ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে জলোচ্ছ্বাসে, ঘর ভেঙে এবং দেয়াল ধসে এসব মৃত্যু ঘটেছে।
Published : 27 May 2024, 04:00 PM
ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে জলোচ্ছ্বাসে, ঘর ভেঙে এবং দেয়াল ধসে ছয় জেলায় ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
রোববার দুপুর থেকে সোমবার দুপুরের মধ্যে পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, ভোলা, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে এসব মৃত্যু ঘটে।
এর মধ্যে পটুয়াখালীতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোয়ারের মধ্যে ভেসে গিয়ে একজন এবং গাছ পড়ে দুইজন মারা গেছেন। সাতক্ষীরাতেও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
বরিশালে ভবনের দেয়াল ধসে দুইজন, গাছচাপায় একজন মারা গেছেন। ভোলায় ঝড়ে ঘর ও গাছচাপা পড়ে প্রাণ গেছে তিনজনের।
খুলনায় ঘরের ওপর গাছ পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক পথচারী মারা গেছেন।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল রোববার রাতে খেপুপাড়া ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝামাঝি এলাকা উপকূল অতিক্রম শুরু করে। পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে শক্তি হারিয়ে এ ঝড় স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
ঝড় দুর্বল হয়ে যাওয়ায় সংকেতও নামানো হয়েছে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাপিবদ সংকেত নামিয়ে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আর কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
পটুয়াখালী
ঝড় শুরুর আগে রোববার দুপুরে জলোচ্ছ্বাসের সময় পটুয়াখালীতে বোন ও ফুফুকে উদ্ধার করতে গিয়ে পানির তোড়ে ভেসে মারা গেছে এক যুবক।
মো. শরীফ হাওলাদার নামের ২৮ বছর বয়সী ওই যুবক কলাপাড়া উপজেলার ধূলাসর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিম হাওলাদারের ছেলে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শরীফের ফুফু মাতোয়ারা বেগম কাউয়ার চর এলাকায় বসবাস করেন। ওই বাড়িতে তার বোনও ছিলেন।
দুপুরের দিকে শরীফ তার বড় ভাই ও ফুফাকে নিয়ে বোন এবং ফুফুকে উদ্ধার করতে যায়। পথে বেড়িবাঁধের বাইরে একটি গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।
শরীফ সাতার কেটে সড়কটি পার হয়ে ফুফুর ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঢেউয়ের তোড়ে তিনি হারিয়ে যান। পরে এক ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।
এদিকে ঝড়োবাতাসে গাছ উপড়ে পড়ে পটুয়াখালীর দুমকি ও বাউফলে দুই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
বাউফলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বশির গাজী জানান, উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন স্থানে একটি পরিত্যাক্ত ঘরে চাপা পড়ে আবদুল করিম নামে ৬৫ বছর বয়সী একজন মারা যান সোমবার সকালে।
আবদুল করিম নাজিরপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সোবাহান মৃধার ছেলে। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দুমকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিন মাহমুদ জানান, সকাল ৮টার দিকে পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের নলদোয়ানী এলাকায় নিজ বসত ঘরে গাছ চাপা পড়ে জয়নাল হাওলাদার নামে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। ঘরে থাকা তার স্ত্রীও আহত হন। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
রোববার সন্ধ্যায় উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে বলে শ্যামনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান।
তিনি বলেন, “ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে নাপিতখালী গ্রামে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সন্ধ্যায় গ্রামের বাসিন্দা শওকাত মোড়ল (৬৫) বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় হয়ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন।”
শওকাত মোড়লের পুত্রবধূ আছমা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, “সন্ধ্যার দিকে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দুজন মিলেই নাপিতখালী আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। ঝড়ো বাতাসে রাস্তায় পড়ে গিয়ে আমার শ্বশুর মারা গেছেন।”
খুলনা
ঝড়ের মধ্যে বসত ঘরের ওপর গাছ পড়ে খুলনার বটিয়াঘাটায় লাল চাঁদ মোড়ল নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, ৩৬ বছর বয়সী লাল চাঁদ বটিয়াঘাটার সুরখালী ইউনিয়নের গাওহড়া গ্রামের মৃত গহর আলী মোড়লের ছেলে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল হুসাইন খান জানিয়েছেন, রোববার রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন লাল চাঁদ। সোমবার সকালে বাড়ি ফিরে যান তিনি। সেখানে গাছ চাপা পড়ে মারা যান।
ভোলা
ভোলার লালমোহন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ঘরের নিচে চাপা পড়ে এক নারীর প্রাণ গেছে।
সোমবার ভোররাত ৪টার দিকে চর উমেদ ইউনিয়ন পরিষদের চর উমেদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে লালমোহন থানার ওসি এসএম মাহবুব উল আলম জানান।
তিনি বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ে ঘরের নিচে চাপা পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি।”
৫৫ বছর বয়সী মনেজা খাতুন চর উমেদ এলাকার আব্দুল কাদেরের স্ত্রী।
পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. হান্নান বলেন, মনেজা খাতুন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তার স্বামী ও নাতনিও একই ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন।
ভোর ৪টার দিকে তীব্র ঝড়ের মধ্যে তাদের বসত ঘরটি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় তার স্বামী ও নাতনি বের হতে পারলেও মনেজা ঘরের নিচে চাপা পড়েন। পরে প্রতিবেশীরা গিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করেন।
এছাড়া দৌলতখান উপজেলায় ঝড়ের মধ্যে গাছ হাপা পড়ে মাইশা নামের ৪ বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দৌলতখান থানার ওসি রোহানউদ্দিন।
আর বোরহান উদ্দিন উপজেলায় ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে জাহাঙ্গীর নামের ৫০ বছর বয়সী একজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন বোরহান উদ্দিন থানার ওসি শাহীন।
তবে এ দুটি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তাৎক্ষণিকভাবে পওয়া যায়নি।
বরিশাল
বরিশালে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে একটি ভবনের দেয়াল ধসে খাবারের হোটেলে পড়ার পর ওই হোটেলের মালিক ও কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আরিচুল হক জানান, সোমবার ভোরে ৪টার দিকে নগরীর রুপাতলী এলাকায় লিলি পেট্রোল পাম্পের পাশে এ ঘটনায় আরও একজন আহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন- লোকমান হোটেলের মালিক লোকমান হোসেন (৫৮) এবং কর্মী মোকলেসুর রহমান (২৮)। আহত আারেক কর্মী শাকিবকে বরিশাল শেরে-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বরিশাল নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুলতান মাহমুদ বলেন, ভোরে লোকমান, মোকলেস ও শাকিব টিনশেডের ওই হোটেলের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলেন। বাইরে তখন ঝড়-বৃষ্টি চলছিল।
“এক পর্যায়ে পাশের তিনতলা ভবনের ছাদের দেয়ালের কিছু অংশ ধসে হোটেলের টিনের চালে ওপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই দুইজনের মৃত্যু হয়।”
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে দুজনের লাশ উদ্ধার এবং একজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বলে জানান ওসি।
এদিকে চর দাড়িয়াল গ্রামে ঝড়ের মধ্যে বাজারে যাওয়ার পথে গাছের ডাল পড়ে জালাল সিকদার নামের ৫৫ বছর বয়সী একজনের মৃত্যু হয় বলে বাকেরগঞ্জ থানার ওসি আফজাল হোসেন জানান।
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম নগরীতে একটি নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে পড়ে এক পথচারীর প্রাণ গেছে। সোমবার সকালে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামীর চন্দ্রনগর তালতলার জেডএ আবাসিক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
নিহত পথচারীর নাম সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬); তিনি থাকতেন খুলশী থানার চৌধুরী নগর শতাব্দী হাউজিং এলাকায়, কাজ করতেন বায়েজিদ তারা গেইট এলাকার একটি কার্টন ফ্যাক্টরিতে। হৃদয়ের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, " সকালে কাজে যাওয়ার সময় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে পড়ে ছেলেটি শরীরের ওপরে। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়।"
মাদ্রাসার জন্য ওই ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছিল জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতে দেয়ালটি আলগা হয়ে পড়ে যায়।