জুলাই-অগাস্টের গণ অভ্যুত্থানের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে স্মৃতির মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করছে দেশবাসী।
Published : 21 Feb 2025, 12:21 AM
মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলন-সংগ্রামে বুকের রক্ত ঝরিয়েছেন যারা, ফুলেল শ্রদ্ধায় সেইসব বীরদের স্মরণ করছে বাংলাদেশ।
একুশের রাতের প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদদের স্মৃতির মিনারে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে অবনত চিত্তে।
রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে জুলাই-অগাস্টের গণ অভ্যুত্থানের আবহের মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধা নিবেদনে শুরু হয়েছে ভাষা নিয়ে গর্ব আর শোকের এই দিন পালনের কর্মসূচি।
প্রথম প্রহরের এই ক্ষণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশাপাশি শহর আর নগর ছাপিয়ে সব শহীদ মিনারেও চলছে শ্রদ্ধা নিবেদন।
ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বরাবরের মত হাজারো মানুষ হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে যান শহীদ মিনার অভিমুখী লাইনে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি এবং বিশিষ্টজনদের পর শহীদদের বেদীতে শ্রদ্ধা জানানোর অপেক্ষায় তারা।
একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় মাইকে বাজছিল অমর সেই গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…’। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তখন বেদনাবিধুর এক আবহ তৈরি হয়।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভিন্ন বাস্তবতায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয়বার একুশের বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাহাবুদ্দিন।
আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়া মুহাম্মদ ইউনূস প্রথমবার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তিনি ১২টা ১২ মিনিটে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা আলাদা সময়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ আপিল বিভাগ ও হাই কোর্টের বিচারপতিরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
তারা ফুল দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা একসঙ্গে শহীদদের বেদীতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
এরপর ঢাকায় দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত,কূটনীতিক, হাই-কমিশনাররা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ও কমিশনাররা ভাষা শহীদদের বেদীতে এরপর ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে এরপর তিন বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল
মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ফুল দেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ফুল দিতে আসেন শহীদদের বেদীতে।
ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে এরপর একে একে শ্রদ্ধা জানান পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমসহ বিভিন্ন আইনশঙ্খলা বাহিনীর প্রধানরা।
সহকর্মীদের নিয়ে এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা শ্রদ্ধা জানান।
তাদের পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে রাত ১২টা ৪০ মিনিট থেকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ অন্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।
জুলাই-অগাস্টে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে রয়েছে সেই অভ্যুত্থানের ছাপ। প্রতিবছর শহীদ মিনার এলাকার দেয়ালে বিভিন্ন স্লোগান, কবিতা ও গানের লাইন লেখা হলেও এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতি।
কোনো কোনো দেয়ালের উপরে ব্যানার বসানো হয়েছে, যেগুলোয় বিভিন্ন গান ও কবিতার লাইন কিংবা নানা স্লোগানে একুশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির আত্মত্যাগের এ দিন এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বাঙালির ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রথম প্রহরেই শহীদ মিনারে শুরু হয়েছে শ্রদ্ধা জানানোর পালা, ফুলে ফুলে ভরে উঠতে শুরু করেছে স্মৃতির মিনার।
এবারও প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুপস্থিত ছিল বিএনপি।
অন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে এসেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, রাজনৈতিক দল বিপ্লবী ধারা, বাংলাদেশ কংগ্রেস, গণ সংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, গণ ফোরাম, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের পক্ষে একটি প্রতিনিধি দল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।
প্রথম প্রহরের অনুষ্ঠানের পর শুক্রবার দিনব্যাপী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাবেন সবাই।
এজন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আশপাশের পিচঢালা রাস্তাকে ক্যানভাস বানিয়ে রঙ-তুলির আঁচড়ে আলপনায় সাজিয়ে তুলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা।
একুশের শ্রদ্ধানুষ্ঠান ভাবগাম্ভীর্য ও শান্তিপূর্ণভাবে পালনের লক্ষ্যে সন্ধ্যা থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাধারণের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়; পথ চলায়ও ছিল নিয়ন্ত্রণ।কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। র্যাব ও গোয়েন্দারাসহ পুলিশের বিশেষ ইউনিটগুলো তাদের দল মোতায়েন করেছে পুরো এলাকায়।
আরও পড়ুন:
শহীদ মিনারে একুশের সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাপ