“নতুন জামা-কাপড় ছাড়া যেমন ঈদ জমে না, তেমনই ঈদের আগে চুল না কাটালে মনে হয় আমেজটা পূর্ণতা পেল না,” বলেন নূর ইসলাম টিপু।
Published : 10 Apr 2024, 12:11 AM
সপ্তাহখানেক ধরেই খদ্দেরের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন রাজধানীর বনশ্রীর ইউনিকর্ন হেয়ার সেলুনের নরসুন্দরেরা; সকাল থেকে রাত ২টা পর্যন্ত চলছে তাদের খুর-কাচির খচখচ শব্দ।
ঈদের আগে নিজেকে আরো সুন্দর আর পরিপাটি করে নিতে সেলুনটিতে ভিড় করছেন অনেকেই। তবে সিরিয়াল পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
বনশ্রীতে দুটি শাখা রয়েছে ইউনিকর্নের। সেলুনটির কর্ণধার তানভীর আহমেদ বলছেন, দিন দিন ছেলেরাও রূপচর্চায় সচেতন হচ্ছেন। ফলে ঈদ উৎসব ঘিরে নিজেকে আরেকটু পরিপাটি করে নিতেই তারা সেলুনে ভিড় করেন।
“ঈদে সবার সঙ্গে দেখা করবে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। এ কারণে সবাই চায় নিজেদের একটু পরিপাটি করে নিতে, আরো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে। যে ড্রেসের জন্য অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছে, কিন্তু নিজের আসল ‘অ্যাসেট’ হল চুল, ফেইস এগুলো। সেটা যদি ঠিক না হয়, তাহলে কিন্তু ড্রেসের ইনভেস্টটা কাজে আসবে না।”
তানভীর জানান, তার দুটি সেলুনে এ মাসের শুরু থেকেই ঈদের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সেলুন খোলা রাখলেও এখন রাখতে হচ্ছে রাত ২টা পর্যন্ত।
এ সেলুনটিতে চুল কাটাতে সাধারণত ১২০ টাকা লাগে। পছন্দের নকশার চুল কাটাতে ১৭০ টাকা, দাড়ি কামাতে ১০০-১৩০ টাকা লাগে। ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় ফেসিয়াল, আর ৪০০ থেকে হাজার টাকায় চুলে রঙ করানো হয়। তাছাড়া যারা চুল বড় রাখেন, তারা চুল রিবন্ডিং ও স্ট্রেইট করাতেও পারেন সেখানে।
এবার চুল রঙ করানো আর ফেসিয়ালের চাহিদা বেশি জানিয়ে তানভীর বলেন, “ঈদের মধ্যে সবাই আলাদা বাজেট রাখছে এগুলোর জন্য।”
পছন্দের নাপিতেই ভরসা
মিরপুরের গ্রিন হেয়ার ড্রেসার সেলুনে দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে চুল কাটাতে এসেছিলেন একটি সিএ ফার্মের কর্মকর্তা রাশেকুর রহমান রাশা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বছরের বড় উৎসবগুলোর একটি ঈদ। এদিন নিজেকে পরিপাটি দেখাতেই ছেলেকে নিয়ে সেলুনে আসা।
“আরো যাতে সুন্দর দেখায়, লুকটা যেন ভালো আসে, এজন্যই আসা। প্রতি বছরই ঈদের আগে চুল কাটাটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।”
৩৫ বছরের ধরে মিরপুরের এ সেলুনে একই কারিগরের কাছে চুল কাটান বেসরকারি চাকরিজীবী মাহফুজ ইসলাম। এবার ঈদের আগেও এসেছেন চুল কাটাতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় মাহফুজ বলেন, “আমার জন্মের পরে প্রথম উনিই চুল কেটেছিলেন, তারপর থেকেই ওনার কাছেই চুল কাটাতে আসি।
“কেন যেন অন্য কারো কাছ থেকে চুল কাটতে অস্বস্তি লাগে! যিনি সবসময় চুল কেটে দেন, তিনিই আসলে ভালো বুঝতে পারেন কোন স্টাইলটা মানাবে।”
ঈদের আগ মুহূর্তে কেন সেলুনে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “ঈদের আগে চুল কাটলে একটু ফ্রেশ লাগে। অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে।”
সোমবার রাতে গ্রিন হেয়ার ড্রেসার সেলুনে গিয়ে দেখা যায়, চুল-দাড়ি কাটাতে অপেক্ষা করছেন বেশ কিছু মানুষ। নরসুন্দরেরা সিরিয়াল অনুযায়ী গ্রাহকদের অপেক্ষায় রাখছিলেন।
সেখানকার কারিগর শাহবুদ্দিন বলেন, “ধরেন, এমনিতে চুল কাটি ১০০ তে; ঈদ উপলক্ষে একটু বকশিস চাই। কারো ইচ্ছা হলে দেয়, নাহলে জোর করি না।”
‘এই সময় কেউ খুচরা টাকা দেয় না’
এবারের ঈদের আগে ব্লেড এক্সক্লুসিভ মেনস সেলুনের বাড্ডা শাখায় চুল কাটিয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাদিক ইভান। ঢাকায় এই সেলুনের ছয়টি শাখা রয়েছে।
ইভান বলেন, “প্রত্যেক ঈদের অন্তত তিন থেকে চারদিন আগে চুল কাটাই। অনেক আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা হয়। অনেক মানুষের সঙ্গে একটা এনগেজমেন্ট হয়। তাদের সামনে নিজেকে একটু পরিপাটি, সুন্দরভাবে প্রেজেন্ট করা…তাই কাটা হয় আর কি?”
অফিসের ব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফেরার আগে যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকা থেকে চুল কাটেন নূর ইসলাম টিপু।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন জামা-কাপড় ছাড়া যেমন ঈদ জমে না, তেমনইভাবে ঈদের আগে চুল না কাটালে মনে হয় আমেজটা পূর্ণতা পেল না।
“ঈদের সময় তারা বাড়তি টাকা চাচ্ছে না, তবে নাপিতদের বাড়তি আবদার থাকে বকশিস। গলাকাটা বকশিসের নামে অন্তত ৪০-৫০ শতাংশ দাম বেড়ে যায়।”
মিরপুরের ভাসানটেকের জয় হেয়ার ড্রেসার থেকে চুল-দাড়ি কাটান অয়ন রহমান। ঈদের সময় সেলুনে গেলে অন্য সময়ের চেয়ে ৫০ বা ১০০ টাকা নরসুন্দররা বেশি চায় বলে অভিজ্ঞতা থেকে জানান তিনি।
অয়ন বলেন, “আমাদের ধর্মেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঈদের নামাজ পড়ার আগে চুল, দাড়ি ছোট করে কামানো। আর রোজার সময় এমনিতেই চুল কাটা হয় না, ফলে রোজার শেষের দিকে চুল বড় হয়ে যায়। এছাড়া চুল, দাড়ি এখন স্টাইলেরও একটা অংশ হয়ে গেছে।”
মিরপুর-১২ নম্বরের আলিফ হেয়ার ড্রেসারের কারিগর সুজন বলেন, “যারা এখানে আসছেন তারা স্বেচ্ছায় টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এই সময়ে কেউ খুচরা টাকা দিচ্ছেন না।
“এখন মানুষ আসতেছে অনেক৷ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি৷ উৎসব, তাই সবাই রূপচর্চা করতে চায়৷”
মিরপুর-১০ নম্বরের ফ্যাশন সিক্সটি নাইনে সাধারণভাবে চুল কাটা যায় ১২০ টাকায়, তবে এর বাইরে বিভিন্ন স্টাইলে কাটতে চাইলে বাড়তি টাকা দিতে হয়। সেলুনটিতে শেইভ করাতে ৮০ টাকা, সাধারণ ফেসিয়ালে ৩০০ টাকা, দাড়ি কামানোতে ৮০ টাকা এবং চুল রঙ করতে লাগে ৫০০ টাকা।
গত শুক্রবার থেকেই ভিড় বাড়ার কথা জানিয়ে ফ্যাশন সিক্সটি নাইনের নরসুন্দর সালমান রহমান বলেন, এই ভিড় চলবে চাঁদ রাত পর্যন্ত।
“কেউ কেউ ঈদের দিন সকালেও চুল কাটতে আসে। তারা তাদের কাজ শেষ করে বকশিস দিয়ে যায়। যার যেমন ইচ্ছা তেমন দেয়। ধরেন কেউ ২৫০ টাকার কাজ করিয়েছে, সে ৫০০ টাকা দেয়। এই সময়ে আর ফেরত চায় না।”
শরীয়তপুরের আরাফাত হোসাইন সবসময় তার এলাকার ‘মায়ের দোয়া’ সেলুনে চুল কাটান। এবার ঈদে চুল কাটানোর সঙ্গে তিনি ফেসিয়াল করেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আরাফাত বলেন, “ঈদ উপলক্ষে সেলুনে চুল কাটা ও ফেসিয়ালের দাম বাড়ানো হয়নি; তবে তারা ঈদ বকশিস নিচ্ছেন। ঈদে একটা নতুন লুক চায় সবাই, ফ্রেশও থাকতে চায়, সেজন্যই স্যালুনে যাওয়া৷
“আর উনারা ৫০ বা ১০০ টাকা বকশিস চান৷ ‘ঈদে যদি না দেন; কখন দেবেন তাইলে’- এমন কথাও তারা বলেন।”
ঈদের সময় খদ্দেরের চাপের কারণে রাত ২টা পর্যন্ত সেলুন খোলা রাখতে হচ্ছে বলে জানান সেলুনটির নরসুন্দর সুব্রত পাল।
তার কথায়, “এখন দম ফেলবার ফুরসত নেই। এত লোক আহে যে মানুষ গমগম করে। চাঁদরাইতে তো পুরা রাইত খোলা রাখতে হইব।”
ফুটপাতে দুর্দিন
শহরের নামিদামি সেলুনে উপচেপড়া ভিড় থাকলেও ‘ভালো নেই’ ফুটপাতের নরসুন্দররা।
২৬ বছর ধরে রাজধানীর পলাশীর ফুটপাতে নরসুন্দরের কাজ করা সুশান্ত কুমার শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিনদিন এখানকার ভিড় কমছে। মানুষের রুচি বদলেছে, যাওয়ায় সবাই সেলুনমুখী হচ্ছে। পকেটে পয়সা টানাটানি থাকলেও ফুটপাতে বসে চুল কাটতে লজ্জা হয় তাদের। গত বছরের চেয়ে এবার মানুষ আরো কম আসতেছে।
“আগে ২০ টাকায় চুল কাটাতাম, তাতে তো আমাদের পোষায় না; ৩০ টাকা করার পর আসা বন্ধ করে দিচ্ছে।”