প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে ঢাকা ও নয়াদিল্লি।
Published : 22 Jun 2024, 09:56 PM
ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের পর দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকায় আন্তর্জাতিক শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব গুলশাহানা ঊর্মি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইট প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে রাত ৮টা ২৫ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী ফ্লাইটটি ৬টা ২০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দর ত্যাগ করে। ভারতের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানান।
দিল্লি থেকে রওনা দেওয়ার আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মোদীর নতুন সরকার গঠনের পর বিদেশি সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাই প্রথম ভারত সফর করলেন।
নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে গত শুক্রবার দুই দিনের সফরে নয়াদিল্লি যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাসসের খবরে বলা হয়ছে, সফরের দ্বিতীয় দিন শনিবার সকালে নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী মোদী। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে দেওয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা।
রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের একটি অশ্বারোহী দল রাষ্ট্রপতি ভবনের গেট থেকে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরকে সংবর্ধনাস্থল পর্যন্ত নিয়ে যায়।
পরে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেয়। গার্ড পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীতও বাজানো হয়।
এরপর শেখ হাসিনার সঙ্গে তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও তার সফরসঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দেন।
পরে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রাজাঘাটে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (মহাত্মা গান্ধী) সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা।
রাজঘাট থেকে হায়দ্রাবাদ হাউসে ফিরে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও শেখ হাসিনার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক হয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়্সওয়াল এক্সে বলেছেন, শনিবার হায়দ্রাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা পৌঁছালে তাকে অভ্যর্থনা জানান মোদী।
এরপর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একান্ত বৈঠকে বসেন। পরে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এরপর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে ঢাকা ও নয়াদিল্লি।
এসব স্মারকের মধ্যে সাতটিই নতুন। এছাড়া তিনটি সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হয়েছে।
বৈঠক ও সমঝোতা স্মারক সই করার পর আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরতে সংবাদ সম্মলেন আসেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী।
এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।
বৈঠক ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “উভয় দেশ একটি ‘রূপকল্প’ অনুমোদন করেছে, যাতে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে দুই দেশই পরিচালিত হতে পারে। আমরা টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ডিজিটাল এবং সবুজ অংশীদারত্বের বিষয়ে একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছি।”
“দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সম্পর্কের বিষয়টি রয়েছে।”
ভারতকে ‘প্রধান প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার’ হিসেবে বর্ণনা করে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, “ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ অনেক মূল্য দেয়, যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছে একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়।”
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘ক্রমাগত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
“আমাদের দুই পক্ষের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে, যেখানে আমরা পারস্পরিক স্বার্থের অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি। এসবের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছি।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আমাদের জনগণ ও দেশের উন্নতির জন্য একে অপরের সাথে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছি।”
নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ঢাকা ও দিল্লি নতুনভাবে পথ-চলা শুরু করেছে, সেই প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “সেই ধারাবাহিকতায় আমরা ‘রূপকল্প-২০৪১’ এর মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত-২০৪৭’ অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি।”
শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই দেশ নিজেদের মধ্যে যেসব সমঝোতা স্মারক সই করেছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি নবায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয় দেশ উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক বজায় রেখেছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন এবং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।
সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় সফরে ২০২২ সালে ভারত গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর গত বছর সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসা শেখ হাসিনার এই মেয়াদে এটি ভারতে প্রথম আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় সফর।
এটি চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় ভারত সফর। দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৮ থেকে ১০ জুন প্রতিবেশী দেশটি সফর করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমি ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে এবং আমার প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ আতিথেয়তা দেওয়ার জন্য। এগুলো আমাদের দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততার প্রমাণ।”
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার এদিনের বৈঠকের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তারা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পৃক্ততার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এই সফরের আমন্ত্রণের জন্য মোদী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের জন্য ফের আমন্ত্রণ জানান শেখ হাসিনা।
এ দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজন করা হয় রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজ।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ
ভারতের প্রেস ব্যুরো অব ইনফরমেশনের (পিআইবি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শনিবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে সেদেশের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাক্ষাতের সময় রাষ্ট্রপতি মুর্মু বলেন, “দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে জোরদার করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং নতুন নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতার দুয়ার খুলছে। এগুলো ভারত-বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা নিরূপণে ভূমিকা রাখবে।
“নিয়মিত এসব যোগাযোগ গভীর বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রতিফলন, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে।”
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করায় তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি।