“পুরুষদের অনেক কাজই সমাজে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু একই কাজ নারীদের ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য ও মারাত্মক নেতিবাচক বলে মনে করা হয়।”
Published : 07 Mar 2024, 10:26 PM
‘মেয়ে সুবিধার না, ঝামেলা আছে, চরিত্র ভালো না’— খোঁচা মেরে পরিচিতজনদের এমন কথা হরহামেশাই শুনতে হয় বাংলাদেশের সংসারভাঙা মেয়েদের।
আড়চোখে কটাক্ষ কিংবা সরাসরি আক্রমণাত্মক কথাও গলাধঃকরণ করতে অভ্যস্ত হতে হয় তাদের। আর দ্বিতীয়বার বিয়ের বেলায় আক্রমণ হয় আরো বেশি ধারালো, আরো বেশি বিষাক্ত।
এক্ষেত্রে পুরুষদেরও যে বক্রোক্তি সইতে হয় না- তা নয়। কিন্তু নারীদের বেলায় সমাজ একটু বেশিই নির্দয়।
বিয়ের পর দুজনের মানসিক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক চাপ, নির্যাতন কিংবা স্বামী সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে বিয়ে করে প্রতারিত হওয়ার ঘটনাগুলোতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন নারীরা। একসময় বাধ্য হয়ে প্রথম সম্পর্কের ইতি টানেন।
কিন্তু মা-বাবার সংসারে ফিরে শুনতে হয় নানা কটূকথা। ফের বিয়ে করতে চাপ দেয় পরিবার। যেন স্বামীর সংসার ছেড়ে আসাটা কলঙ্ক, সেটি ঢাকতেই তোড়জোর শুরু হয়।
প্রথম বিয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে বেশ সাবধানী থাকেন নারীরা। বিয়ে করতেও অনেক সময় ভয় পান, অন্যদের আচরণে মানসিকভাবে পড়েন ভেঙে। সামাজিক নেতিবাচক ধারণার ব্যাড়াজালে আচ্ছন্ন থাকতে হয় তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান রীমা (ছদ্মনাম)। কিছুদিন তার সঙ্গে চলার পর বোঝাপড়া ভালো না হওয়ায় বিয়ের ইচ্ছাটা তেমন ছিল না। কিন্তু বিয়ের জন্য পরিবারের চাপাচাপিতে ২০১৮ সালে ওই ব্যক্তিকেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এই শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে ডটকমকে বলেন, “বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারি সে জুয়ায় আসক্ত। ছোট ছোট বিষয় নিয়েও তার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলাম। এমন হতে পারে ভেবেই প্রথম দিকে তাকে বিয়ে করতে সংশয়ে ছিলাম।”
রীমা জানান, নিপীড়ন সইতে না পেরে বিয়ের এক বছরের মধ্যে সংসার ছেড়ে মা-বাবার কাছে চলে যান তিনি।
ডিভোর্সের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “পরিবারের লোকজনের কাছ থেকেই নানারকম বাজে মন্তব্য শুনতে হত। এমন সময়ে এক বন্ধু আমার পাশে ছিল, যে বর্তমানে আমার স্বামী।”
২০২১ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন রীমা। পরিবার বা বন্ধুমহল সবার কাছ থেকেই তখন নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। দ্বিতীয় স্বামীর পরিবার থেকেও প্রথমে কারো সম্মতি ছিল না।
“আমার অনেক কাছের বন্ধুদেরও বলতে শুনেছি, ছেলের টাকার জন্যই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া কেউ কেউ বলেছে, চরিত্র ভালো নয় বলেই নিজে ডিভোর্সি হয়েও একজন অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করছি।”
প্রথম স্বামীর সংসার ছেড়ে আসার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে যে ছেলেটা পাশে দাঁড়ান, তার সঙ্গে বোঝাপড়া ভালো হওয়ায় এবং সবকিছু সে জেনেবুঝে বিয়ে করতে চাওয়ায় সম্মতি দেন রীমা।
তার ভাষ্য, “বিচ্ছেদের পর পরিবারের অনেকেই আমার চরিত্র নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। পরকীয়া ছিল এমন সন্দেহও করেন অনেকে। দ্বিতীয়বার বিয়ের আগেও চরিত্র নিয়ে অনেক কুকথা শুনেছি। দ্বিতীয় বিয়ের পর নতুন পরিবারেও অনেক আত্মীয় বলেছিলেন- ধৈর্য নিয়ে এই সংসার করতে পারব কিনা!”
দ্বিতীয় বিয়েতেও প্রতারণা
প্রথম বিয়ে ভাঙার পর দ্বিতীয়বার জেনে-বুঝে বিয়ের পথে এগোলোও সেখানেও প্রতারণার শিকার হন অনেক নারী।
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বা আইনগতভাবে বিচ্ছেদ না করে আবার বিয়ে করলে সেই বিয়ে অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল বলে গণ্য হবে। দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে আগের বিয়ের তথ্য গোপন করাও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য অপরাধ। এর সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড।
দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন- ঢাকায় বসবাসকারী এমন এক নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্বিতীয় বিয়ের আগে সকল নিয়মই আমি জানতাম। তবে যাকে আবার বিয়ে করেছিলাম, সে নিকাহনামায় ডিভোর্সি উল্লেখ না করে প্রথম বিবাহ লিখতে চাপ দিয়েছিল। তাকে বিশ্বাস করে আমিও নিকাহনামায় ‘প্রথম বিবাহ’ লিখি।
“পরে সে আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে এটিকে ‘প্রতারণা’ বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।”
দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ নারীরা যেমন জটিলতায় পড়েন, তেমনি সমাজের পরিচিত বা তারকা নারীরা পড়েন একই সমস্যায়। তাদের হয়ত সেই প্রতিকূলতা পার হয়ে আসার সক্ষমতা থাকে বেশি। পরিচিত মুখগুলোর বেলায় সবথেকে বেশি কটূকথা শুনতে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বিচ্ছেদের পর বিয়ের পিঁড়িতে কজন?
দেশে বিয়ে আর বিচ্ছেদের তথ্য বাংলাদশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতির কাছে পাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের কাছে বিচ্ছেদ হওয়া নারীদের দ্বিতীয় বিয়ের হিসাব নেই।
সমিতির ঢাকা উত্তরের প্রচার সম্পাদক মাহমুদ রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিচ্ছেদ হওয়া নারীদের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে স্পষ্ট কোনো পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও ডিভোর্সি নারীদের বিয়ে করার সময় কাবিননামায় তালাকপ্রাপ্তা বলে উল্লেখ করতে হয়।
নিকাহনামায় প্রথম বিবাহ, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত উল্লেখ করার স্থান থাকে। একজন নারীকে দ্বিতীয়বার বিয়ের আগে অবশ্যই ডিভোর্সি হলে তা নিকাহনামায় উল্লেখ করতে হবে। এছাড়া বিচ্ছেদের সকল কাগজপত্রও কাজী অফিসে জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে কত সংখ্যক ডিভোর্সি নারীর বিয়ে হয়, তা আলাদা করে নথিভুক্ত করা হয় না।
মাহমুদ রেজা বলেন, “শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ২২০টি কাজী অফিস রয়েছে। সেই সব কাজী অফিস থেকে কত বিয়ে ও তালাক হয়েছে, সে হিসাব আমাদের কাছে পাঠানো হয়। তালাকপ্রাপ্তাদের বিয়ের পরিসংখ্যান পাঠানো হয় না এবং আপনার আগে কেউ এ নিয়ে তথ্যও চাননি।”
ঢাকার দুই সিটির করপোরেশেনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে ঢাকা শহরে ১৩ হাজার ২৮৮টি বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙেছে।
মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতি নেতা মাহমুদ রেজা বলেন, “এটা নিশ্চিত করেই অনুমান করা যায়, দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ যেমন বাড়ছে, দ্বিতীয় বিয়ের সংখ্যাও বাড়ছে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা, বছরে ‘৩০ শতাংশের’ মত ডিভোর্সি নারীর দ্বিতীয় বিয়ে হচ্ছে। এর মধ্যে ‘১০ শতাংশ’ নারীর সঙ্গে অবিবাহিত পুরুষের বিয়ে হচ্ছে।”
রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার কাজী অফিস ঘুরেও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের বিয়ের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান মেলেনি।
নথিপত্রের হিসাব না দিলেও মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ১০ নম্বর এলাকার কাজী অফিসের অফিস সহকারী শাহাদাত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বছর শেষে একটি হিসাব আমরা জেলা রেজিস্ট্রার অফিসে জমা দিয়ে থাকি। তাই এখন সঠিক হিসাব দেওয়া কঠিন হবে।
“তবে আমাদের তিনটি অফিসে বছরে প্রায় ‘১৫ শতাংশ’ নারীর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এর মধ্যে বিধবা নারীদের বিবাহের সংখ্যাও ধরা হয়।”
দ্বিতীয় বিয়েতে ‘সাবধানতা’
বিচ্ছেদের প্রায় ৮ বছর পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শশী (ছদ্মনাম)।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অল্প বয়সেই বিচ্ছেদ হয়েছিল। আবার বিয়ের জন্য পরিবারের চাপও ছিল। কিন্তু দেশে থাকতে আমি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতাম। আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। তাই সময় নিয়ে মনের মত সঙ্গী পাওয়ার পরেই বিয়ে করেছি।”
ফারহানা ছদ্মনামে আরেক নারী বলেন, তার ডিভোর্সের এক বছরের মধ্যেই বিয়ে করতে বাধ্য হন। তার ভাষ্য, “তখন বাবা অসুস্থ ছিল, আর আমার চাকরির চুক্তিও প্রায় শেষের দিকে ছিল।”
নারীর দ্বিতীয় বিয়েকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার পেছনে ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতা কাঠামোকে’ কারণ মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তানিয়া হক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পুরুষদের অনেক কাজই সমাজে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু একই কাজ নারীদের ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য ও মারাত্মক নেতিবাচক বলে মনে করা হয়।
“বিচ্ছেদের পর নারীদের দ্বিতীয়বার বিয়ের সংখ্যা আগের থেকে বাড়লেও সমালোচনা কমেনি। পরিবারের অনেকে মুখে কিছু না বললেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আসলে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কটাক্ষ ও বিরোধিতার পরেও ডিভোর্সি নারীদের দ্বিতীয়বার বিয়ে করা সংখ্যা বেড়েছে।”
মানসিক চাপ
দ্বিতীয় বিয়ের আগে ও পরে একজন নারী নানারকম মানসিক দ্বন্দ্বে থাকে বলে জানান সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সেলর নাদিয়া নাসরিন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে তিনি বলেন, “বিয়ের আগে যেহেতু পরিবার ও সমাজ থেকেই সমালোচনা বেশি হয়, তাই অনেক নারী নিজেকে একা মনে করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান, অনেকে আবার নেনও না। ফলে মারাত্মক বিষণ্নতায় ভোগা নারীরা মানসিক সেবার জন্য আসেন।
“এছাড়া অনেক নারী বিয়ের পর নতুন পরিবারেও যথাযথ সম্মান পান না, যা তার মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাসের হিসাবে প্রায় ১০ শতাংশ নারী এমন ধরনের মানসিক কষ্ট নিয়ে আসেন আমার কাছে।”
নারীর দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে ২০১১ সালে একটি গবেষণা হয়েছিল। কাজী নাদিরা পারভেজের ‘সোশ্যাল চেইঞ্জেস অ্যান্ড উইমেন-ইনিশিয়েটেড ডিভোর্স ইন ঢাকা, বাংলাদেশ: গেইনিংস অর লুজিং পাওয়া’ শীর্ষক গবেষণাটি প্রকাশ করে নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব বার্গেনের মনোনিজ্ঞান অনুষদ।
সেখানে অংশ নেওয়া তালাকপ্রাপ্ত ১১ নারীর মধ্যে ১০ জন কর্মজীবী এবং একজন ছিলেন গৃহিনী। গবেষণায় দেখা যায়, বিচ্ছেদ হওয়া নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে নানা রকম দ্বন্দ্ব কাজ করছে।
তারা সঙ্গীর বিশ্বস্ততা ও সঙ্গীর কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারবেন কিনা, এ নিয়েও সংশয়ে ভোগেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া ১১ নারীর মধ্য থেকে কেউ কেউ যোগ্য ও নির্ভরযোগ্য সঙ্গী পেলে বিয়ের ইচ্ছার কথাও বলেন।