মেয়র আনিসুল হকের সময় কয়েক দফার চেষ্টা দখলমুক্ত করা কারওয়ান বাজার লেভেলক্রসিং থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত সড়কটি আবার ট্রাকের দখলে চলে গেছে।
Published : 05 Mar 2025, 01:35 AM
ঢাকার ব্যস্ততম তেজগাঁও এলাকার সাতরাস্তার মোড় থেকে কারওয়ান বাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত মেয়র আনিসুল হক সড়কে রিকশাসহ অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের জন্য লোহার বেড়া দিয়ে আলাদা লেইন রয়েছে। কিন্তু সে লেইনে রিকশা চলতে পারে না ট্রাক ও পিকআপ রাখার কারণে।
শুধুমাত্র সেই লেইনটিই নয়, দুই পাশে তিনটি করে ছয় লেইনের সড়কটির চারটি লেইন চলে গেছে ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যানের দখলে।
ফলে ১০০ ফুট প্রস্থের সড়কটির ৭০ ফুটে যানবাহন চলতে পারে না। এ কারণে প্রায় ১০ বছর আগেকার যানজটের চেহারা আবার ফিরে এসেছে এ সড়কে।
রিকশার লেইন আলাদা করার যে লোহার বেড়া, তার অস্তিত্ব প্রায় নেই। লেইনটি ঘেঁষে ট্রাকগুলো আড়াআড়িভাবে রাখার কারণে ট্রাকের পেছনের অংশ কোনো কোনো জায়গায় ফুটপাত পর্যন্ত চলে যায়। ফলে রিকশা যেমন চলতে পারে না, তেমনি পথচারীরা হাঁটতে পারেন না।
সে কারণে এখন রিকশা চলে মূল লেইনে, আর ফুটপাতের মানুষও নেমে আসে রাস্তায়। এর মধ্যে কোনো ট্রাক সারি থেকে বের করলে লেগে যায় তীব্র যানজট।
সাতরাস্তার মোড়ের আশপাশের গলিতেও রাখা হচ্ছে ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান। ফলে আশপাশে গড়ে উঠা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি প্রবেশেও বেগ পেতে হয় নিয়মিত।
মঙ্গলবার সরেজমিনে ঘুরে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড ও আশপাশের এলাকায় এমন চিত্র দেখা গেছে।
প্রতিদিন বেগুনবাড়ি থেকে হেঁটে কারওয়ান বাজারে যাওয়ার সময় বিড়ম্বনায় পড়ার কথা বলেন মুদি দোকানি রাসেল সরকার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেগুনবাড়িতে আমার একটা মুদির দোকান আছে, আমি বলতে গেলে প্রতিদিনই কারওয়ান বাজার হেঁটে যাই। রিকশা দিয়ে গেলে কতক্ষণ লাগবে তার তো কোনো হিসাব নাই।
“হেঁটে যাওয়ার সময় ফুটপাত ব্যবহারের কোনো সুযোগ নাই। কারণ দুই পাশে ট্রাক সারি করে রাখা। ট্রাকের পিছনে ফুটপাতে বসে অনেকে নেশা করে, আমার পকেটে মালামাল কেনার টাকা থাকে। তাই ফুটপাত দিয়ে হাঁটি না।
“তাও দিনের বেলায় তো রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করা যায় সন্ধ্যার পরে আর চলার অবস্থা থাকে না।”
তেজগাঁও শিল্প এলাকার কাছাকাছি ঢাকার বৃহত্তম পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারের অবস্থান হওয়ায় কয়েক দশক ধরে এ এলাকায় সারা দেশ থেকে কাভার্ড ভ্যান, কার্গো ট্রাক, পিকআপসহ ভারী যানবাহন আসছে।
এসব যানবাহন রাখার জন্য নির্দিষ্ট কোনো টার্মিনাল না থাকায় কারওয়ান বাজার লেভেল ক্রসিং থেকে সাতরাস্তা মোড়, বেগুনবাড়ি ও আশপাশ এলাকার সড়ক দখল করে গাড়ি রাখতে শুরু করেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেন বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ অভিযান, রিকশা স্ট্যান্ড করাসহ নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও ট্রাক সরাতে পারেনি। যানজটের ভোগান্তি ছিল নিত্যদিন।
এছাড়া ট্রাকস্ট্যান্ড ঘিরে মাদকদ্রব্যের কারবার, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্মের কারণে ওই এলাকায় সন্ধ্যার পর চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এ পরিস্থিতিতে আনিসুল হক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার পর ২০১৫ সালে কয়েক দফা তেজগাঁওয়ে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের উদ্যোগ নেন।
সে সময় ট্রাক শ্রমিকরা সিটি করপোরেশনের কর্মীদের সঙ্গে সংঘাতেও জড়িয়েছিলেন।
পরিবহন শ্রমিকদের বাধা দূর করে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ ও সড়ক যানবাহন চলাচলের উপযুক্ত করে তোলেন মেয়র আনিসুল হক।
তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত সড়কটি ২০১৮ সালের জুনে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের নামে নামকরণ করে উত্তর সিটি করপোরেশন।
কিন্তু এরপর আবার সড়কটি পুরোনো চেহারায় ফিরতে শুরু করে। আতিকুল ইসলাম মেয়র হওয়ার পর কয়েক দফা চেষ্টা করেও সেখানে শৃঙ্খলা আনতে পারেননি।
রাজধানী শহরের মাঝখানে গড়ে ওঠা এক সময়ের এ শিল্পাঞ্চলে বহুতল ট্রাক টার্মিনাল করার জন্য তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ একরের বেশি জমি দেন।
গত বছর জুলাইয়ের মধ্যে টার্মিনালের কাজ শুরুর লক্ষ্য ধরে পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, তেজগাঁওয়ে বিটিআরসির ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অব্যবহৃত জায়গা পেতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিল ডিএনসিসি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে ওই জমি পাওয়া গেছে।
এর আগে ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শিল্প-বাণিজ্য-আবাসিক এলাকা হিসেবে স্বতন্ত্র তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তেজগাঁও বহুতল ট্রাক টার্মিনালের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া জায়গা বরাদ্দের অনুমোদন বাতিল করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
যদিও জায়গাটি ফিরে পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন সদ্য দায়িত্ব নেওয়া উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই জায়গাটি ফিরে পেতে আমরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিব। আশা করি জায়গা খুব দ্রুতই পেয়ে যাবো। জায়গা পেলে আমরা কাজ করতে পারবো।
“ট্রাকস্ট্যান্ডের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। এখানে ট্রাকগুলো পার্কিং করার জন্য পাঁচ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এটি গণপূর্তের জায়গা। জায়গা পেলে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।”
স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিববহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা মিলেছে তাতে প্রতিদিন কারওয়ানবাজার লেভেলক্রসিং থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত সড়কে পাঁচ থেকে ছয়হাজার যানবাহন চলাচল করে।
এ সড়কে চলাচল করা যানবাহনের মধ্যে যেমন কারওয়ান বাজারের আড়তে মালামাল আনা ট্রাক আছে, তেমনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামসহ ৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের যানবাহন রয়েছে।
এ সড়কে রয়েছে লেগুনা ও রিকশা স্ট্যান্ডও।
অবৈধভাবে রাস্তার দখলের বিষয়ে ট্রাক চালক রাশিদুল হাসান দাবি করেন, এছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকায় আটটি ট্রাক স্ট্যান্ড রয়েছে, যার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। এখানে ট্রাক রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। সে জন্য মালিকরা বলেন রাস্তায় রাখতে। আমরা বাধ্য হয়ে রাস্তার ওপর রাখি।”
বছর খানেক আগে এ এলাকায় গাড়ি পার্কিং না করতে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালায় সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযানের কয়েক ঘণ্টা পরই আবার দখল নেন ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা।
কোনো অভিযান সফল না হওয়ায় একসময় এ এলাকায় রিকশাস্ট্যান্ড করেছিলেন মেয়র আনিসুল হক। তিনি মারা যাওয়ার পর ফের এটি ট্রাকস্ট্যান্ডে পরিণত হয়।
মেয়র হওয়ার পর আতিকুল ইসলাম ট্রাকস্ট্যান্ড সরাতে নতুন উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। উল্টো ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। বদল হয়েছে ট্রাক স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ ও মালিক-শ্রমিকদের নেতৃত্বও।
ওই সড়কে চলাচল করা কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তার দুই পাশের বেশির ভাগ জায়গা দুই-তিন সারি করে ট্রাক রাখায় রাত নামলে ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা তৎপর হয়ে ওঠে।
এছাড়া এসব পরিবহনের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
এই সড়কের উপরেই বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে ট্রাকগুলো এমনভাবে রাখা যে আরেকটা গাড়ি আমাদের অফিসে ঢুকতে বা বের হতে অনেক সময় লেগে যায়। কারণ এই রাস্তায় এক লেইনের হয়ে গেছে। এক লেইনের রাস্তায় গাড়ি ঘুরানো কঠিন। আর আমাদের ড্রাইভাররা নীরবে সহ্য করেন, কারণ ট্রাক ড্রাইভারদের সাথে তো আর কথা বলার সুযোগ নাই। তারা যা বলে এখানে তাই সঠিক।”
এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড এর কর্মকর্তা মাসুম শিকদার বলেন, “শ্রমিকরা ট্রাকগুলো রেখে যায়। সরাতে বললেও শোনেন না, বেশি কিছু বলাও যায় না। ট্রাক সরাতে বললে তারা বাজে ব্যবহার করে।”
কফিল উদ্দিন নামের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের এক কর্মচারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের হাঁটার জায়গা কোথায়? রাস্তার পাশের ফুটপাতও দখল করে নিয়েছে। পুরো রাস্তাই তো ট্রাকের দখলে, কার কি আসে যায়। দেশ যেমন চলছে আরকি। ট্রাকচালকদের সঙ্গে কথা বলা মুশকিল।”
সোমবার রাতে খুলনা থেকে মাছ নিয়ে এসে কারওয়ান বাজার আড়তে নামিয়ে দিয়ে ট্রাক রাখা হয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন কার্যালয়ের উল্টো পাশের সড়কে।
সে ট্রাকের চালকের সহকারী আনাছ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের তো এখানেই জায়গা দেওয়া। আর রাখার জায়গা তো নাই।”
বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির কার্যালয়ের কর্মচারিরা বলেন, মালিক পক্ষের লোকজন সিদ্ধান্ত নেন গাড়ি কোথায় থাকবে, কখন বের হবে, কখন ঢুকবে। ট্রাক স্ট্যান্ডের পাশেই মালিকদের কার্যালয় রয়েছে।
সরকার জায়গা বরাদ্দ দিলে চলে যাবে জানিয়ে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে পাঁচ হাজার ট্রাক থাকে। আমরা তো সরকারের সব কর দিয়েই থাকি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় জায়গা দিবে, দিলে তো আমরা চলে যাই। সরকার জায়গা দিলে তো আমরা খুশি। আমরা বাধ্য হয়ে এখানে গাড়ি রাখি। জায়গা দিলে আমরা রাস্তায় থাকবো কেন? আমরা তো রাস্তায় থাকতে চাই না।
“আগে রাস্তার দুই পার্শে চার লেনে ট্রাক রাখা হতো এখন দুই লেইনে রখা হয়। গাড়ি তো এখন যেতে পারে।”
যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের উপ পুলিশ কমিমনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “এখানে ট্রাক মালিক সমিতির ও ট্রাক শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আমরা নিয়মিতিই যোগাযোগ রাখি। তবে ট্রাক মালিক বা শ্রমিক নেতাদের সাথে ফরমালি বৈঠক করা এখনও হয়নি।
“রাস্তা যাতে কোনো কারণে ব্লক না হয়, আর কোনো গাড়ির কারণে রাস্তা বন্ধ হলে বা গাড়ি নষ্ট হলে দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা করি। যাতে করে মানুষের কোনো ভোগান্তি না হয় সেই ব্যপারে আমরা যথেষ্ট সতর্ক অবস্থা আছি।”
তিনি বলেন, “আমাদের ট্রাফিক সদস্যরা রোজা উপলক্ষে তেজগাঁও এলাকায় যথেষ্ট তৎপর আছে, এমনকি আমি নিজেও বিশেষ করে বিকালে এই এলাকায় অন ডিউটিতে থাকি। ট্রাকগুলোর কারণে যাতে কোনো যানজট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখি।”
পুরোনো খবর:
দখল ঠেকাতে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের সড়কে রিকশার লেইন