনের চিকিৎসা সেবা ও আয়-রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী।
কোটা আন্দোলনের মধ্যে আহতদের খোঁজ নিতে বিকালে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান সরকারপ্রধান। চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন।
আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অত্যন্ত বেদনাদায়ক অবস্থা, আজকে এতগুলো মানুষ আহত-নিহত। এতগুলো মানুষ, আমি তো আমার সব হারিয়েছি, বাবা-মা ভাই সব হারিয়েছি, আমি তো জানি মানুষের হারানোর বেদনা কী? আমার চেয়ে বোধ হয় আর কেউ বেশি জানে না।”
হাই কোর্টের রায়ে পর জুলাইয়ের শুরু থেকে কোটা বাতিলের আন্দোলন শুরু হলেও পরে তা কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে আরও অনেক স্থানে। পরে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরে এক পর্যায়ে তা সহিংসতায় গড়ায়।
আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের মধ্যে এক সপ্তাহে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে দেশজুড়ে কারফিউ শুরু হয়। এখন দিনের বেশিরভাগ সময় কারিফিউ শিথিল থাকলেও বিকাল থেকে সান্ধ্য আইন চলছে।
কোটা আন্দোলনের সুযোগে বিএনপি-জামায়াত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, “এই জামায়াত-শিবির, বিএনপি, ছাত্র দল তারাই এই সুযোগটা নিয়ে, কোটা আন্দোলনের সুযোগটা নিয়ে সারা দেশব্যাপী এই ধ্বংসাত্মক কাজ করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ববোধ নেই, দেশের প্রতি কোনো মায়া-মমতা নেই, দেশের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ নেই। আর মানুষকে এরা মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেমে আহতদের চিকিৎসার প্রয়োজনে সরকার ‘সব করবে’ বলে ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজন, সরকার করে যাচ্ছে এবং করবে। চিকিৎসা শেষে তাদের অন্তত আয় রুজির ব্যবস্থা যাতে হয় সেটাও আমরা করব।
“আমি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি। এখানে দলমত নির্বিশেষে সকলের জন্য আমি কাজ করি। আমি যা করি সব মানুষের জন্য করি। কে আমাকে সমর্থন করে, কে করে না, আমি সেটা চিন্তা করি না। কারণ আমি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী করেছে তাদের সেবা করতে। সেভাবেই আমি সেবা করি।”
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে সরকার পতনের চেষ্টায় সহিংসতা চালিয়েছে;গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ভবন ও পুলিশের সম্পদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ক্রমেই সহিংসতা হয়ে ওঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সর্বাত্মক সমর্থনের ঘোষণা দেয় বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। শাটডাউনের দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। ছাত্রদের ঘোষিত কর্মসূচি না থাকলেও শাটডাউনের পরের কয়েকদিনও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ।