“জীবদ্দশায় আমি মেট্রোরেল দেখে যাব- এটা আশা করি নাই। আমাদের ইয়াং জেনারেশন আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবে,” বললেন অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা।
Published : 05 Nov 2023, 06:31 PM
ব্যক্তিগত গাড়িতে চেপে রোজ ঢাকার ফার্মগেট থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যেতে হয় চিকিৎসক উম্মে নাজমিন ইসলামকে। তবে অবরোধের দিন ফিরে আসায় সেই গাড়িতে নিরাপদবোধ করছেন না এই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। এ কারণে রোববার সকালে তিনি বাহন হিসেবে বেছে নেন মেট্রোরেল।
নাজমিন বলছিলেন, “গতকাল সন্ধ্যায় ৩ থেকে ৪টা বাসে আগুন ধরানো হয়েছে। সেজন্য আজকে আর রিস্ক নিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হলাম না, মেট্রোতে যাচ্ছি।
“কারণ এর আগে আমার মেট্রোতে ওঠা হয় নাই। তাই ভাবলাম এই সুযোগে প্রথমবারের মতো মেট্রোতেও চড়া হবে, সেই সাথে অবরোধের গণ্ডগোল থেকে নিজেকে সেইফও রাখা হবে।"
ফার্মগেট স্টেশন থেকে নাজমিন যখন গন্তব্যে রওনা হন, তখন ট্রেনের ভেতরেই তার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল।
সচিবালয় স্টেশনে নামবেন জানিয়ে তিনি বললেন, “আজকে তো অনেক ভিড়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে। তবুও ট্রেনের ভেতর এসি থাকায় এবং যাওয়ার পথে জ্যাম না পড়ায় কষ্ট লাগছে না।”
তার সঙ্গেই হাসপাতালে যাচ্ছিলেন সহকর্মী শারমিন আক্তার। তিনি ট্রেনে উঠেছিলেন উত্তরা থেকে, তবে কাকতালীয়ভাবে নাজমিনকে পেয়ে যান সহযাত্রী হিসেবে।
শারমিন বললেন, “আমি উত্তরা থেকে উঠেছি। আজ গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। কারণ রাস্তাঘাট নিরাপদ না। আর মেট্রোতে মাত্র ৩০ মিনিটে সচিবালয়ে যাব। সেখান থেকে রিকশায় করে হাসপাতালে। ভাবছি- এরপর যখন ট্রেন পুরোপুরিভাবে চালু হবে, তখন মেট্রোতেই আসা-যাওয়া করব। গাড়ি উত্তরায়ই থাকবে।
“আসলে সকালবেলা যদি বাসা থেকে গাড়ি করেও বের হই, কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। আর বিকালে বাসায় ফেরার সময় তো তিন-চার ঘণ্টায়ও পারি না।”
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা দ্বিতীয় দফার অবরোধ শুরু হয়েছে রোববার সকাল ৬টা থেকে। তবে আগের রাতেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত দশটি বাস ও একটি প্রাইভেট কারে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আর রোববার অবরোধ চলাকালেও রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।
এমন সময়ে কর্মস্থলে যেতে ‘নিরাপদ বাহন’ হিসেবে মেট্রোরেলকে বেছে নিয়েছেন শারমিন-নাজমিন; তবে এ বাহনের অভিজ্ঞতা নিতেও বের হয়েছে অনেকেই।
তাদেরই একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মোহাম্মদ জামাল হোসেন বললেন, “আমি আজ ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। তখন মনে হলো, একটু মেট্রোরেলে চড়ি। তারপর ১০০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে উত্তরা থেকে মতিঝিল আসলাম ৩০ মিনিটে। এখন আবার আমি ১০০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে উত্তরা যাচ্ছি।
“মেট্রো রেলের পরিবেশ খুব ভালো। বিশেষ করে মহিলাদের জন্য এবং আমার মতো বয়সীদের জন্য- যারা বাসে উঠতে পারে না। কারণ বাসে উঠলে ধাক্কাধাক্কি হয়, কাপড়চোপড় নষ্ট হয়, মোবাইল চুরি হয়।”
দেশের প্রথম মেট্রোরেল লাইন এমআরটি-৬ এর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালু করা হয়েছিল গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর। এর ১০ মাস সাত দিনের মাথায় শনিবার ওই লাইনের মতিঝিল অংশ উদ্বোধন করা হয়।
পরদিন থেকে মাত্র আধা ঘণ্টায় রাজধানীর উত্তরা থেকে রওনা হয়ে মতিঝিলে পৌঁছাতে পারছেন নগরবাসী।
গর্বের সুরে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামাল বলছিলেন, “জীবদ্দশায় আমি মেট্রোরেল দেখে যাব- এটা আশা করি নাই। আমরা যা দেখছি, তাতেই খুশি। আমাদের ইয়াং জেনারেশন আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবে।
“তিন ঘণ্টায়ও উত্তরা থেকে মতিঝিলে আসতে পারি নাই। আর এই মেট্রোর কারণে আজ ৩০ মিনিটে চলে আসতে পারছি। এটা অবিশ্বাস্য!”
ঢাকায় অসহনীয় হয়ে ওঠা যানজট নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার। ২০ বছর মেয়াদি (২০০৪-২০২৪) ওই পরিকল্পনায় মেট্রোরেল, বাসভিত্তিক উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা-বিআরটিসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ আসে।
এর মধ্যে একটি লাইনের সুবিধা নিতে পারছেন নগরবাসী। এরইমধ্যে এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর রুট) ও এমআরটি লাইন-১ নামে আরও দুইটি লাইনের কাজ শুরু হয়েছে। সরকার বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা সবমিলিয়ে ছয়টি লাইন চালু করতে চায়।
এখন যে লাইনটি পূর্ণমাত্রায় চালু হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা জেরিন আফরিন বললেন, “আমি মাত্র ৩০ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল আসলাম আজ। আগে আমি ৭টার সময় রওনা দিলেও সময় মতো অফিসে ঢুকতে পারতাম না। আর এতদিন আমি সিএনজিতে যেতাম, যেটা আমার জন্য খুব এক্সপেন্সিভ ছিল। এবার থেকে শান্তি।
“তাছাড়া সবমিলিয়ে দেশের যা অবস্থা এখন, তাতে মেট্রোরেলে যাতায়াত করাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হচ্ছে। খুব বেশি খুশি হতাম, যদি রাত পর্যন্ত মেট্রোরেল চলতো। কারণ আমাদের ব্যাংকের ক্লোজিং হতে হতে তো সন্ধ্যা ৬-৭টা বেজে যায়।”
বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হয়ে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলছে মেট্রোরেল। আর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে চলাচল করা যাচ্ছে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।
মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের সময় মিরপুরের বাসিন্দারা যে দুর্ভোগের শিকার হন তা উবে গেছে স্বস্তির বাহনে চড়ার পর।
রাজীব আহমেদ নামের এক যাত্রী বললেন, “ফার্মগেট থেকে বাসে করে মিরপুরে যেতে অন্তত ৪০ মিনিট সময় লাগে। ভিআইপি মুভমেন্ট পড়লে তো কথাই নাই। সেখানে কি না এখন ৩০ মিনিটের মাঝে মতিঝিল থেকে উত্তরা যেতে পারবে মানুষ।”
মতিঝিল চলাচলের সময় দ্রুত বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “এই মেট্রোরেলের জন্য সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ভোগ করছি আমরা মিরপুরবাসী। কিন্তু এত বছরেও দিনভর মেট্রো চালাতে পারছে না সরকার। এটা মানা যাচ্ছে না।
“যেমন আজকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত নাকি রেল চলবে। আমরা চাই সকাল ৬টা থেকে অন্তত রাত ১২টা পর্যন্ত মেট্রো রেল চলুক।”
বেলা সাড়ে ১১টায় মতিঝিল স্টেশনের প্রবেশপথ বন্ধ করে দিলে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন।
চা বিক্রেতা মোজাম্মেল হক সকালের বিক্রিবাট্টার চাপ সামলিয়ে স্টেশনে এসে দেখলেন গেইট বন্ধ।
তিনি বলেন, “এখানে আইসা শুনলাম, সাড়ে ১১টা পর্যন্ত নাকি মেট্রোরেল চলবে। এটা কোনো কথা? ভাবলাম প্রথমদিন ট্রেনে চড়ব, পারলাম না।”
মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনাকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, উত্তরা অংশের মতো মতিঝিল অংশেও ট্রেন চলাচলের সময় ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে। তিন মাসের মধ্যে মাঝের সব স্টেশনও চালু হবে।
আরও পড়ুন:
ফার্মগেট থেকে মতিঝিল মেট্রোরেলে প্রথম দিন