গোয়েন্দা পুলিশ ২০১৫ সালে ঢাকার পল্টন থানায় এ মামলা দায়ের করে।
Published : 17 Aug 2023, 08:49 PM
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের’ মামলায় শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমানসহ পাঁচজনকে দুই ধারায় সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূর বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আসামিদের মধ্যে শফিক রেহমান যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক। খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান ছিলেন বন্ধ হয়ে যাওয়া আমার দেশের সম্পাদক।
দণ্ডিত অপর তিন আসামি হলেন জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন, তার ছেলে রিজভী আহাম্মেদ ওরফে সিজার এবং যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ভূঁইয়া।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা জয়ের গোপন তথ্যের জন্য এফবিআইএর এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার অপরাধে আট বছর আগে সিজারকে সাজা দেয় নিউ ইয়র্কের একটি আদালত। এরপর ২০১৫ সালে ঢাকার পল্টন থানায় এ মামলা দায়ের করে পুলিশ।
২০১৮ সালে গোয়েন্দা পুলিশ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিলে তাদের বিচার শুরু করে আদালত। সজীব ওয়াজেদ জয়কে ২০২২ সালের নভেম্বরে আদালতে গিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্যও দেন।
বৃহস্পতিবার আসামিদের অনুপস্থিতিতেই বিচারক রায় ঘোষণা করেন। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুর রহমান খান কাজল আদালতপাড়ার সাংবাদিকদের বলেন, অপহরণের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩৬৫ ধারায়ে আসামিদের সবাইকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। জরিমানার টাকা অনাদায়ে তাদের আরও এক মাসের কারাভোগ করতে হবে।
একই আইনের ১২০-খ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের দায়ে আসামিদের প্রত্যেককে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
বিচারক রায়ে বলেছেন, আসামিদের দুই ধারার সাজা একসঙ্গে চলবে। ফলে তাদের সব মিলিয়ে ৫ বছরের সাজা খাটতে হবে।
মামলা বৃত্তান্ত
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মামুন বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাসাসের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি এবং যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন। পরিবার নিয়ে কানেটিকাটের ফেয়ারফিল্ড কাউন্টিতে বসবাস করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। তার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত গোপন তথ্য পেতে এফবিআইএর এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার অপরাধে ২০১৫ সালের ৪ মার্চ মামুনের ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারকে সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় নিউ ইয়র্কের একটি আদালত।
সিজার আদালতের রায়ে কারাগারে যাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়।
এরপর জয় ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন, “আমাকে যখন কেউ হত্যার চেষ্টা করছে, সেটিও তখন আমি খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে নিচ্ছি। যারা এর জন্য দায়ী, তারা বিএনপির যতো উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বই হোক না কেন, আমি তাদের হদিস বের করে বিচারের মুখোমুখি করব।”
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের নথিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ক্ষতি করার জন্য তার ব্যক্তিগত তথ্য পেতে সিজার এফবিআইয়ের এক এজেন্টকে ঘুষ দিয়েছিলেন।
ঘুষ দিয়ে তথ্য পাওয়ার পর সিজার তা বাংলাদেশি এক সাংবাদিককে সরবরাহ করেছিলেন এবং বিনিময়ে প্রায় ৩০ হাজার ডলার পেয়েছিলেন বলেও নথিতে উল্লেখ করা হয়।
ওই রায়ের পর জয়কে অপহরণের চক্রান্তের অভিযোগে ২০১৫ সালের ৩ অগাস্ট গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৭ ও ১২০ (বি) ধারায় ঢাকার পল্টন থানায় এই মামলা দায়ের করেন।
সেখানে বলা হয়, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আগে মামুনসহ বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত অন্যান্য দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা রাজধানীর পল্টনের জাসাস কার্যালয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার একত্রিত হয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
২০১৬ সালের এপ্রিলে শফিক রেহমানকে তার ইস্কাটনের বাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সে সময় দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বিএনপিঘনিষ্ঠ এই সম্পাদককে।
ইস্কাটনে তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে সে সময় গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, জয় সংক্রান্ত ‘কিছু তথ্য ও গোপনীয় নথিপত্র’ সেখানে পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান সে সময় দাবি করেছিলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিক’ হিসেবে নিবন্ধ লেখার জন্যই তার স্বামী ওই তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।
পাঁচ মাস কারাগারে থাকার পর সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে মুক্তি পান যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক। পরে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান।
আরেক আসামি খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহের এক মামলায় ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকার কারওয়ান বাজারে আমার দেশ কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার হন। পরে কারাবান্দি অবস্থায় ২০১৬ সালের এপ্রিলে তাকে জয়কে অপহরণ ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তখনকার অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সে সময় বলেছিলেন, “মাহমুদুর রহমান একজন মানুষের (জয়) গতিবিধি, তার কর্মক্ষেত্র, পরিবারের সদস্যরা কখন কোথায় কী করছে এই সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য পেয়েছিলেন মিল্টনের (সিজারের বন্ধু মিজানুর রহমান ভূঁইয়া) কাছ থেকে। এটি একজন মানুষকে অপহরণ করার জন্য যথেষ্ট।”
সিজার তার বন্ধু মিল্টন ভূঁইয়ার মাধ্যমে ওই সব তথ্য ঢাকায় মাহমুদুরকে পাঠিয়েছিলেন বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সে সময় জানিয়েছিলেন।
সাড়ে তিন বছর জেলে থাকার পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে মাহমুদুর রহমান জামিনে মুক্তি পান। পরে তিনিও লন্ডনে চলে যান।
তদন্ত শেষে গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হাসান আরাফাত ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
সেখানে জয়কে অপহরণ করে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়। আর আসামি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের বিরুদ্ধে আনা হয় পরামর্শদাতা হিসেবে ওই ষড়যন্ত্রে সহযোগিতার অভিযোগ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মামুনের ছেলে রিজভী আহাম্মেদ যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের কাছ থেকে সজীব ওয়াজেদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেন এবং পরে তা অন্য আসামিদের সরবরাহ করেন। আর প্রবাসী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান এই ষড়যন্ত্রে অর্থ যোগানোর পাশাপাশি পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
সাক্ষ্যে কী বলেছিলেন জয়
অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরুর পর সজীব ওয়াজেদ জয়সহ মোট ১২ জন রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের কোনো আইনজীবী সাক্ষীদের জেরা করার সুযোগ পাননি।
অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূরের আদালতে উপস্থিত হয়ে ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন জয়। সেদিন তিনি কী বলেছিলেন, পরে তা সাংবাদিকদের জানান আইনজীবী নজিবুল্লাহ হিরু।
তিনি সেদিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টএমন্ট অব জাস্টিস থেকে ফোন পাওয়ার কথা সজীব ওয়াজেদ জয় তার সাক্ষ্যে বলেন।
“তিনি বলেন, এফবিআইয়ের দুই কর্মকর্তা তার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ায় তিনি সেখানে যান। এফবিআই কর্মকর্তা জানতে চান রিজভী আহমেদ সিজার এবং মাহমুদউল্লাহ নামের কাউকে তিনি চেনেন কিনা? জয় বলেন, তিনি চেনেন না। পরে তারা প্রশ্ন করেন, শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমান নামের কাউকে চেনেন কিনা। সজীব ওয়াজেদ জয় উত্তরে বলেন, তাদের ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও নাম জানেন।
“তখন এফবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা তাকে বলেন, তারা একজনকে আটক করেছেন, তিনি এফবিআই এজেন্ট রর্বাট লাস্টিক। তিনি রিজভী আহমেদ সিজার গংদের কাছ থেকে ৪০ হাজার ডলার ঘুষ নিয়েছেন টাইম টু টাইম সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যক্তিগত তথ্য, তার অবস্থান জানানোর জন্য এবং প্রতিমাসে আরো ৩০ হাজার ডলার পাবেন বলে সিজারদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।”
জয়ের জবানবন্দির বরাতে নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, “সিজারকে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার করার পর তিনি এফবিআইকে বলেন যে জয়ের ব্যক্তিগত তথ্য তারা নিচ্ছেন জয়কে অপহরণ করে হত্যা করার জন্য। পরে এফবিআই জানায়, সিজারদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এবং জয়কে সেখানে সাক্ষ্য দিতে হবে। তখন জয় তাদের বলেন, তিনি যা জানেন, সেটা আদালতে বলবেন। পরে জয় মার্কিন আদালতে সাক্ষ্য দেন, সেখানে সিজারদের সাজা হয়।”
জয় আদালতে বলেন, “এর আগেও এফবিআই আমাকে সতর্ক্ করে দিয়ে বলেছিল যে আমার জীবনের উপরে যে কোনো সময় আঘাত আসতে পারে, সতর্ক থাকতে হবে। তারা বাসার সামনে সিসি ক্যামেরা লাগানোর পরমার্শ্ দেয়। তারা বলে, যে কোনো বিপদ দেখলে যেন তাদের জানাই। আমি বাসার সামনে অনেক অপরিচিত, অচেনা লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। পরে আমি বাসা পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যাই।”