স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে হোটেল লো মেরিডিয়ান পর্যন্ত এলাকায় ১ অক্টোবর থেকে হর্ন বাজানো নিষেধ করে আদেশ জারি হয়েছে; কিন্তু চালকরা মানছেন না।
Published : 08 Oct 2024, 01:25 AM
রোববার দুপুর ২টা। রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকার সামনে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছিল কয়েকটি বাস, সেই সঙ্গে অবিরাম বেজে চলছিল হর্ন। যদিও এলাকাটি সম্প্রতি ঘোষণা করা ‘নীরব এলাকা’।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা ও এর উত্তর-দক্ষিণে দেড় কিলোমিটার (স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে হোটেল লো মেরিডিয়ান পর্যন্ত) এলাকাকে সম্প্রতি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ এর বিধি-৪ অনুযায়ী ১ অক্টোবর থেকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদ্যোগটি নিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), পরিবেশ অধিদপ্তর, সড়ক বিভাগ ও পরিবহন মালিক সমিতি।
তবে ছয় দিন পর রোববার ওই এলাকায় গিয়ে এ নিয়ম মানতে আগ্রহ দেখা যায়নি। সেখানে দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবীরা বললেন, সবচেয়ে বেশি বাজান প্রাইভেট কারের চালকরা।
স্থানীয়রা বলছেন, নীরব এলাকা ঘোষণার পর শব্দ দূষণের দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
উত্তরার স্কলাস্টিকা পয়েন্ট এলাকার ফুটপাতের ওপর একটি স্টিলের খুঁটিতে সাইবোর্ডে লেখা ‘নীরব এলাকা শুরু: ঢাকা সড়ক বিভাগ’। দক্ষিণে লো মেরিডিয়ান পয়েন্টের সামনে ‘নীরব এলাকা’ সম্বলিত সাইনবোর্ড রয়েছে।
চালকদের দাবি, সড়কে হর্ন ছাড়া যানবাহন চালানো কঠিন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সড়কে পথচারীরা ‘শৃঙ্খলা মানেন না’, ফুটব্রিজ ব্যবহার না করে যত্রতত্র সড়ক পার হন তারা। এমন পরিস্থিতিতে হর্ন না দিলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।
তবে এই সড়কে ফুটব্রিজ ব্যবহার ছাড়া পথচারীর পক্ষে রাস্তা পারাপার কঠিন।
লো মেরিডিয়ানের সামনে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন গ্রিন ভয়েস নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
সরকারি তিতুমীর কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের এই শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো আসলে জানিই না যে হর্ন বাজানো ‘অপরাধ’। এটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাসের চালকরা কিছুটা বুঝেছেন; কিন্তু প্রাইভেট কারের চালকরা বেশি বাজান। এজন্য আমরা আমরা আপাতত সচেতন করছি এবং মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া লিফলেট বিতরণ করছি। মঙ্গলবার থেকে আইন প্রয়োগ শুরু হবে।”
তার সঙ্গে থাকা একই কলেজের একই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শিমুল বলেন, ১ থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত স্কলাস্টিকা, বিমানবন্দর ও লো মেরিডিয়ান এলাকায় মোট ১০০ স্বেচ্ছাসেবী দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিমানবন্দর এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরাও সচেতন করার জন্য লিফলেট দিয়েছি। (শনিবার) মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হয়েছে। বাসের যারা মালিকপক্ষ আছেন, সবাইকে ডেকে এটা বলে দিচ্ছি। আমরা সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করছি।”
‘হর্ন না বাজালে তো বিপদ’
বিমানবন্দর এলাকায় গাজীপুর থেকে গুলিস্তানগামী ‘আজমেরী গ্লোরী’ পরিবহনের চালক মো. রিয়াদ আপনমনে হর্ন বাজাচ্ছিলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যাত্রীরা যেখান-সেখান দিয়ে রাস্তা পার হয়। হুট করে সামনে চলে আসে। হর্ন না বাজালে তো বিপদ ঘটবে। সবাই সচেতন না হলে তো হবে না।”
প্রজাপতি পরিবহনের চালক আফজাল হোসেন বলেন, “বিমানবন্দর মোড়ে স্টেশনের প্রবেশপথে প্রচুর যাত্রী-পথচারী সড়ক পার হন। এখানের ফুটব্রিজটির চলন্ত সিঁড়ি অনেকদিন ধরেই নষ্ট। ফলে যাত্রীরা প্রায়ই রাস্তার মাঝ দিয়ে দৌড় দেন। ফলে এ পথে হর্ন বাজাতে হয়।”
মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করেন ফজলুল ইসলাম। অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললেন, “এই আইন একদিনে মানাইতে পারবেন না। অনেক দিন ধরেই মানুষ হর্ন বাজায়ে অভ্যস্ত। সেটা তো আর রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। তবে আমার জায়গা থেকে আমি সতর্ক থাকতে চেষ্টা করব।”
আশকোনা হজ ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দা সাইফুল হক দোকান চালান বিমানবন্দর এলাকায়। বলেন, “হর্ন না দিয়ে গাড়ি চালানোর জন্য সবাইকেই সচেতন হতে হবে।”
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা প্রোগ্রাম নেওয়া উচিত। মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে এটা জানাতে হবে। পাশাপাশি ওই এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক সাইনবোর্ড এখনও দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই কাজে সফলতার জন্য আমাদের আরও বেশি সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।”
কীভাবে বাস্তবায়ন করবে মন্ত্রণালয়?
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক প্রকল্পটি মূলত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সহায়তায় যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা শুরু হল, এখন অনেক কিছু করতে হবে। যেমন, রোডে সাইনবোর্ড দিতে হবে, স্পিড কন্ট্রোল লাগাতে হবে। আমরা ওখানে আবার একজনকে দিয়েছি, যিনি হর্ন কমেছে কি না সেটা নির্ণয় করবেন। কিছু কমেছে, কিন্তু কমলেও হর্ন আছে।”
চালকরা অভ্যাসবশত হর্ন দেয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পথচারীদের জন্য হর্ন দিতে বাধ্য না। হর্ন দেওয়া অভ্যাস।
“আমরা প্ল্যান যেটা করেছি, দেখি এটাতে কোথায় কী হয়, কোথায়-কোথায় আমাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করি। এখানে (বিমানবন্দর এলাকা) রিকশা নেই, তাই এই এলাকাটা নির্বাচন করা। ভেতরে (বিমানবন্দরের) যদি আমরা সফল হতে পারি, রাস্তায় যদি কিছু সচেতনতাটুকু তৈরি হয়। এনফোর্সমেন্টেও আমরা হয়ত যাব, তবে সেটা ডিসেম্বরের আগে না। এর মধ্যেই আমরা ঢাকার আরও ১০টি রাস্তায় এটা করব।”
শব্দদূষণ আইনে যা আছে
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, মিশ্র ও ‘নীরব এলাকায়’ শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ।
এতে বলা আছে, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময় ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল।
হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
এ আইনে শাস্তি হিসেবে বলা আছে, আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর দেশজুড়ে ১২টি ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ঢাকায় পাঁচটি। বিমানবন্দর এলাকা ছাড়া বাকিগুলো হল সচিবালয়, আগারগাঁও, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকা।
তবে ক্যাপস এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, নীরব এলাকার কোনোটি ‘নীরব’ নয়। সবগুলোতেই শব্দের মাত্রা বেশি।
সচিবালয়ের ১২টি স্থানে শব্দের মাত্রা গড়ে ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবেল। সংসদ এলাকায় এটি ৭১ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এলাকায় ৭৫ দশমিক ৫৮ ডেসিবেল ও আগারগাঁও এলাকায় ৭২ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল।