“গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে হলে একটি শক্তিশালী সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক অপরিহার্য,” বলেন ড্যানিলোভিচ।
Published : 08 Mar 2025, 09:40 PM
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নীতি ও ঢাকায় দূতাবাসের ভূমিকায় ‘বিরাট ভুল’ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন সে দেশের সাবেক কূটনীতিক জন এফ ড্যানিলোভিচ।
শনিবার সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ঢাকায় নতুন ভোর: গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গতিপথ’ শীর্ষক আলোচনায় ড্যানিলোভিচ এই মন্তব্য করেন।
ঢাকায় ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানের তথ্য সিজিএসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তুমুল আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
সে প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করে।
এক-এগারোর সরকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ফখরুদ্দীন সরকারের সময় গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে।
তার পর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছাড়ে সে সরকার।
ফখরুদ্দীন সরকার ও তাদের সংস্কার উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল বলে তুলে ধরেছেন সাবেক কূটনীতিক ড্যানিলোভিচ।
তখন বাংলাদেশের সব মহলের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমরা সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু আমরা বোধহয় সেনাবাহিনীর কথা বেশি শুনেছি।”
ড্যানোনিলোভিচ বলেন, “অন্যটি ভুলটি হল- নির্বাচন ও নির্বাচনের টাইমলাইনের ওপর জোর দেওয়া।”
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সমর্থন নিয়ে সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে।
“যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তাদের অর্থায়ন নীতি এবং চলমান সংস্কারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে এবং গত ১৭ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করে সুশাসন সংস্কারের জন্য ব্যবহার করা উচিত।”
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলামও এই অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
মাইলাম নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে মার্কিন দূত হিসেবে ছিলেন। আর ড্যানিলোভিচ ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ অব মিশন ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ড্যানিলোভিচ বলেন, “বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে। স্বৈরাচারী শাসন কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূলে নয়।”
গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “১৯৭১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতির ধারাবাহিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হল শাসক দলের জবাবদিহিতার অভাব।
“গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে হলে একটি শক্তিশালী সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক অপরিহার্য। স্বৈরাচারী শাসন কখনোই গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়।”
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তথ্য যুদ্ধের সম্মুখীন এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার মিডিয়াভিত্তিক বিভ্রান্তিমূলক তথ্য মোকাবিলার জন্য কাজ করছে।”
তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাংলাদেশে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য মার্কিন তহবিল সম্পর্কে দেওয়া বিবৃতিও বিভ্রান্তিকর, যা মূলত কিছু ব্যক্তি দ্বারা প্রচারিত, যারা দুই দেশের সম্পর্ক অস্থিতিশীল করতে চায়।
“সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম সম্পর্কিত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য নিছক মিথ্যা প্রচারণা; যা কিছু গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়াচ্ছে। সাবেক সরকার বিদেশি দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, যাতে তারা নিজেদের দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করতে পারে।”
বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আমেরিকার জনগণকে সচেতন করার কাজ করেন তুলে ধরে সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন, “আমরা একটি ছোট সংগঠন গঠন করি এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমেরিকান জনগণকে সচেতন করার জন্য কাজ করি।
“গত পাঁচ বছরে আমরা অর্থায়নের ব্যবস্থা করেছি এবং এই উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”
যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাইট টু ফ্রিডম’ নামের সংগঠনটির সভাপতি উইলিয়াম বি মাইলাম। এর নির্বাহী পরিচালক হলেন-জন ড্যানিলোভিচ।
বাংলাদেশে তার সফরের বিষয়ে মাইলাম বলেন, “এখানে আসতে পেরে আমি আনন্দিত, বিশেষ করে গত দশ বছরে আমি বাংলাদেশ সফর করতে পারিনি, ভিসার জন্যে।”
তিনি বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য তথ্য’ সংগ্রহ করা ছিল তার জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
“আমি যে তথ্য আমার সরকারের কাছে পৌঁছে দেব, তা সঠিকভাবে সংগ্রহ করাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ। সেই সময় সরকার আমাকে তাদের পক্ষ নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল।”
পরে অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থী, রাজনীতিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন মাইলাম ও ড্যানিলোভিচ।