নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা বলবৎ রয়ে গেছে, বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
Published : 31 Dec 2024, 09:11 PM
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের কিছু ধারায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ‘নিবর্তনমূলক’ সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘পুনরাবৃত্তি’ থাকার কথা বলছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
নতুন আইনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ নিয়ে মঙ্গলবার আয়াজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়ে টিআইবি বলেছে, অধ্যাদেশের অনেক ধারা নাগরিকের বাক, ভিন্নমত ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সংগঠনের অধিকার খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা বলবৎ রয়ে গেছে, যা অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক ও নজরদারিমূলক আইনি কাঠামো সৃষ্টি করবে।
“অধ্যাদেশটি পর্যালোচনা করে আমরা দেখছি, এতে অনেকাংশে পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের এজেন্ডা ও ভাষ্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে; একাধিক ধারায় পূর্বের ডিএসএ বা সিএসএ-এর পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে।”
‘কালাকানুন’ হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গত ৭ নভেম্বর নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর ১ ডিসেম্বর সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ওয়েবসাইটে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪-এর খসড়া প্রকাশ করে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত চাওয়া হয়।
এর ২০ দিন পর ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এরপর রাষ্ট্রপতি ওই অধ্যাদেশ জারি করার কথা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের তথ্য জানিয়ে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞাপ্তিতে বলা হয়েছে, অধ্যাদেশের কিছু ক্ষেত্রে ‘জটিল ও অস্পষ্ট শব্দ, শব্দগুচ্ছ ও ধারণার ব্যবহার’ করার বিষয় তুলে ধরে খসড়ার বিষয়ে অংশীজনদের মতামত নিতে মাত্র চার দিন সময় দেওয়ায় অধ্যাদেশটি প্রণয়নের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন টিআইবি।
টিআইবি বলছে, তড়িঘড়ি করে সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে যথাযথ পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়ে এ অধ্যাদেশের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আমরা মনে করি, অধ্যাদেশটি বর্তমান অবস্থায় জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করবে না। আমরা আশা করি, অধ্যাদেশটি প্রণয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢেলে সাজানো হবে, যাতে সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনভেনশনসমূহ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি সুরক্ষিত হয়।”
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম।
প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এই অধ্যাদেশের কাঠামো এবং বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অধ্যাদেশটি সাইবার সুরক্ষা, সাইবার অপরাধ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় একত্রিত করার চেষ্টা করলেও, এর অস্পষ্ট শব্দাবলী ও জটিল ভাষা সাধারণ জনগণ এবং বিশেষজ্ঞদের জন্য বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে। আবার, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’, ‘ব্লকচেইন’ এবং ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং’ এর মতো প্রযুক্তিগত শব্দগুলোর সঠিক সংজ্ঞা না থাকার কারণে আইনের প্রয়োগে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
টিআইবি মনে করে, অনুমোদনের অপেক্ষা থাকা অধ্যাদেশে সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক ও পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’।
টিআইবি বলছে, ধারা ২-এ ব্যবহৃত ‘কম্পিউটার’, ‘উপাত্ত ভাণ্ডার’ এবং ‘কম্পিউটার সিস্টেম’-এর সংজ্ঞাগুলো অতিরিক্ত বিস্তৃত এবং প্রযুক্তিগত বাস্তবতার সঙ্গে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ নয়, যা আইনের প্রয়োগে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
“পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, অধ্যাদেশের শিরোনাম এবং কাঠামোও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
এরশাদুল করিম বলেন, শিরোনামে সাইবার সুরক্ষা, সাইবার অপরাধ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব কিছু একত্রিত করা হলেও, এতে কিছু ‘অস্পষ্টতা’ তৈরি হয়েছে।
“ধারা ৮-এর উপ-ধারা (২)-এ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব, রাজনৈতিক অপব্যবহার বা নাগরিকদের ইন্টারনেট অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে।”
ধারা ১৬ ও ১৭-এ সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সনদপ্রাপ্ত মনিটরিং প্রক্রিয়া এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাঙার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বিধান থাকা উচিত বলেও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন তিনি।
এরশাদুল করিম বলেন, ধারা ২৫-এ সাইবার বুলিং, অপমান, হয়রানি বা ব্ল্যাকমেইলের বিষয়টি খুবই বিস্তৃত এবং ‘বিভ্রান্তিকরভাবে’ আনা হয়েছে, যা যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকেও ‘অপমান’ বা ‘হয়রানি’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, ফলে জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে।
“এ কারণে, এই ধারাটি সংশোধন করে সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।”
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এ অধ্যাদেশ জনগণের বাক, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং সংগঠনের অধিকারকে খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
“যদিও বলা হয়েছে, নতুন অধ্যাদেশটি হবে দেশবাসীর ডিজিটাল অধিকার নিশ্চিতে সহায়ক, কিন্তু বাস্তবে এতে আমরা অনেকটাই পূর্বতন কালো আইনসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিমূলক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকতে দেখছি।”
তিনি বলেন, “অধ্যাদেশে অনেক জটিল ও অস্পষ্ট শব্দ, শব্দগুচ্ছ ও ধারণার ব্যবহার করে এর অপব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত একাধিক ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত করে একটি জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
“অধ্যাদেশটির খসড়া প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত গ্রহণ করা হয়নি এবং যথাযথ পর্যালোচনার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও দেওয়া হয়নি, বরং তড়িঘড়ি করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী চেতনায় গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে এমন প্রক্রিয়ায় এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিমূলক অধ্যাদেশ অনুমোদন পাওয়া বিব্রতকর।”
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “অধ্যাদেশ অনুযায়ী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য, যদিও ধর্মীয় অনুভূতির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
“তদুপরি, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত যেমন অগ্রহণযোগ্য, একইভাবে সকলের সমঅধিকার, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যবিরোধী মূল্যবোধের উপর আঘাতও একই মাত্রায় অগ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। এ ধরনের ধারা যদি সংযুক্ত করতেই হয়, তাহলে ধর্মীয় মূল্যবোধে সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না। সকল মানুষের সমান অধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সার্বিকভাবে বৈষম্যহীন মূল্যবোধের প্রতি আঘাত আনে, এমন মন্তব্যও সমানভাবে অগ্রহণযোগ্য হবে, এমন ধারা সন্নিবেশ করতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।