“আওয়ামী লীগকে তো অ্যাভয়েড করা যাচ্ছে না, কারণ তাদেরই একটা বড় অংশ সংখ্যায়, মূলত আমরা তাদের তরফ থেকে হুমকি পাচ্ছি।”
Published : 12 Feb 2025, 03:57 PM
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ঘটনায়, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে ‘হুমকি দেওয়া হচ্ছে’।
এই অভিযোগ তুলে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের’ কাছ থেকে তারা বিভিন্ন ধরনের ‘হুমকি’ পাচ্ছেন।
বুধবার রাজধানীর মহাখালীতে রাওয়া ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেছেন পিলখানায় প্রাণ হারানো সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত সেনা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ওই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, বিডিআর হত্যা মামলায় যারা দণ্ডপ্রাপ্ত তাদের মুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন তারা।
তবে বিস্ফোরক মামলা বা হত্যা মামলায় যারা দণ্ড পাননি তাদের জামিন বা মুক্তির বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের কোন মন্তব্য নেই বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, পিলখানায় প্রাণ হারানো কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী নাহরীন ফেরদৌস।
তিনি বলেন, “বিগত ২৯ জানুয়ারি প্রেস কনফারেন্সের পরে আমরা শহীদ পরিবারবর্গ দাবি করেছিলাম যেন ন্যায় বিচারের স্বার্থে হত্যা মামলার আসামিদের আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে মুক্তি দিয়ে দেওয়া না হয়। এরপর থেকে আমরা, আমাদের সদস্যরা কিছু মহল থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আমি একটি বিষয় জোর দিয়ে বলতে চাই, শহীদ অফিসারদের স্ত্রী অথবা সন্তানদের উপর যে কোন ধরনের আঘাত কিংবা তাদের সম্পর্কে ভুল বা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য বা বক্তব্য দিলে আমরা এই শহীদ সেনা অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন তার প্রতিবাদ জানাব এবং আইনের সহযোগিতা নিতে বাধ্য হব।”
পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে জানতে চাওয়া হয় কারা এই হুমকি দিচ্ছে?।
নিহত কর্নেল কুদরত এলাহির ছেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও আইনজীবী সাকিব রহমান বলেন, “হুমকির বিষয়টা সেভাবে আমরা আনতে চাই না। যে কোন কারণেই হোক না কেন আমাদের স্টেটমেন্টকে ভুল বোঝা হয়েছে। বিশেষ করে যখন আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করেছি, সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রয়েছে।
“আওয়ামী লীগকে তো অ্যাভয়েড করা যাচ্ছে না, কারণ তাদেরই একটা বড় অংশ সংখ্যায়। তারা এখন তৎপর না হলেও অনলাইনে অনেক তৎপরতা আছে তাদের। মূলত আমরা তাদের তরফ থেকে হুমকি পাচ্ছি।”
তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কারা তাদের হুমকি দিচ্ছে তা স্পষ্ট করেননি এই শিক্ষক।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়।
এছাড়া সরকার পতনের পর গত বছরে বিডিআর সদরদপ্তরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা পড়েছে।
মমালায় ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বিষয়ে সরকারের কাছে নিশ্চয়তা প্রত্যাশা করেছেন নাহরীন ফেরদৌস।
তিনি বলেন, “জেলের ভেতর যে সমস্ত বিডিআর সদস্যদের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এগুলোর রহস্য উন্মোচন হওয়া দরকার। ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্রকারীরা আছে বলেই শেখ হাসিনাসহ অনেকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করেছে শহীদ পরিবারবর্গ।”
হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।
২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাই কোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন।
হাই কোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাই কোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।
অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।
হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তদের মুক্তি বা জামিন ‘না দেওয়ার’ অনুরোধ করেছেন প্রভাষক-আইনজীবী সাকিব।
তিনি বলেন, “বিডিআর আইনে যে বিচারটা হয়েছিল সেখানে সর্বোচ্চ সাজা ছিল সাত বছর। তো তারা (বিডিআর সদস্যরা) সাজা খেটে বেরিয়েছে। এখন তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের দাবিটা হচ্ছে মূলত চাকরিতে পুনর্বহাল এবং ক্ষতিপূরণ। চাকরি অথবা ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে তাদের দাবিগুলো সরকার বা বাহিনীর কাছে, শহীদ পরিবারের কাছে নয়। কাজেই এই বিষয়ে শহীদ পরিবারগুলোর কোন মন্তব্য থাকতে পারে না।
“অপরদিকে আরেকটা মামলা হয়েছিল বিস্ফোরক আইনে। আপনারা দেখেছেন বিস্ফোরক আইনের মামলায় অনেকের জামিন হয়েছে। বিচার বিভাগের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না।“
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাকিব বলেন, “হত্যা মামলায় যারা দণ্ডপ্রাপ্ত নয় তাদের জামিনের বিষয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই। যেহেতু বিচারবিভাগ দিচ্ছে সে বিষয়ে আমরা কোন মন্তব্যে যাব না।”
ক্ষমতার পালাবদলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত পুনরায় শুরুর দাবি ওঠে। গত ১৯ ডিসেম্বর অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যান শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
পনের বছর আগে এই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তের জন্য গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে কমিশন গঠন করে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার।
গত ২১ জানুয়ারি বিস্ফোরক আইনের মামলায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে কারাগারে আটক ১৭৮ জন বিডিআর জওয়ানের জামিন মঞ্জুর করে আদালত। এর দুইদিন পর জামিনে মুক্ত হন তারা।
এর মধ্যে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যরা চাকরি ফিরে পাওয়াসহ ৬ দাবি নিয়ে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।
এই আন্দোলন নিয়ে সাকিব বলেন, “হঠাৎ করে দেখলাম বিডিআর সদস্য এবং তাদের পরিবারবর্গ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ হঠাৎ করে খুব তৎপর হয়ে গেলেন তাদের কিছু দাবি নিয়ে। আমরা নোটিস করেছি যে হঠাৎ করে পুরো ঘটনাটার ন্যারেটিভটা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। এটার যে কারণ আমরা বুঝতে পেরেছি তা হচ্ছে ঘটনার সময় এখনকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা আছেন তারা অনেক ছোট ছিলেন, তাদের কাছে ন্যারেটিভটা ক্লিয়ার ছিল না।
“পরবর্তীতে ২৯ জানুয়ারি আমরা এই ন্যারেটিভ ঠিক করার জন্য একটা সংবাদ সম্মেলন করি। এরপর তারা আমাদের ন্যারেটিভটা বুঝতে পেরেছে। পরবর্তীতে তারা আবারও ছয়দফা দাবি দিয়েছে। এবং সেই ছয় দফা দাবিতে আমাদের শহীদ পরিবারের সেন্টিমেন্টগুলো কনসিডার করেছে। এই দাবিতে হত্যাকারীদের ‘অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়ার’ দাবিটি নেই।“
তিনি বলেন, “তারা কিন্তু বিস্ফোরক আইনে গ্রেপ্তার যাদের সাজার মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছে তাদের মুক্তি চেয়েছে। তারা কিন্তু হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্তদের মুক্তি চাননি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়াতুল্লাহ বেহেশতি এবং মাহিন সরকার এই বিষয়টা ক্লিয়ার করেছেন। এরপর মঙ্গলবার তারা আটদফা দাবি পেশ করেছেন। সেখানে হত্যা মামলার আসামিদের মুক্তির বিষয়টি নেই।”
সংবাদ সম্মেলনের ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনাদিবস’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান নেহরীন ফেরদৌস।
এদিকে যখন রাওয়া ক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলন চলছিল, কাছাকাছি সময়ে ঢাকার আরেক প্রান্তে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পিলখানায় বিদ্রোহের অভিযোগে চাকরিচ্যুত ও মামলার আসামি হয়ে কারাবন্দী বিডিআর সদস্যদের মুক্তি এবং চাকরি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন চলছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মাহিন সরকার তাদের পক্ষ থেকে দাবি আদায়ে বুধবার সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন।