“আমি যদি এটা করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের অনেক মেধা আছে, তারাও সেটা করতে পারবে”, বলেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এই ডিজাইনার।
Published : 08 Jul 2024, 12:22 AM
বাংলাদেশের কোনো নারী ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারে, এমন ধারণা করাই যখন ছিল দুরূহ, সত্তরের দশকে বিবি রাসেল সে বিষয়ে পড়তে গেলেন লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশনে।
ফ্যাশনের ব্যাকরণ জেনে বর্নিল রঙের কারুকাজে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন ছিল তার; ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন মডেলও, হয়ে উঠলেন ভোগ, কসমোপলিটান, মেরি ক্লেয়ারসহ বহু ফ্যাশন সাময়িকীর মুখ।
ফ্যাশনের যে ধারা নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা ছিল নিজের মধ্যে বাঙালিত্বকে আপাদমস্তক ধারণ করা এই নারীর, ইউরোপ-আমেরিকায় ফ্যাশনের আলো ঝলমলে জগৎ ছেড়ে তিনি সেই সেখানেই ফিরলেন।
দেশে ফিরে নিজ নামে লেবেল তৈরি করে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি ফ্যাশনকে তিনি ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে, ৭৪ বছর বয়সেও সেই কাজে পথ চলছেন অবিরাম। আর নিজের পথচলায় সঙ্গী করেছেন দেশের আনাচে-কানাচের কারুশিল্পীদের।
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার সেই কারিগরদের হাতে ‘জাদু’ দেখার অভিজ্ঞতা বিনিময় করে বিবি রাসেল বলছেন, ফ্যাশনে সাফল্যের শিখরে উঠতে পারে, এমন ‘মেধা’ বাংলাদেশে রয়েছে। তবে, তাদের এগিয়ে নিতে প্রয়োজন আর্থিক ও নানা ধরনের সহযোগিতার।
বিশ্ব ফ্যাশনে জায়গা করে নেওয়ার মত বাংলাদেশে অনেক কিছুই আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নিজের ডিজাইনে যা কিছু ব্যবহার করেন, সব কিছু দেশীয় হওয়ার কথা তুলে ধরে বিবি রাসেল বলেন, “ডিজাইনার হিসাবে তারা যখন আমার নাম জানে, তারা বাংলাদেশকে জানে। আপাদমস্তক যা কিছু বানাই, সবকিছু বাংলাদেশের। সুতরাং বাংলাদেশের সব কিছু আছে। বাংলাদেশ হচ্ছে সোনার খনি।”
বাংলাদেশে মেধাবী তরুণ আছে জানিয়ে তিনি তাদেরকে গড়ে তোলার জন্য সহযোগিতার কথাও বলেন। সেই সঙ্গে তরুণদের দিয়েছেন পথের দিশা।
বিবি বলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চান, আপনাকে অন্যান্য কিছুও দেখতে হবে এবং বিশ্বব্যাপী কী ঘটছে তা জানার জন্য প্রচুর পড়তে হবে।”
সাফল্যের জন্য যে পরিশ্রম করতে হবে, সেটিও তুলে ধরেন তিনি। নিজের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “ঢাকায় থাকলে আমি অনেক রাত কাজ করি। যখন আমি ঘরে ফিরি, তখন ভাবি আগামীকাল কী করব। হয়ত আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঘুমাই এবং আমি দীর্ঘ ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করি।
“পরদিন সকালে যখন আমি ঘুম থেকে উঠি, সেটা আমাকে অভিভূত করে; কারণ তারা (কারিগর) অবিশ্বাস্য কাজ করছে।”
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ইনসাইড আউট আলোচনা অনুষ্ঠানে ফ্যাশন জগতের সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে নিজের জড়িয়ে যাওয়া, পৃথিবীর নানাপ্রান্তে কাজের অভিজ্ঞতা আর বাংলাদেশের হাল আমলের ফ্যাশন নিয়ে কথা বলেছেন বিবি রাসেল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওয়েবসাইট, ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে রোববার ইংরেজি ভাষায় তার ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া বিবি রাসেল বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুল এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পাঠ চুকিয়ে তিনি পড়তে যান লন্ডন কলেজে অব ফ্যাশনে।
১৯৭৬ সালে সেখান থেকে স্নাতকোত্তর করার পর ঘটনাচক্রে মডেলিংয়ে নাম লেখান। এরপরের শীর্ষ মডেল হিসাবে তিনি কাজ করেছেন ইভ স্যঁ লরাঁ, কেনজো, কার্ল লেগারফিল্ড, জর্জিও আরমানি, জন পল গোটিয়ের, ইসি মিয়াকে-এর মতো বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে।
কিন্তু সেই জগৎ ছেড়ে ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে আসেন বিবি, পরের বছর বাংলা তাঁতের ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্য নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বিবি প্রোডাকশন’।
এ অঞ্চলের চিরাচরিত ফ্যাশন তুলে ধরতে তার উদ্যোগ নজর এড়ায়নি ইউনেস্কোর; সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক ফেডেরিকো মায়রের আমন্ত্রণে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে ১৯৯৬ সালে নিজের ব্র্যান্ডের প্রথম ইউরোপীয় শো করেন বিবি রাসেল।
এর কয়েক বছর পর ১৯৯৯ সালে তাকে ‘ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট’ বিষয়ক বিশেষ দূত হিসাবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো।
গামছার রঙ দেখে ‘স্বপ্ন’ বোনা
নানা রঙে আঁকাআঁকি করলেও শৈশবে বিবি রাসেলের চোখ আটকে যেত পুরান ঢাকার বাড়িতে ফল কিংবা সবজি বিক্রি করতে আসা নারী-পুরুষদের পোশাকের রঙে দেখে, বিশেষ করে গামছায়।
ফ্যাশন নিয়ে কাজ করার ‘স্বপ্নটা’ এভাবে ছোটোবেলাতেই বোনার কথা তুলে ধরেছেন বিবি রাসেল; নিজের ডিজাইনে প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের ঐতিহ্যকেই ধরে রাখার কথা বলছেন তিনি।
বিবি রাসেল বলেন, “আমার কালার পেন্সিল-আঁকাআঁকির সবকিছু ছিল। আমি আমার বাবা-মাকে বলতাম, দেখো রঙের সংমিশ্রণ তাদের মধ্যে বেশি। আমার স্বপ্ন সেখান থেকে শুরু হয়েছিল।”
নিজের কাজে সব সময় কৃত্রিম কোনো কিছু ব্যবহার না করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি যা করি তার সবটাই হাতে তৈরি। কারণ, আপনি যদি আমাদের বাংলাদেশ অংশের ইতিহাসের দিকে যান, পাকিস্তান আমল কিংবা তারও আগে, আমরা হাত দিয়ে তৈরি করার ক্ষেত্রে বিখ্যাত ছিলাম।
“ব্রিটিশ আমল বা তারও আগে, বৃহত্তর ভারতে মসলিনের মত চমৎকার কাপড় ছিল, যেটার এক মিটারকে আংটি বা ম্যাচ বক্সের ভেতরে ঢোকোনো যেত।”
সেই কারিগররা ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকতে পারে না’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সে কারণে কেবল কারিগরদের সঙ্গে কাজ করার জন্য আমি ফিরে এসেছি। কেবল কাপড় নয়, যেটাতে আমরা বিখ্যাত ছিলাম সে সব ধরনের কারুশিল্পের জন্য। অবশ্যই, আমি যা কিছু বানাই না কেন, সবকিছুই বাংলাদেশে তৈরি।”
পোশাক তৈরিতে এগিয়ে থাকলেও ডিজাইনিংয়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, লেখকদের লেখার মত ডিজাইনারদের কাজেও তাদের সৃষ্টির ছাপ থাকে।
“সুতরাং প্রত্যেক ডিজাইনারের তাদের হাতে ছাপ থাকা উচিত। যেভাবে মানুষ বলতে পারে, এটা আরমানির, ভার্সাকি, জন পল গোটিয়ের বা ইসি মিয়াকের। আমি মনে করি, আমাদেরকে ডিজাইনার তৈরি করতে হবে, যাদের হাতের ছাপ আছে। এরপর তারা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃতি পাবে।”
‘মেধা আছে, সহযোগিতা দরকার’
এক প্রশ্নে বিবি রাসেল বলেন, বাংলাদেশে অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তবে তাদের পরিচর্যার পাশাপাশি আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা দরকার।
তিনি বলেন, “তৈরি পোশাক শিল্প বিপুল পরিমাণে তৈরি করছে কিন্তু ডিজাইনাররা তেমন তৈরি করছে না। আমি ১৯৯৪ সালে ফিরেছি, এটা ২০২৪। আমার লেবেল স্বীকৃত- বিবি রাসেল, এটা ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিলের স্বীকৃত। কারণ, আমি একটা ফ্যাশন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি যোগ্যতা সম্পন্ন ডিজাইনার। আপনাকে স্বীকৃতি পেতে হবে।
“ডিজাইনারের পেছনে অনেক অর্থের যোগ থাকে। কিন্তু আমি যেটা করছি, সেটা কেবল নিজের পয়সায়। অর্থনৈতিকভাবে হয়ত আমি সফল নই, তবে সারা বিশ্ব থেকে আমার লেবেলের স্বীকৃতি আছে।”
বিবি রাসেল বলেন, “আমি যদি এটা করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের অনেক মেধা আছে, তারাও সেটা করতে পারবে। বিবি রাসেল ব্র্যান্ডের কপিরাইট আছে, আমি স্বীকৃত। আমি সেটা ইউরোপে করেছি।”
বাংলাদেশে প্রদর্শনী বা ফ্যাশন শো তেমন করেন না বলে মন্তব্য করে বিবি রাসেল বলেন, “অন্য দেশে আমি সেটা করি, কেননা আমার স্পন্সররা আছে।
“আপনি জানেন, কারিগরদেরকে মর্যাদার সঙ্গে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার জন্য একটা মেয়ে তার সবকিছু, তার পুরো জীবন দিয়ে দিয়েছে। প্রদর্শনীর জায়গা ভাড়া নেওয়া, এটা করা, সেটা করার জন্য তেমন সময় আমার নাই।”
মেধা কাজে লাগাতে কেমন সহযোগিতা দরকার এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য সহযোগিতাও দরকার। যেমন আপনার অনেক কলেজ আছে, বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তারা ফ্যাশন শিক্ষা দিচ্ছে, তাদেরকেকে ফ্যাশনের ব্যাকরণ শেখাতে হবে।”
পুরো ইউরোপ, আমেরিকা, ইতালি, জাপানসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেখানে প্রচুর সংখ্যক ডিজাইনার রয়েছেন। মিলানোতে প্রচুর সংখ্যক ডিজাইনার রয়েছে, ফ্রান্সেও।
“আমাদের অনেক জনসংখ্যা। হয়ত কেউ আমার কালেকশান পছন্দ করছে না, তারা আপনার কালেকশন পছন্দ করতে পারে। স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে থাকে এমন ব্যক্তি মেধাকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি বাংলাদেশ যা করছি, তার সবকিছুই স্থানীয়।”
ফ্যাশন স্কুলে পড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “যথাযথ ফ্যাশন স্কুলে আমি গিয়েছি। ব্যাকরণটা কি আমি জেনেছি। যখন আপনি বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি বা ইতালীয়তে যদি আপনি লেখেন, তাহলে আপনাকে তাদের ভাষাটাকে জানতে হবে। ফ্যাশনেও এমন ব্যাকরণ আছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
মডেলিংয়ে বর্ণিল জগতে যেভাবে
কখনো মডেল হতে না চাইলেও ঘটনাচক্রে সেই পথে নেমে টানা প্রায় ২০ বছর বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় সব ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনান বিবি রাসেল।
লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশনে পাস করা শিক্ষার্থীদের ডিজাইন করা পোশাকে যে প্রদর্শনী তাতে হাজির হন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি, ডিজাইনার, ফটোগ্রাফারসহ অনেকে।
১৯৭৬ সালে নিজেদের গ্র্যাজুয়েশন শোতে পোশাক প্রদর্শনের প্রস্তুতি বিবি রাসেল নিলেও সেটার মডেলিংয়ের বিষয় মাথায় আনেননি। পরের শিক্ষকদের উৎসাহে তার অবস্থান বদলে যায়।
সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “প্রিন্সিপাল ও শিক্ষক ফোন করেন, বলেন, ‘তুমি কি জান, তারা মডেলিংয়ের জন্য তোমাকে চায়?”
“আমি বলেছিলাম, আমি এটা করতে চাই না। তারা আমাকে বসতে বলল এবং আমাকে বুঝিয়েছেন যে, কলেজ তোমাকে ফ্যাশনের মৌলিক ব্যাকরণ শিখিয়েছে। বাকি কাজটা সামনে।”
এরপর প্রথম ধাক্কায় ফ্যাশন ম্যাগাজিন হার্পার্স বাজার-এর জন্য ১৪ পৃষ্ঠার কাজ করেন বিবি রাসেল। এরপর এক বছর ছাপা ম্যাগাজিনের কাজে সুনাম অর্জনের পর তার ডাক পড়ে ফ্যাশন শো করার।
তিনি বলেন, “আপনার বই যখন ভালো, তখন তারা শো-এর জন্য ডাকে। এরপর শো করি, আমার প্রথম শো ছিল ভ্যালেন্টিনা- হাই ফ্যাশন, আল্ট্রা মডার্ন।”
সেই মডেলিং তাকে ‘পরিপক্ব করেছে জানিয়ে বিবি বলেন, এটি বিশ্বকে দেখার এবং অনেক ভাষা শেখার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলা-ইংরেজির পর ফরাসি ও ইতালি ভাষায় সাবলীল তিনি।
“এর আগে আমি বিশ্বকে দেখার সুযোগ পাইনি। আমি বাংলাদেশে জন্মেছি, স্কুলিং বাংলাদেশে ছিল, কলেজের সময় ছিল। মডেলিং আমাকে পরিপক্ব করেছে।“
তিনি বলেন, “মিডিয়া আমাকে বিবি বানিয়েছে। তারা এই কাজের ক্ষেত্রে আমাকে অমূল্য সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং আমি কখনও মডেল হতে চাইনি, আমার স্বপ্ন ছিল না। তবে, আমি অনেক কিছু শিখেছি। সুতরাং আমি কৃতজ্ঞ।”
দেশে ফেরা আর গ্রামীণ কারিগরদের জাদু দেখা
১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে আসার পর নিজের ব্র্যান্ড করার আগে গ্রামীণ কারিগরদের নিয়ে কাজ শুরু করার কথা তুলে ধরেন বিবি রাসেল।
নিজের কাজের সূত্রে ইউনেস্কোর সঙ্গে জড়িত হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “১৯৯৫ সালে আমি ইউনেস্কো মহাপরিচালক ফেডেরিকো মায়োরের টেলিফোন পাই, তিনি আমাকে প্যারিসে ইউনেস্কো সদরদপ্তরে একটা বৈঠকের আমন্ত্রণ জানান।
“এরপর ১৯৯৬ সালে আমি আমার প্রথম ফ্যাশন শো করি ইউনেস্কো সদরদপ্তরে, সেখানে ছিল ‘উন্নয়নের জন্য ফ্যাশন’।”
বিবি রাসেল বলেন, “আমরা যদি গ্রামের মানুষদের শিক্ষিত না করি, তাহলে তারা দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসবে না। কেবল টাকা দিয়ে কাজ হবে না। সুতরাং তারা জানত, আমি আমার কাজ দিয়ে নিশ্চিত করব যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যে কোনো দেশের মেরুদণ্ড। সুতরাং আমি ১৯৯৬ সালে আমি আমার প্রথম ফ্যাশন শো করি প্যারিসে ইউনেস্কো সদরদপ্তরে।”
ওই ফ্যাশন শোতে প্রায় সব রাষ্ট্রপ্রধান এবং স্পেনের রানি আসার কথা তুলে তিনি বলেন, “সেখানে ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্টের সূচনা হয়। বর্তমানে সব দেশ সেটাকে উন্নয়নের একটা উদাহরণ হিসাবে নিয়েছে, কেন?
“আমি জানি না আপনার কাছে ফ্যাশন কী। তবে, আমার কাছে ফ্যাশন হচ্ছে সংস্কৃতি ও দরকারি। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের বিষয় ছিল। আমার কাছে বস্ত্র এক নম্বর। কেননা, বর্তমানে আমরা একুশ শতকে বসবাস করছি।”
একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “মতিঝিল যেখানে আমার অফিস, কেউ যদি নগ্ন বের হয়, পুলিশ তাকে ধরে ফেলবে। আপনার গর্ব ঢাকার জন্য একটা কাপড় দরকার। এর মাধ্যমে আপনি সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতি করেন।
“আপনি যদি বাংলাদেশের দিকে তাকান, কারিগরদের হাতে জাদু আছে। তবে, তাদেরকে আত্মবিশ্বাস, সম্মান ও মানবিক মর্যাদা আপনাকে দিতে হবে।”
কোনো ধরনের স্পন্সর ছাড়া নিজের উপার্জন দিয়ে গ্রাম-বাংলার ফ্যাশন ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, আমরা বুঝতে পারি না যে, ব্যাংক, বেসরকারি, সরকারি খাত থেকে সহযোগিতা দরকার। আমি একই কাজ সবসময় করতে পারব না, আমাদের নতুন কিছু দরকার। নতুন বিষয়ের জন্য আমরা অর্থের দরকার।”
কেবল হাতের কাজে নিবদ্ধ হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি যদি সিনথেটিক কাপড় ব্যবহার করি তাহলে সেটার ডিজাইন অর্গানিক সুতা বা অন্যান্য স্থানীয় কাপড়ের চেয়ে আলাদা হবে। আমি যেটা করছি তা প্রাকৃতিক। আমি সিনথেটিক দিয়ে কখনো কোনো ডিজাইন করিনি।
কোন জায়গায় কোন পরিবেশ কোন সময়ের জন্য কোন ধরনের কাপড় দরকার, সেটার জন্য ফ্যাশনের ব্যাকরণ জানতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
‘আমার দু’পা মাটিতেই’
বিশ্বখ্যাত সব ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করলেও নিজের ‘পা মাটিতে’ থাকার কথা তুলে ধরে নতুন প্রজন্মের মডেলদের কাছেও তেমনটা প্রত্যাশা করছেন বিবি রাসেল।
তিনি বলেন, “আমার জীবনে আমি প্রথম সারির অনেক ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করেছি। ধরুন, আপনি একজন ডিজাইনার আর আমি একজন ডিজাইনার। প্রত্যেকের নিজস্ব ভঙ্গি রয়েছে। আমি যখন আরমানির জন্য কাজ করেছি, এটা ছিল ভিন্ন রকম, ভ্যালেন্টিনো ছিল ভিন্ন।
“আমি মডেলিংয়ের মাধ্যমে বহু কিছু জেনেছি। আমি ফ্রান্স, ইতালি বা জার্মানিতে আগে যাইনি, আমাদের জীবনের একটা সময় ছিল বাংলাদেশে, আমি বাড়ি থেকে শিখেছি, সে কারণে আমার দু’পা মাটিতে।”
বিবি রাসেল বলেন, “আমি মনে করি, আজকের মডেল, আজকের সবকিছুতে আপনাকে ফোকাসড হতে হবে, আপনাকে জানতে হবে, আপনাকে সম্মান করতে হবে এবং আপনার যে কোনো ব্যক্তির প্রতি মানবিক মর্যাদা থাকতে হবে।
“মডেলরা সুপার স্টার নয়, এটা চিন্তা করতে হবে। হয়ত আপনি বিশেষ নজর পান, আপনি সেলিব্রেটি বা অন্য সবকিছু, দিনশেষে আপনি একজন মানুষ। আপনাকে সম্মান জানাতে হবে এবং আপনাকে নিজের দেখভাল করতে হবে।”
তিনি বলেন, “একজন মডেল মতিঝিলে আসবে না ছোট পোশাক পরে। সুতরাং আপনাকে জানতে হবে কখন কোথায় কী পরতে হবে। অনেক শিষ্টাচার ও রীতি আছে, যেটা আপনাকে জানতে হবে।”
মডেলিং করার সময় লুকের বিষয়ে ডিজাইনারের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “মডেল হিসাবে কেবল আমি ইউরোপে কাজ করেছি, বাংলাদেশে করিনি। যদি আরমানি ভাবত, আজকে আমরা কোনো মেকআপ দিব না, শুধু ভেজা চুলে ফটোশুট হবে; এটা তার সৃষ্টি, আমি বলতে পারি না যে ‘না না, আমি এটা পছন্দ করি না’।
“কেমন দেখাচ্ছে সেটার জন্য আমি বেশির ভাগ সময় ক্যামেরা দেখতাম না। এটা আপনাকে আপনার এজেন্ট বলবে, সেটা তার ব্যাপার। প্রথম সারির একজন এজেন্ট আমার ছিল। সুতরাং তারা জানে, আমার কী করা ঠিক হবে না।”
‘গামছা হওয়া উচিত ছিল জাতীয় প্রতীক’
শতভাগ সুতি আর বহুবিধ রকমের ব্যবহারের কারণে গামছাকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরার কথা বলেছেন বিবি রাসেল। গামছার নকশা বহু ধরনের পোশাক বানানোর পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাপী গামছাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
গোসলের ক্ষেত্রে সবসময় গামছা ব্যবহার করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটা শতভাগ সুতি, আপনার ত্বকের জন্য বেশ ভালো।”
গামছার বহুবিধ ব্যবহার এবং একাত্তরে অস্ত্র বহনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সেটা ব্যবহারের কথা তুলে ধরে বিবি রাসেল বলেন, “হয়ত দেখা যায় কেউ বন্দুক বহন করছে, পরনে আছে গামছা, গামছা তো আমাদের প্রতীক হওয়া ছিল। শৈশব থেকেই গামছাতে আমি মুগ্ধ।
“আমি জামদানি, সিল্ক প্রভৃতি দিয়ে শুরু করেছি। তবে বেশিরভাগই গামছা দিয়ে। কেননা, আপনার সম্পদ কম দরকার হয়।”
সারা বিশ্ব গামছা সম্পর্কে জানে জানিয়ে বিবি বলেন, “বহু দেশের রানি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র প্রধান সবাই, ম্যাডোনা, আন্তোনিও বান্দারেস- সবাই গামছা পছন্দ করে।”
বিদেশে কোথাও প্রদর্শনী করতে গেলে গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে গামছা তুলে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সংবাদমাধ্যমের সবাইকে আমি সবসময় গামছা উপহার দিই। তারা এটাকে খুব ভালোবাসে। বহুবিধ রকমের রঙ সেটাতে থাকে।
“গামছা আমার জীবনের অংশ, সবসময় আমার সংগ্রহের অংশ হিসাবে থাকবে। পুরো সময়জুড়ে আমার সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য হচ্ছে গামছা।”
কৃতিত্ব বাংলাদেশের কারিগরদের
তিনি যা-ই তৈরি করি না কেন, তা বিক্রি হয়ে যায় জানিয়ে এর কৃতিত্ব কারিগরদের দিলেন বিবি রাসেল।
তিনি বলেন, “আপনি আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। কিন্তু আমার পেছনে লাখ লাখ মানুষ আছে, কারিগররা। সুতরাং কৃতিত্বটা যায় বাংলাদেশের কারিগরদের প্রতি। তাদের কাজ সারা পৃথিবীতে প্রশংসা পাচ্ছে। আমি খুব সামান্যটা করেছি।
“গ্রামীণ মানুষের ভালোবাসা ও অনুরাগের কারণে আমি এখানে। আর আমার টিমের সবাই সাধারণ মানুষ। তারা আমার দ্বারা প্রশিক্ষিত।”
ধরিত্রী দিবসের জন্য ইউনেস্কোর শুভেচ্ছাদূত হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি পৃথিবীর জন্য ডিজাইনার।”