সারা দেশে বিভিন্ন মন্দিরের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঐতিহ্যগতভাবে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয় প্রতিবছর। প্রতি বছর ঢাকায় সবচেয়ে বড় পরিসরে সরস্বতী পূজার আয়োজন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে।
Published : 14 Feb 2024, 03:36 PM
মানুষ যাতে সত্য, সুন্দর ও জ্ঞানের আলোয় পরিশীলিত জীবনাচরণে অভ্যস্ত হয়, বিদ্যার দেবী সরস্বতীর কাছে সেই প্রার্থনাই জানালেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। মুখস্থনির্ভর জ্ঞানের পরিবর্তে সৃজনশীল ও পরিশীলিত বিদ্যা-বুদ্ধির প্রার্থনা ছিল তাদের।
বুধবার সকাল থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে বাণী অর্চনা, আরতি ও ভক্তদের পুষ্পাঞ্জলিতে সিক্ত হন ‘বীণাপাণি’।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দেবী সরস্বতী সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানালোকের প্রতীক। দেবীর একহাতে পুস্তক, আর অন্য হাতে বীণা। এজন্য তাকে ‘বীণাপাণি’ও বলা হয়। তার বাহন সাদা রাজহাঁস।
মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সাদা রাজহাঁসে চেপে দেবী ধরায় আসেন। মর্ত্যলোকে ভক্তরা অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতে কল্যাণময়ী দেবীর চরণে পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করেন।
সারা দেশে বিভিন্ন মন্দিরের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঐতিহ্যগতভাবে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয় প্রতিবছর। প্রতি বছর ঢাকায় সবচেয়ে বড় পরিসরে সরস্বতী পূজার আয়োজন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে।
বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর কৃপা-লাভের আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ হল মাঠে তৈরি আলাদা আলাদা পূজামণ্ডপ তৈরি করেন। বিভিন্ন থিমের আলোকে এবার সেখানে ৭২টি পূজার মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে। অন্য বছরের মত এবারও এ হলের পুকুরে বসানোর জন্য দৃষ্টিনন্দন প্রতিমা তৈরি করেছে চারুকলা অনুষদ।
জগন্নাথ হলে সকাল ৯টায় বাণী অর্চনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় পূজা। পুরোহিত ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমল লোচনে/বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যংদেহী নমোহস্তুতে’ মন্ত্রপাঠ করে দেবীর আশীর্বাদ কামনা করেন। এরপর ভক্তরা দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষ সেখানে সরস্বতীর আরাধনা করেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরাও।
ঢাকার বনশ্রী থেকে ছেলে ঔম সরকারকে হাতেখড়ি দিতে জগন্নাথ হলে আসেন বনমালি সরকার।
তিনি বলেন, “আমার সন্তান যেন বিদ্যা-বুদ্ধিতে মানুষের মতো মানুষ হয়, সেই প্রার্থনা করেছি দেবী সরস্বতীর কাছে। যে জ্ঞান মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে, দেশের জন্য কাজ করতে পারে, সেই জ্ঞানের প্রার্থনা করেছি।”
মিরপুর থেকে মেয়ে রৌদ্দুর রায়কে জগন্নাথ হলে এসে হাতেখড়ি দেন সত্যজিৎ রায়।
তিনি বলেন, “মা সরস্বতীর কাছে প্রার্থনা করছি, আমার মেয়ে যেন বিদ্যা-বুদ্ধিতে মানুষের মতো মানুষ হয়।
জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ও পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরস্বতী পূজায় আমরা সব সময়ই বিদ্যা দেবীর কাছে বিদ্যা অর্জনের প্রার্থনা করি। সেই বিদ্যাটা হবে পরিশীলিত বিদ্যা, অসাড় বিদ্যা নয়, যেটা বিশ্বের কাজে লাগবে।
“বিশ্বে নতুন আঙ্গিকে যে ডিজিটাল ব্যবস্থা আসছে, সেই জায়গা থেকে বিদ্যাটাও যেন সেভাবে অর্জন করতে পারি। আমাদের শিক্ষার্থীদের যাতে সেই রকম বিদ্যা আমাদেরকে তিনি দেন। বাংলাদেশকে বিশ্বের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য যে জ্ঞান দরকার, সেই বিদ্যা যেন আমরা লাভ করতে পারি।”
‘মিডিয়া হল মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’
মণ্ডপের চূড়ায় শিকলবদ্ধ কলম; নিচে প্রতীকী গণমাধ্যম। উপরে লেখা ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’। আবার মণ্ডপের মাঝে লেখা হয়েছে ‘মেধা=এমসিকিউ?’, বিদ্যা দেবীর পায়ের নিচে ধুলোয় মলিন হয়ে পড়ে আছে ধ্রপদী কিছু সাহিত্যের বই। দেবী সরস্বতীকে ঘিরে ধরেছে আছে এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নামক লেখা ফিতা।
বুধবার জগন্নাথ হলের মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পূজা মণ্ডপের এ দৃশ্য দেখা যায়।
শিক্ষার্থীরা জানান, সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে সিনেমার ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’ ধারনার আলোকে এবার মণ্ডপের থিম সাজানো হয়েছে। যেখানে মিডিয়াকে বলা হয়েছে ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’।
বিভাগের শিক্ষার্থী প্রান্ত দত্ত বলেন, “এটাকে আমরা আইডিয়োলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস হিসেবে ধরেছি। একটা ক্ষমতাসীন শ্রেণি যখন সাধারণ মানুষকে শাসন করতে চায়, তখন তারা এমন কিছু টুলস বেছে নেয়, যেগুলো প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষকে মগজধেলাই করা হয়। মিডিয়া হলো সেই ধরনের একটা টুল।
“আজকে সত্য-ন্যায়ের কলম শিকলবদ্ধ। ক্ষমতাসীনরা যা প্রচার করছে, মানুষ তা গিলে খাচ্ছে। মিডিয়াকে তারা মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।”
সরস্বতীর পায়ের নিচে কেন ধ্রুপদী সাহিত্য ধুলোয় মলিন হয়ে পড়ে আছে, এমন প্রশ্নে প্রান্ত দত্ত বলেন, “আজকে মুখস্ত নির্ভর এমসিকিউভিত্তিক যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেটাকে আমরা তুলে ধরেছি। আজকে শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর বিসিএসের গাইড বই নিয়ে ব্যস্ত। অথচ ক্লাসিক্যাল যে সাহিত্য, তা নোংরা অবস্থায় পড়ে আছে। আমাদের প্রশ্ন মেধা কি শুধু এমসিকিউ?
“এআই এসে পেছিয়ে দিয়েছে সৃজনশীলতার রূপ সরস্বতীকে। এখন আমরা মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সেই বিষয়টাও তুলে ধরেছি।”
জবিতে ৩৬ মণ্ডপে পূজা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৬টি মণ্ডপে সরস্বতী পূজা উদযাপন করা হয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজেও পূজা উদযাপিত হয়েছে।
বিভিন্ন বিভাগের মণ্ডপগুলোর সাজসজ্জায় স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি বিভাগ তাদের পঠিত বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে পূজা মণ্ডপ সাজিয়েছে।
গণিত বিভাগ তাদের মণ্ডপের আলপনায় বিভিন্ন গাণিতিক সংকেত দিয়েছে। আবার প্রতিবছরের মতো চারুকলা বিভাগ প্রতিমায় নিয়ে এসেছে ভিন্নতা। ‘বীণাপাণি’ হাতে দেবীকে খুবই সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করেছে তারা। নাট্যকলা বিভাগে নারী পুরোহিতের মাধ্যমে পূজা অর্চনা করা হয়েছে।
বুধবার সকালে বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বন্দনায় ঢাকঢোল, কাঁসর, শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস।
বাণী অর্চনা শেষে উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর চৌধুরী সব পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোস্তফা কামালসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
পরে উপাচার্যের সম্মেলনকক্ষে একটি আলোচনা সভা হয়।
অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী রুদ্র সরকার বলেন, “আমরা দুপুরের দিকে অঞ্জলি নিয়েছি। মাত্রই প্রসাদ খাওয়া শেষ করলাম। বিদ্যাদেবী যেন আমাদের আশীর্বাদ দিয়ে যান।”
শাঁখারীবাজার থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা রতন বৈদ্য বলেন, “একসাথে অনেকগুলো পূজা হওয়ার কারণে আমরা প্রতিবছর এখানে ঘুরতে আসি। খুব ভালো লাগছে সবগুলো পূজা দেখে। বিকালের দিকে জগন্নাথ হলের পূজা দেখে আসব।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ মন্ডল বলেন, “খুব সুশৃঙ্খলভাবে আমরা পূজা উদযাপন করতে পেরেছি।”