Published : 01 Apr 2025, 11:19 PM
বাংলাদেশের উগ্রপন্থিদের চোখ রাঙানোর কথা তুলে ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধকে ‘বিভ্রান্তিকর’ ও ‘অতি সরলিকরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
মঙ্গলবার ‘সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস’ নামে ফেইসবুক পাতায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদপত্রে এ প্রতিক্রিয়া জানায় মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয়।
‘বাংলাদেশ যখন নিজেকে পুনরাবিষ্কার করছে, সূচনা দেখছে ইসলামি উগ্রপন্থিরা’ শিরোনামে মঙ্গলবার একটি নিবন্ধ ছাপায় যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রটি।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস সেটির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেছে, ‘ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দখলের দ্বারপ্রান্তে’ আছে বলে ইঙ্গিত দিয়ে বাংলাদেশকে নির্মম ও একপেশেভাবে চিত্রায়িত করেছে নিউ ইয়র্কের টাইমসের নিবন্ধ। এমন চিত্রায়ন কেবল দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সরলিকরণই নয়, বরং ১৮ কোটি মানুষের একটি জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকিতে ফেলছে।
“ভুল চিত্র দেয় এমন কিছু সুনির্দিষ্ট ও বিস্ফোরক উদাহরণের উপর ভর না করে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি এবং পরিস্থিতির জটিলতা স্বীকার করে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।”
এরপর চার ভাগে ওই প্রতিবেদন কীভাবে ‘একপেশে’ ও ‘বিভ্রান্তিকর’ তা তুলে ধরা হয়েছে ‘সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস’ এর ওই পোস্টে।
পাঠকদের জন্য সেটা তুলে ধরা হল-
১. বাংলাদেশের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জের স্বীকৃতি
নিবন্ধে ধর্মীয় উত্তেজনা ও রক্ষণশীলতার কিছু দিক তুলে ধরা হলেও, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও ইতিবাচক পরিবর্তনের দিককে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষভাবে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী সুরক্ষা ও উন্নয়নের প্রতি অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নারীদের অধিকার ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এই সরকার, যা নিবন্ধটিতে অঙ্কিত বিবর্ণ চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।
এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ- ‘যুব উৎসব ২০২৫’, যেখানে দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লাখ মেয়ে ৩ হাজার ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ইভেন্টে অংশ নিয়েছে। এ উৎসবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী ও সুবিধাবঞ্চিত নারীসহ সবার ব্যাপক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে নারী ও মেয়েদের উজ্জ্বল ও দৃঢ় সম্পৃক্ততার প্রতিফলন।
একটি ফুটবল ম্যাচ বিরোধিতার মুখে পড়া মানে ২ হাজার ৯৯৯টি সফল আয়োজনের সফলতা নিশ্চিন্ন হয়ে যাওয়া নয়, যেখানে অগণিত মানুষ ও গোষ্ঠী উৎসব করেছে।
কেবল একটি আয়োজনে প্রতিবন্ধকতার উপর জোর দিলে, সেটা দেশের যুব সমাজ, বিশেষ করে নারীদের প্রাণস্পন্দন ও সংকল্পের সঠিক প্রতিফলন ঘটায় না।
আরেকটি দাবি হল, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর অবস্থান নেননি’। এটা কেবল মিথ্যা নয়, বরং আজীবন নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তিনি যে লড়াই করেছেন তার প্রতি অবমাননা।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ইউনূস নারীদের অধিকারের পক্ষে অবিচল রয়েছেন। দুই মেয়ের পিতা ইউনূস নারীশক্তির উপর ভর করে তার পুরো কর্মজীবন ও গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তুলেছেন, যার ফল হিসেবে মিলেছে নোবেল পুরস্কার।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি লাখ লাখ নারীকে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
দুই কন্যার পিতা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস সবসময় নারীর অধিকার ও নিরাপত্তার পক্ষে সোচ্চার থেকেছেন। নারীর অধিকার এগিয়ে নেওয়া এবং তাদের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি তার কাজ ও সুনামের ভিত্তি।
২. ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করা
বাংলাদেশের মত দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় সহিংসতার মধ্যে পার্থক্য করা জরুরি। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু সংঘর্ষ হয়, যেগুলোকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাস্তবে এগুলো ছিল রাজনৈতিক প্রকৃতির।
সমর্থন আদায়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো প্রায়শ ধর্মকে ব্যবহার করে। এটি পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় নিপীড়ন হিসেবে গুলিয়ে ফেলার ঝুঁকি তৈরি হয়। রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে পুরো পরিস্থিতিতে সাম্প্রায়িক সংঘাত হিসেবে চিত্রায়ণ বিভ্রান্তিকর।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতির স্পষ্ট করেছে। এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান কার্যক্রম এবং সন্ত্রাস মোকাবেলায় নেওয়া উদ্যোগ, সেই প্রতিশ্রুতির প্রকাশ ঘটাচ্ছে।
সামাজিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে উগ্রবাদ মোকাবেলায় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদ্যোগকে অপতথ্যের মাধ্যমে ম্লান করে দেওয়া উচিত হবে না।
৩. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের উত্থান
বাংলাদেশ বর্তমানে এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। গত সাত মাসে দেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল রয়েছে এবং টাকার বিনিময় হার ১২৩ টাকা প্রতি ডলারে স্থির রয়েছে।
২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হয়ে উঠবে। প্রধান উপদেষ্টা গত আট মাস ধরে নিরলসভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। সম্প্রতি তার চীন সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান পেয়েছে।
এছাড়া আগামী সপ্তাহে ঢাকায় ‘ইনভেস্টরস কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে ৫০টি দেশের ২ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেবেন। এতে মেটা, উবার, স্যামসাং এর মত বৈশ্বিক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
৪. বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভূমিকা
বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য অবারিত সুযোগের প্রতিশ্রুতিকে সঙ্গী করে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নীরবে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে।
সব ধরনের ঝামেলার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়েছে, যাতে অভাবনীয় সহনশীলতা দেখা যাচ্ছে। গত সাত মাসে বাংলাদেশের প্রায় ১২ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মধ্যেও ব্যাংকিং খাত ঠিকঠাক রয়েছে এবং প্রতি ডলারে ১২৩ টাকার কাছাকাছি স্থিতিশীল আছে দেশীয় মুদ্রা।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে উন্নীত হতে যাচ্ছে এবং ২০৩০ সালে নবম শীর্ষ ভোক্তা বাজার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূসের গত আট মাসের কাজের স্বীকার কোথায়? বাংলাদেশের জন্য উন্নত ভবিষ্যতের আশায় তিনি পৃথিবীকে এফোড়-ওফোড় করছেন। গত সপ্তাহে তার চীন সফরে দেশটির সরকার ও ব্যবসায়ীরা ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান হিসেবে বাংলাদেশে ২১০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আগামী সপ্তাহে বিনিয়োগ সম্মেলন করতে যাচ্ছে ঢাকা, যেখানে ৫০টি দেশের ২৩০০ এর বেশি মানুষ অংশ নেবেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছে মেটা, উবার, স্যামসাংয়ের মত শীর্ষ কোম্পানি কর্মকর্তারাও। উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে বিশ্ব। এটি আশা, শক্তি ও অভূতপূর্ব সুযোগের এক গল্প—যেটা সম্মানের সহিত কথনের এবং প্রয়োজনীয় মনোযোগ পাওয়ার অধিকার রাখে।
৫. অতি সরলীকরণ ও জাতির অবমাননা পরিহার
নিবন্ধটিতে হাতে গোনা কয়েকটি ঘটনার উদাহরণ টানা হয়েছে, যার মধ্যে দেশ উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হওয়ার বিষয় চিত্রায়ন করতে এক নারীকে বাজে আচরণকারী ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়ার ঘটনা টানা হয়েছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল বিভ্রান্তিকর নয়, ক্ষতিকারকও বটে। ১৮ কোটি মানুষের দেশে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে পুরো জাতির মূল্যায়ন বিবেকবর্জিত। সহনশীলতা, সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল চিন্তার সমৃদ্ধ ইতিহাসের ধারায় বাংলাদেশের রয়েছে বহুমুখী ও অগ্রসরমান সমাজ।
কেবল বাংলাদেশ ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলা করছে না, এই বৈশ্বিক ইস্যু বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে মোকাবেলা করছে।
বাংলাদেশও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগসহ বিভিন্নভাবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অব্যাহতভাবে কাজ করছে।
মুসলিম, হিন্দু, খ্রীস্টান কিংবা অন্য যে কোনো সম্প্রদায়—পুরো বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার প্রতিশ্রুতিতে দেশ অবিচল আছে।
উগ্রপন্থিরা সবসময় সমাবেশ এবং সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণা ছড়াতে চাইবে। তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যে অক্সিজেন দরকার, সেটা না দেওয়াই আমাদের দায়িত্ব।
পাশাপাশি উগ্রবাদের উত্থানকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেখানোর ধারণা খুবই পূর্বধারণাপ্রসূত। উগ্রবাদী মতবাদের উত্থানকে ঠেকানোর জন্য দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ জোরালো শক্তি হিসেবে রয়েছে।
চ্যালেঞ্জ আছে তবুও বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদী পথরেখা কেবল উগ্রবাদীদের কার্যক্রমের ধারা নির্ধারিত হবে না। ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গঠনের লড়াই চালিয়ে নিতে বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে যুব সমাজ ও নারীরা অবিচল রয়েছে।
সবশেষে বাংলাদেশের সহনশীলতার ইতিহাস, গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি দৃষ্টিপাত- এগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কেবল কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনার উপর ফোকাস না করে, আমাদের উচিত হবে বর্তমান বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়নকারী অগ্রগতি, সহনশীলতা ও সংকল্পের বৃহত্তর ছবিকে স্বীকৃতি দেওয়া।