সবচেয়ে বেশি সংঘাত যাত্রাবাড়ী এলাকায় হলেও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে হামলার ঘটনায় মামলা সবচেয়ে বেশি হয়েছে শাহবাগ থানায়।
Published : 23 Jul 2024, 10:08 PM
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর অন্তত ১৯টি থানায় একশর বেশি মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে হাজারের বেশি।
ডিএমপি কর্মকর্তারা জানান, অধিকাংশ মামলায় বাদী হয়েছে পুলিশ; আসামিদের বেশিরভাগই অজ্ঞাত।১৫ থেকে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে দুইশ থেকে শুরু করে অজ্ঞাত দেড় হাজার বা তার চেয়ে বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে।
গত ১৮ জুলাই থেকে সবচেয়ে বেশি সংঘাত যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী এলাকায় হলেও মামলা সবচেয়ে বেশি হয়েছে শাহবাগ থানায়।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে ১৪টি। এছাড়া বনানী থানায় ১৩টি, উত্তরা পশ্চিম থানায় ১১টি, মোহাম্মদপুর ও বাড্ডা থানায় ৮টি করে, নিউ মার্কেট থানায় ২টি হত্যা মামলাসহ ৮টি, উত্তরা পূর্ব থানায় ৭টি, মিরপুর থানায় ৫টি, যাত্রাবাড়ীতে ৪টিসহ ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১০১টি মামলার তথ্য মিলেছে। আরও মামলা হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জুনের শেষে হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করলে ছাত্ররা ফের মাঠে নামে। জুলাইয়ে তা সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে যায়।
ছাত্ররা প্রথমে পরিপত্র পুনর্বহাল অর্থাৎ কোটা বাতিলের দাবি সামনে আনলেও পরে কোটা সংশোধন করে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ করার দাবি জানাতে থাকে।
এই দাবিতে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বাংলা ব্লকেড নামে অবরোধ কর্মসূচি আসতে থাকে।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীদের সংঘাতের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পরদিন ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীসহ দুই জন, চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতাসহ তিন জন ও রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রের মৃত্যু হয় সহিংসতায়।
এর প্রতিক্রিয়ায় ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা হয়, সেদিন মাঠে নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও।
রাজধানীর বাড্ডা, উত্তরা ও ধানমন্ডি এলাকায় গুলিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর আসে। গোটা দেশে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে, এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে হামলা শুরু হয়।
রামপুরায় বিটিভি ভবন, বনানীতে সেতু ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাব স্টেশন, মেট্রোরেলের দুটি স্টেশনেও ভাঙচুর হয়।
সেদিন থেকেই ঢাকার উত্তরার পথে পথে, ধানমন্ডির শংকর ও সোবহানবাগ এলাকা, মোহাম্মদপুর ও বসিলা, মিরপুর এলাকায় গোলাগুলির খবর আসে।
ঢাকার বাইরে নরসিংদী কারাগারে হামলা করে ফটক ভেঙে ৮৫টি অস্ত্র লুট করা হয়। সন্দেহভাজন ৯ জঙ্গিসহ পালিয়ে যান আট শতাধিক বন্দি। এসব অস্ত্রের মধ্যে ২০টি পরে উদ্ধার হয়, গুলি উদ্ধার হয়েছে এক হাজারের কিছু বেশি।
রামপুরা, বাড্ডা ও যাত্রাবাড়ী, কদমতলী এলাকা পাঁচদিন ধরে ছিল অচলপ্রায়। পুলিশ, বিজিবির সঙ্গে সংঘাতে ব্যাপকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের তথ্য আসে।
১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি হয়। এর তিন দিন পর নিয়ন্ত্রণে আসে যাত্রাবাড়ী ও রামপুরা-বাড্ডা এলাকা।
ডিএমপি কমিশনার সোমবার (২২ জুলাই) যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে সাংবাদিকদেরকে বলেন, সহিংসতা করতে সারা দেশ থেকে এখানে লোকজনকে জড়ো করা হয়েছিল। নরসিংদী কারাগার থেকে লুট করা অস্ত্র ও গুলিও এখানে ব্যবহার হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
টানা পাঁচ দিনের সহিংসতায় সারা দেশে প্রাণ হারায় দেড় শতাধিক মানুষ; এদের একটি ব্ড় অংশই মারা গেছে যাত্রাবাড়ী এলাকার সংঘাতে।
বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সজীব দে বলেন, “আমাদের থানায় এখন পর্যন্ত ১৩টির মামলা হয়েছে। সেতু ভবন, মহাখালী পুলিশ বক্স, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এসব মামলা হয়। মামলায় দুইদিনে ১৫ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।”
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভূঞা বলেন, “আমাদের থানায় তিন দিনে ৮টি মামলা হয়েছে। পুলিশ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্তরা বাদী হয়ে এসব মামলা করেছে। কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে।”
গুলশান বিভাগের উপকমিশনার রিফাত রহমান শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাড্ডা থানায় অন্তত আটটি মামলা হয়েছে।
যাত্রাবাড়ী থানায় মামলার সংখ্যা চারটি বলে নিশ্চিত করেছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ইকবাল হোসাইন।
মিরপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জানান, তার থানায় নাশকতার ঘটনায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তরা বাদী হয়ে এসব মামলা করেছে।
ডেমরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফারুক মোল্লা জানান, তার থানায় দুটি মামলা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আগুন, ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে।
উত্তরা বিভাগের সহকারী কমিশনার (বিমানবন্দর) ফকরুল হাসান জানান, তার জোনের দুটি থানার মধ্যে নাশকতার ঘটনায় শুধু মাত্র উত্তরার পূর্ব থানায় সাতটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে র্যাব তিনটি মামলা করেছে।
উত্তরা পশ্চিম এবং তুরাগ থানা নিয়ে উত্তরা জোন। এই জোনের সহকারী কমিশনার সুমন কর জানান তুরাগ থানায় একটি এবং পশ্চিম থানায় ১১টি মামলা হয়েছে নাশকতার ঘটনায়।
নিউ মার্কেট থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, নাশকতার এবং হত্যার ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে দুটি হত্যা মামলা। এসব ঘটনায় ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান জানান, নাশকতার ঘটনায় তার থানায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৪টি মামলা হয়েছে।
রমনা থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বলেন, গত কয়েকদিন ধরে তার থানা এলাকায় ‘কোটা আন্দোলনের নামে’ সহিংসতার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে।
গত কয়েক দিনের নাশকতার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে বলে জানান মতিঝিল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, “অনেক ভুক্তভোগী রয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের কোনো অভিযোগ পেলে মামলা নেওয়া হবে।”
খিলগাঁও থানায় পাঁচটি মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানান ওই থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া। তিনি বলেন, তার থানা এলাকায় পুলিশের উপর হামলা, পিবিআই কার্যালয়ে হামলার ঘটনা রয়েছে।
ওয়ারী থানায় একটি মামলার কথা জানান ওসি জানে আলম মুন্সী।থানায় হামলার চেষ্টা, পুলিশকে মারধরের অভিযোগে এই মামলা হয়।
গুলশান থানার ওসি মাযহারুল ইসলাম বলেন, পুলিশ বক্স পোড়ানোর অভিযোগে তার থানায় দুটি মামলা হয়েছে।
কোতোয়ালি থানার ওসি বলেন, আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসীরা সিএমএম কোর্টে তিনটি গাড়ি ভাংচুর ও মারধর করে। এই ঘটনায় তার থানায় একটি মামলা হয়েছে।
ধানমন্ডি থানার ওসি পারভেজ ইসলাম জানান, নাশকতার মোট পাঁচটি মামলা হয়েছে তার থানায়। আর শেরেবাংলা থানায় একটি মামলা হয়েছে বলে ওসি মুহাম্মদ আহাদ আলী জানিয়েছেন।