ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডিও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আবারও বিশ্বমঞ্চে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন।
Published : 28 Feb 2025, 12:13 AM
রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ফের বিশ্বের সামনে তুলে ধরে সমর্থন জোগাড় এবং মাতৃভূমিতে তাদের ফেরাতে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেলন সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস।
তিনি বলেছেন, “আসুন সম্মেলনটিকে সফল করে সংকটের সমাধান করি। আশা করি এটি থেকে কিছু বাস্তবসম্মত ফল আসবে। ভবিষ্যতের একটি সুস্পষ্ট পথ থাকা দরকার। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত।”
ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। সেসময় আলাপে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডিও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আবারও বিশ্বমঞ্চে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
গ্র্যান্ডি বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে জাতিসংঘ সম্মেলন একটি দুর্দান্ত উপায়। এটি রাখাইনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আস্থার পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
আগামী মার্চের মাঝামাঝিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় নতুন গতি সৃষ্টি করবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
গণআন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও বড় পরিসরে সম্পৃক্ত করার কথা বলছে।
এর অংশ হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে ‘সব অংশীজনের সম্মেলন’ আয়োজনের প্রস্তাব দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে লেখা চিঠিতেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবে জাতিসংঘ মহাসচিবকে এ সম্মেলন আয়োজনের আহ্বান সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে কাতারের রাজধানী দোহায় রোহিঙ্গা বিষয়ক ওই সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ওই সম্মেলন আয়োজনে সমর্থন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও বৈঠকে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, “রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে এবং আমরা ওই সম্মেলনকে সমর্থন দিব।”
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বিদেশি সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার আর্থিক সহায়তা সংগ্রহের উপায় নিয়েও আলোচনা হয়।
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে জনগণের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে, যা রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে।
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শিশুদের সার্বজনীন শিক্ষার সুযোগ ও টেকসই আশ্রয় নির্মাণের সুযোগ দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করেন গ্র্যান্ডি।
রোহিঙ্গা ইস্যু ও অগ্রাধিকার বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান ইউএনএইচসিআরের প্রধানকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সম্মেলন সফল করতে বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ ও রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত করেন।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার মুখে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে স্রোতের মত ঢুকতে শুরু করে রোহিঙ্গারা।
কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। যেখানে আগে থেকেই ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও ৪ লাখ।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চির সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও তারা সই করে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার একপর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি রোহিঙ্গারা, ফলে ভেস্তে যায় আলোচনা।
এরপর আসে কোভিড মহামারী; রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগেও ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন ধাক্কা।
এর মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েকবার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আলোচনাতেই কম আসছে।
প্রত্যাবাসনের আলোচনা আপাতত বন্ধ; উল্টো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আরও ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া সব এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখলে চলে যাওয়ার মধ্যে নেপিদোর সঙ্গে যোগাযোগেও ভাটা পড়েছে ঢাকার।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে বিশ্বব্যাপী দেশটির সব উন্নয়ন সহযোগিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত হওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরণপোষণ নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
কেননা, একক দেশ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় দাতা যুক্তরাষ্ট্রই। তবে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জরুরি খাদ্য সহায়তার ক্ষেত্রে অর্থায়ন চালু থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের বরাতে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকা সফরে এসে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও বৈঠক করেন ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
মিয়ানমারে তৈরি হওয়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সূত্র যে ঢাকায় নয়, বরং নেপিদোর কাছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের সঙ্গে একমত হওয়ার কথা বলেন তিনি।
আরও পড়ুন-
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ২০২৫ সালে হবে বিশেষ বৈশ্বিক সম্মেলন
মিয়ানমারে সংঘাত চললেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাগাদা দিতে হবে: ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি