রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি দিবে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে দিবে না- এই অঙ্গীকারটা আমরা দেখি না।”
Published : 04 Nov 2023, 12:35 AM
গেল সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসের এক দিন ছিল হরতাল, তিন দিন ছিল অবরোধ। এই রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে সংঘর্ষ আর গাড়ি পোড়ানোর খবরে শঙ্কিত রোকেয়া আক্তার তার ছেলেকে পড়ার জন্য বাইরে বের হতে দেননি।
রোকেয়াদের বাসা ওয়ারীতে। ছেলে মাহাদি হাসান পড়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণিতে। এ ক্লাসটা পার হলেই নবম শ্রেণি, ফলে সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকাটাও নিতে পারছেন না এই মা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এভাবে তো চলতে পারে না- আমরা এই অনিশ্চয়তার মধ্যে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারি না। করোনার ক্ষতির মত আর কোনো বড় ক্ষতি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় হোক, আমি তা চাই না।”
বেশ কয়েক বছর শান্তিপূর্ণভাবে চলার পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ফের সহিংস হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি; বছর শেষে এই অস্থিরতা স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষা কার্যক্রমে শঙ্কা বাড়াচ্ছে।
নভেম্বরের মধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে উদ্বেগে ভুগছেন অভিভাবকরা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংকট আরও দীর্ঘ হবে কি না, সেই শঙ্কাও তাদের আছে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ চূড়ান্ত রূপ নেয়। সংঘাত শেষে প্রায় ৪ বছর পর আবার হরতাল-অবরোধের চক্রে ঢুকে পড়ে দেশ।
হরতাল-অবরোধে ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন শিক্ষকরা। রাজধানীর স্কুলগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচিতে অনেক স্কুলে শিক্ষার্থী উপস্থিতি নেমে গেছে ৫০ শতাংশের নিচে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিন দিনের অবরোধের মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীরা এলেও অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের পাঠাননি।
মঙ্গলবার এ স্কুলের প্রভাতী শাখায় ৪০ শতাংশ ও দিবা শাখায় ৩০ শতাংশ উপস্থিতি ছিল। বুধবার প্রভাতী শাখায় ৫০ শতাংশ ও দিবা শাখায় ৩৫ শতাংশের মত শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এরই মধ্যে রবি ও সোমবার আবার অবরোধ ডেকেছে বিএনপি। তাতে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে, বুঝে উঠতে পারছেন না এই শিক্ষক।
ফের ধাক্কা?
দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক সহিংসতায় দীর্ঘ সময় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে পারেনি।
কোভিড মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
এবার জানুয়ারির শুরুতে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তাতে শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য এ বছর গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষাবর্ষ শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নভেম্বরের আগেই রাস্তায় রাজনৈতিক বিরোধ ছড়িয়ে পড়ায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন।
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসফিয়া আহমেদ জানাল, হরতাল ও অবরোধের চারদিনই সে স্কুলে যায়নি।
“কয়দিন পরই আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা। এখন ক্লাসটা অনেক ইমপরটেন্ট ছিল। কিন্তু আম্মু যেতে দেয় নাই। বলছে, বাসে আগুন দিচ্ছে, মারামারি হচ্ছে- এসবের মধ্যে পড়ে গেলে কী হবে?”
এই শিক্ষার্থীর মা হুসনেয়ারা বেগম বলেন, “পড়াশুনার চেয়ে জীবন আগে। যে পরিস্থিতি শুরু হল, এখন তো আমরা শঙ্কায় আছি। এখন অনিশ্চিত জীবন শুরু হয়ে গেছে।”
সূত্রাপুরের বাসিন্দা সোনিয়া বেগমের মেয়ে হামিদা আহাম্মেদ শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন চলছে জানিয়ে এই অভিভাবক বলেন, “করোনায় এমনিতেই পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছে ওরা, এমন ঘন ঘন রাজনৈতিক পট পাল্টালে ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ হবার উপক্রম হবে। এমন থমথমে পরিস্থিতিতে ওদের স্কুলে পাঠানো কঠিন।”
ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে থাকা মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন জানাল, মঙ্গলবার মিরপুরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংঘর্ষের কারণে পড়তে যেতে পারেনি সে।
রাজনৈতিক কর্মীরা সংঘর্ষে জড়ালে আরও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ার শঙ্কা জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বললো, “কোচিংয়ে পড়তে যেতে হয়। এমন চললে তো আমাদেরও অনেক ক্ষতি হবে। শুনলাম আমাদের পাশের সিরামিকস রোডে বাসে আগুন দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিষয়েও নেতাদের ভাবা উচিত।”
শিক্ষকরাও অনিশ্চয়তায়
অবরোধে রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজেও শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে যাওয়ার কথা জানালেন ভাইস প্রিন্সিপাল আসমা বেগম। তিনি বললেন, যারা কাছাকাছি থাকে, নিরাপদ মনে করে, তারা এসেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ বের হবে না।
“নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন শেষ করতে পারব কিনা সেটা এখনও বলতে পারছি না। সেটা রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন রয়েছেন। আমার সন্তান হলে আমিও উদ্বেগে থাকতাম।”
রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের শিক্ষক অশ্রজিৎ রায় জানালেন, অবরোধে ক্লাস চললেও শিক্ষার্থী তেমন আসেনি।
“গত কয়েকদিনের যে প্রেক্ষাপট, তাতে শিক্ষার্থীরা আসছে না। আমরা যাচ্ছি। ৫ নভেম্বর থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি ছাড়া সবার পরীক্ষা শুরু হবে।”
তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে শিক্ষাবর্ষ শেষ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
১১ থেকে ২৫ নভেম্বর বার্ষিক পরীক্ষা চলবে জানিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখও বললেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
হরতাল-অবরোধের মধ্যে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের সরাসরি ক্লাস বন্ধ রেখেছে। শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে।
গুলশানের মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অবরোধের মধ্যে অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়েছে। গত সোমবার প্রতিষ্ঠানটি চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জুমে ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়।
শিক্ষাকে রাজনৈতিক বিরোধের বাইরে রাখার তাগিদ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক মতবিরোধ, সমাবেশের অধিকার, এজেন্ডা বাস্তবায়নের কর্মসূচিতে শিক্ষার মত বিষয়গুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়- তা দেখার দায়িত্বও রাজনৈতিক দলগুলোর।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “শ্রীলঙ্কা দীর্ঘদিন এক ধরনের গৃহযুদ্ধের মধ্যে ছিল, কিন্তু সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কখনও বন্ধ হয়নি। নেপালে যখন উগ্রবাদীদের তৎপরতা ছিল, তখন তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ‘সেইফ জোন’ ঘোষণা করেছিল।”
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা হতে পারে- এমন শঙ্কা তৈরি হলেই শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
“অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কারণ যাতায়াত যদি নিরাপদ না থাকে, তাহলে অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক সবাই চিন্তিত থাকবেন।”
এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলানো এই উপদেষ্টা।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেবে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে দেবে না- এই অঙ্গীকারটা আমরা দেখি না। পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতির মধ্যে পড়ে যায় শিক্ষার্থীরা।
“করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষার্থীরা যে হোঁচট খেয়েছে, সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর যখন ক্ষতি পোষানোর জন্য তাদের দৌঁড়ানো প্রয়োজন- তখন শিক্ষার্থীরা আবার হোঁচট খাচ্ছে। এটা কাম্য নয়।”
‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা’
চলমান পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কী ভাবছে?
অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক বেলাল হোসাইন বললেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন তারা।
“এটা তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তখন আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত হবে, সেটা আমরা তাৎক্ষণিক মাঠ পর্যায়ে দিয়ে দেব।”
অনলাইনে কার্যক্রম চলায় আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তিতে কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করছেন তিনি।