কূটনীতিকদের বিবৃতি যতটা না গণতন্ত্রের জন্য তারচেয়ে বেশি ভূরাজনৈতিক: শমসের মবিন

“আমি মনে করি, ৫২ বছর পরে বাংলাদেশের এমন অবস্থানে যাওয়া উচিত, যেখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পড়বে না।”

মাসুম বিল্লাহসৌমিক হাসিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2023, 01:49 PM
Updated : 30 July 2023, 01:49 PM

ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় পশ্চিমা কূটনীতিকদের যৌথ বিবৃতির কারণ যতটা না গণতন্ত্রের প্রত্যাশা, তার চেয়েও বেশি ‘ভূরাজনৈতিক’ বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে তিনি বলেছেন, “এই যৌথ বিবৃতির পেছনে গণতন্ত্র ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশি কিছু দেখছি।

“ভিয়েনা কনভেনশনতো লঙ্ঘন হয়েছেই, ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘনের পাশাপাশি এটার পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণ আছে কি-না, সেটা সরকারের অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।”

গত ১৭ জুলাই ঢাকার অভিজাত এলাকার ওই উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দুদিন পর একযোগে বিবৃতি দেয় ঢাকায় ১২ পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিশন।

বিবৃতিদাতা দেশগুলোর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ইতালি, সুইডেন ও ডেনমার্ক।

ওই মিশনগুলোর প্রধানদের ডেকে ২৬ জুলাই বিবৃতি দেওয়ার ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে সরকার। কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের বিষয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় কূটনীতিকদের।

হামলার ঘটনার পরপর কয়েকজনকে গ্রেপ্তার এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের আশ্বাসের পরও বিবৃতি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলানো শমসের মবিন চৌধুরীও মনে করেন, গ্রেপ্তার, তদন্ত শুরু এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও যৌথ বিবৃতি দেওয়ার ‘কোনো কারণ ছিল না’

ঘটনার ধারাক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, “এরপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবৃতি দেওয়ার কারণ আমি দেখি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন প্রকাশ্য নিশ্চয়তা পাওয়ার পর এমন বিবৃতি ইস্যুর প্রয়োজন ছিল না। এটা অবশ্যই ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ ধারার লঙ্ঘন।”

“সেখানে খুব স্পষ্ট করে বলা আছে, বিদেশি কূটনীতিকদের কোনো দেশে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সেখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নাই।”

বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা শমসের মবিন চৌধুরী ইনসাইড আউটে কূটনীতির পাশাপাশি দেশের সমকালীন রাজনীতি, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি, নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন।

রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই সর্বশেষ পর্বটি।

‘পশ্চিমা দ্বিচারিতা’

পশ্চিমারা বাংলাদেশের মত দেশে প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিষয়ে সক্রিয় হলেও সবক্ষেত্রে সমান প্রতিক্রিয়া দেখায় না বলে মনে করেন শমসের মবিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, “তারা কি এটা সার্বজনীনভাবে ব্যবহার করে, নাকি বেছে বেছে? তারা কি ইসরায়েলের ক্ষেত্রে অ্যাপ্লাই করেছে? করেনি। ইসরায়েলি সরকার আদালতের ক্ষমতা কমিয়ে একটি আইন পাস করেছে। তার মানে নির্বাহী বিভাগ সরাসরি বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ করেছে। যেটা গণতান্ত্রিক চর্চার মৌলিক লঙ্ঘন।

“এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকে, পশ্চিমা বিশ্ব থেকে একটিও প্রতিক্রিয়া নেই। আপনার নীতির দ্বৈততা থাকতে পারে না, আপনাকে সার্বজনীন হতে হবে।”

পশ্চিমাদের বিবৃতি ‘সার্বজনীন না হওয়ার’ কথা তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বলছে বাংলাদেশে তারা ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন চায়; আর সবদেশে বলছে, ‘ভালো’।

“এটা সব দেশের জন্য হতে হবে, আপনি কেবল একটা দেশকে বাছাই করতে পারেন না। তারা কি মিশরে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো নিন্দা বা বিবৃতি দিয়েছে? সেখানে কোনো বিরোধী প্রার্থী ছিল না। একজন ছিল, যে প্রেসিডেন্টেরই আত্মীয়। কারণ, মিশর হচ্ছে কৌশলগত অংশীদার।”

সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “গত ১০-১২ বছরে ভূরাজনীতি প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। সুতরাং এই ১৩ দেশের বিবৃতির পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণ কি-না; কেবল নিন্দার বাইরে অন্য কোনো কারণ তাদের ছিল কি-না এবং তাদের বিবৃতির মূল্যবোধ ও ভূ-রাজনীতির মিশ্রণ কি-না।” 

শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা একটি বৈশ্বিক বিষয়। কেন কেবল কয়েকটি দেশ বিবৃতি দিচ্ছে? ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের ভালো নির্বাচনকারী দেশ কেন বিবৃতি দিচ্ছে না? কেন পশ্চিমা কয়েকটি দেশ বিবৃতি দিচ্ছে?”

‘এখনও কেন বিদেশিদের সনদ লাগবে?’

বাংলাদেশে এখনো আস্থাশীল নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে না পারার বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধ শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধিদলের কার্যক্রমের বিষয়ে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, ৫২ বছর পরে বাংলাদেশের এমন অবস্থানে যাওয়া উচিত, যেখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পড়বে না। আমাদের জনগণের হওয়া উচিত নির্বাচন পর্যবেক্ষক। এটা খুব গণতান্ত্রিক সমাজ।”

গণতান্ত্রিক অধিকার না দেওয়ার কারণেই যে বাঙালি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, সে কথা তুলে ধরে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “এটা ভালো নির্বাচন কি ভালো নির্বাচন না, সেই সনদ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের দিতে হবে কেন?

“সনদ দেবে আমাদের জনগণ, নির্বাচনী ব্যবস্থায় আমাদের জনগণের বিশ্বাস থাকতে হবে, এটাই মূল বিষয়।”

সাবেক এই বিএনপি নেতা বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এলে কী করবে, কতদিনের জন্য পর্যবেক্ষণ করবে এবং পর্যবেক্ষণ করতে না এলে কেন আসবে না- এসব জানতে এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের দল। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কেবল ভোটের দিনের জন্য নয়, ভোটের আগের দিনগুলোও রয়েছে।

‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের’ সম্ভাবনার ওপর ইইউর পর্যবেক্ষক পাঠানো নির্ভর করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যদি পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক না হয়, তারা ভাবতে পারে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে লাভ নেই।”

চীন-রাশিয়ার বিবৃতিও ‘নিয়মের লঙ্ঘন’

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভূমিকার সমালোচনা করে চীন ও রাশিয়ার বিবৃতিকেও ‘আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করেন সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব।

তিনি বলেন, “চীন ও রাশিয়া যেটা করেছে, সেটাও থার্ড কান্ট্রি ল’র লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নীতির বিষয় আমাদের ভিন্নতা থাকে… আমরা আমেরিকা কিংবা জড়িত অন্য দেশের সঙ্গে সরাসরি সমাধা করব।

“রাশিয়া কিংবা চীনের মাধ্যমে এক্ষেত্রে উৎসাহিত হওয়ার প্রয়োজন নাই। তারা যদি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের সঙ্গে ঝগড়া করতে চায় করুক, আমাদেরকে কেন এটার মধ্যে আনবে। এটাও ভূরাজনীতি এবং খুব নেতিবাচক উপায়।”

শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ চীনের, রাশিয়ার ইউরোপের সঙ্গে। তাদের যুদ্ধ তাদেরকে করতে দিন, আমাদের এটার অংশ হওয়া উচিত হবে না।”

নির্বাচন ও রাজনীতি প্রসঙ্গ

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের বিপুল ক্ষমতা থাকলেও তারা সেটা ব্যবহার করতে না পারাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলছেন শমসের মবিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, “আমাদের নির্বাচন কমিশনের প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সেটা তারা ব্যবহার করেনি, এটা কেবল কাগজেকলমে। এটার খুব ক্ষুদ্রাংশ ব্যবহার হয়েছে। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক।”

চাকরি জীবনে ‘মেধা ও সততার’ স্বাক্ষর রাখা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছ থেকে বাড়তি কিছু প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে শমসের মবিন বলেন, “তিনি এবং নির্বাচন কমিশনে তার সহকর্মীদেরকে আরও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে হবে, এটা জনগণকে নির্বাচন কমিশনের উপর আত্মবিশ্বাস দেবে।

“তারা কীভাবে আগামী সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থাপনা করবে, সেটা এখনো জল্পনার মধ্যে রয়েছে। আমরা আশা করি তারা ভালো করুক। আমরা আশা করি ভোট কারচুপি, ভোটাদের ভয় দেখানো ও সহিংসতার ইত্যাদির ক্ষেত্রে তারা তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করবে। আমরা সাবাই শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছি।”

হরতালের মত সংঘাতময় দিকে না গিয়ে সম্প্রতি বিএনপি ‘উদ্ভাবনী’ কর্মসূচি দিতে পেরেছে বলেও মনে করেন দলটির সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “সেখানে বিপুল অংশগ্রহণ তারা দেখিয়েছে। ভোটের দিকে যাবে কি-না, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে।”

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ‘খুব ভালো’ করেছে বলে মনে করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক এই উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, “২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশ্ন থাকার মধ্যেও সরকার খুব সক্রিয় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতালি সফর এটার সর্বশেষ প্রকাশ।”

শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “আমাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগে বিচ্যুতি ঘটেনি। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সবক্ষেত্রে মতবিনিময়ের অব্যাহত প্রবাহ ছিল।”