সকাল থেকে পিবিআই, সিআইডি, ডিএমপির সদস্যরা তদন্তের কাজ করছেন বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোটি কটেজ’ নামের পুড়ে যাওয়া ভবনে।
Published : 01 Mar 2024, 12:08 PM
রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবন নামের যে সাততলা ভবনটি একদিন আগেও ছিল আলো ঝলমলে এবং নানা ধরনের দোকানের ক্রেতা সমাগমে জমজমাট; একদিনের ব্যবধানে সেই ভবন এখন পুড়ে কালো বর্ণের একটি কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চারপাশে পড়ে আছে ভাঙা কাঁচ, বিভিন্ন দোকান রেস্তোরাঁর পুড়ে যাওয়া চেয়ার-টেবিলও আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এমনকি পুড়েছে ভবন লাগোয়া একটি আম গাছের পাতাও। ভবনের এমন চেহারা দেখে থমকে দাঁড়াতে হয়।
শুক্রবার সকালে পোড়া ভবনটির সামনে উৎসুক মানুষের ভিড় দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন এলাকাবাসী, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তারা বলছিলেন চোখে দেখা রাতের ভয়াবহতার কথা।
সকাল থেকে পিবিআই, সিআইডি, ডিএমপির সদস্যরা তদন্তের কাজ করছেন ওই ভবনে। আছেন রাজউক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সিটি করপোরেশনের লোকজনও। কাজের জন্য পুরো ভবনটি ‘ক্রাইম সিন’ লেখা টেপ দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে লাগা আগুনে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। ঢাকা মেডিকেল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটে যাদের চিকিৎসা চলছে, তাদের অবস্থাও শঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
ভবনটির দোতলায় ছিল বিরিয়ানির পরিচিত খাবার দোকান ‘কাচ্চি ভাই’ এর শাখা, পোশাকের ব্র্যান্ড ইলিয়েন, নিচের তলায় স্যামসাং এর শোরুমসহ আরও বেশ কিছু দোকান। স্যামসাংয়ের শোরুমের পাশে রয়েছে একটি কফি শপ। এরকম কফির দোকানসহ ফাস্টফুডের অনেকগুলো দোকান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে ভবনটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আগুন কেড়ে নিল পুরো পরিবারকে, পড়ে রইল ভিসা-পাসপোর্ট
সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে বৃহস্পতিবার বেইলি রোডের এ অংশের খাবার দোকানগুলোতে বরাবরই ভিড় থাকে। এদিন রাতও ছিল অন্য এক রাতের মতই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর খাবারের স্বাদ নিতে কিংবা স্বজনদের সঙ্গে খাবার আনন্দ ভাগ করতে তারা এসেছিলেন ছোট ছোট দলে। সেই আনন্দ আয়োজন এক আগুনে পরিণত হয় বিষাদপুরীতে।
রাত আড়াইটার কিছু পরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর এএসপি কামরুল হাসান বলেন, স্যামসাং শোরুমের পাশের কফি হাউস থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা নিচ থেকে আগুন উপরের দিকে উঠতে দেখেছেন। প্রথমে দোতলায় তারপর তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে যায়।আগুনে পুরো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দৃশ্য রাতের অন্ধকারেও টের পাওয়া যাচ্ছিল বাইরে থেকে।
বেইলি রোডে নওরতন কলোনিতে থাকেন সাহাবুদ্দিন তালুকদার। প্রতিদিনের মতো শুক্রবার সকালে প্রাতভ্রমণের পোশাক পরে বাসা থেকে বেরিয়ে পুড়ে যাওয়া ভবনের কাছে দাঁড়িয়ে যান; বিমূঢ় চোখে দেখছিলেন বিভীষিকাময় ভবনটি।
সাহাবৃদ্দিন বলেন, “রাতে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে, কী হয়েছিল এখানে। বিকট শব্দ আর আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মনে হয়েছে এটা দোজখের আগুন।
“শুনেছি গ্যাস সিলিন্ডারগুলো থেকে আগুনের সূত্রপাত। এভাবে বিল্ডিংয়ে গ্যাস সিলিন্ডার প্রায় দোকানগুলোতেই আছে, চুটিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু মানুষের জীবনের নিরাপত্তার দিকটা দেখার নেই।”
বেইলি রোডের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাসিন্দা শাহিদা খান বলেন, “গ্যাস সিলিন্ডার থেকে এই আগুন। বেইলি রোড এলাকায় এখন বিকাল থেকে বেশি মানুষজন আসেন খাবার খেতে কিংবা আড্ডা দিতে। কিন্তু এভাবে আগুন দেখে আমি আর রাতে ঘুমাতে পারিনি। শুনেছি ওই বিল্ডিংয়ের আটতলায় যেসব মানুষ আটকা পড়েছিলেন তাদের অনেকে মারা গেছেন দম আটকে। ধোঁয়া এতো বেশি ছিল যে, সেখানে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। দেখেন কাচ্চি ভাইয়ের লাগোয়া বড় আম গাছে পাতাগুলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।”
ঘটনাস্থলে থাকা পেশায় শিক্ষক লিয়াকত আলী বলেন, “দেখবেন এখানে বেশিভাগ বিল্ডিংগুলোতে কোনো এক্সিটওয়ে বা সিঁড়ি নেই। এটা ভয়ানক। সরকার আছে, তার বিভিন্ন বিভাগ আছে কিন্তু মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই।
“যেহেতু বেইলি রোডে বারিধারা, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন জায়গায় থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে আসে, আড্ডা বলেন, কিংবা ভালো খাবার খেতে আসেন। এজন্য অনেক দোকান-পাট হয়েছে। কিন্তু এগুলো দেখভালের কোনো ব্যবস্থা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক করেনি। এর বিচার কে করবে?”
এই ভবনের বিরিয়ানির দোকান কাচ্চি ভাইয়ে খেতে আসা সোহেল আহমেদ বলেন, “গতকাল কাচ্চি ভাইতে ছিল সব খাবারের ওপর ৫০% ডিসকাউন্ট। সেজন্য ফাস্টফুড খাদ্য রসিকদের দীর্ঘ লাইন ছিল নিচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত। আমিও লাইনে ছিলাম। কিন্তু রাত ৯টা ৫০ মিনিটে নিচে একটি কফি হাউজের দোকানে ধোঁয়া দেখে ভয় পেয়ে যাই। এরপর দৌড়াদৌড়ি….।”
সোহেলের ভাষ্য, “বেইলি রোডের বেশিরভাগ ভবনের সিঁড়ি সরু, ফাস্টফুড দোকানগুলোও ছোট। আর খাবারের দোকানগুলোয় ভিড়-ভাট্টা লেগেই থাকে, যা নিরাপদ নয়।"
আগুন লাগার পর প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিভিয়ে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। এরপরই আসতে থেকে একের পর এক মৃত্যুর খবর।
শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকব্রিগেডিয়া জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে ধারণার কথা বলেছেন। ভবনটির প্রতিটি ফ্লোরেই গ্যাসের সিলিন্ডার ছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি।
শুক্রবার তিনি জানিয়েছেন, ওই ভবনে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, হয়েছিল প্রাথমিকভাবে এমন তথ্য পেয়েছেন তারা। আর সেই সূত্র ধরেই আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে বাহিনী।
বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুনে অন্তত ৪৪ মৃত্যু
গ্রিন কোজি কটেজে আগুন চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে: ফায়ার সার্ভিস