শিশুর বাবাকে যে ভিডিও দেখানো হয়েছে, তাতে ধরা পড়েছে কালো বোরখা ও হলুদ ওড়না পরা এক নারী একটি নবজাতক নিয়ে আনসার সদস্যদের সামনে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন।
Published : 05 Jun 2024, 11:50 PM
সিসি ক্যামেরা, ওয়ার্ড থেকে বের হতে রেজিস্ট্রারে সই, সার্বক্ষণিক আনসার সদস্য থাকার পরও নিরাপত্তার সব চোখ ফাঁকি দিয়ে দরিদ্র মা সুখী বেগমের কোল খালি করে কীভাবে তার সদ্য নাড়িকাটা একটি সন্তান চুরি হয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে, তার জবাব মিলছে না কিছুতেই।
হাসপাতালের গাইনি বিভাগ ও নবজাতক ওয়ার্ড থেকে শিশু চুরির ঘটনা এর আগেও বেশ কয়েকবার আলোচনায় এসেছে, যার সবশেষ শিকার মনে করা হচ্ছে ইটবাহী ট্রাকের শ্রমিক শরিফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সুখী বেগমকে।
মঙ্গলবার গাইনি বিভাগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুই কন্যা সন্তান আসে সুখীর কোলে, যার কয়েক ঘণ্টা পরই চুরি হয়ে যায় একটি।
বুধবার সুখী ও শরিফুলের সঙ্গে হাসপাতালে কথা হয়। বিলাপ করতে করতে চুরি হওয়া সন্তান ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন তারা। বলছিলেন, কেউ কি তাদের সন্তানটি উদ্ধার করে দিতে সাহায্যের হাত বাড়াবে না?
সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে কালো বোরখা ও হলুদ ওড়না পরা এক নারী একটি নবজাতক কোলো নিয়ে আনসার সদস্যদের সঙ্গে কিছু কথা বলে একটি কার্ড দেখিয়ে তাদের সামনে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। ভিডিওটি শরিফুলকে দেখিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই।
এরপরেও কীভাবে চুরি হল নবজাতকটি, তা নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবার এবং ওয়ার্ডের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা পরস্পরকে দুষছেন। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি শিশুটিকে।
সুখীর জীবন থেকে উড়ে গেছে সব সুখ
ঢাকার ধামরাইয়ের কালামপুর থেকে সোমবার তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন শরিফুল। সন্তান হারিয়ে এখন তাদের জীবন থেকে যেন উড়ে গেছে সব সুখ।
বুধবার বিকালে হাসপাতালের গাইনি বিভাগে কথা হয় সুখী বেগমের সঙ্গে। খুবই কাতর তার অবস্থা। পাশে রয়েছে তার শাশুড়ি হাসিনা বেগম ও আট বছরের ছেলে, যার মঙ্গলবার থেকে খুব জ্বর।
সুখী বললেন, তার শাশুড়ি একেবারেই গ্রামের মানুষ, হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে বারান্দায় বের হলে আর বেড চিনে ফিরতে পারেন না। হাতে টাকাও নেই। তার স্বামী শরিফুল চুরি হওয়া সন্তানকে উদ্ধারে দেন-দরবার করে বেড়াচ্ছেন। র্যাব, পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা তাকে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। তাদের পাশে থাকতে পারছেন না শরিফুল, খুব খারাপ সময় পার করছেন তারা।
মঙ্গলবার পৃথিবীতে আসা তাদের দুই কন্যার আরেকটি বুকের দুধ পাচ্ছে না বলে তাকে কৌটার দুধ খাওয়াতে বলেছেন চিকিৎসকরা।
কাতর কণ্ঠে সুখী বলছিলেন, দুধ আনাও হয়েছে, কিন্তু পানি গরম করে দুধটুকু তৈরি করে দেওয়ার লোকও নেই তার পাশে। অস্ত্রপচারের পর জড়তা পুরোপুরি কাটেনি তার, ব্যথাও আছে। এর মধ্যেই সন্তান চুরি হওয়ার ভীষণ যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
তার সন্তানটি কার কাছে, কোথায় আছে, সে বেঁচে আছে কিনা, কাঁদলে তাকে কেউ দুধ দিচ্ছে কিনা, কত কথা মনে পড়ছে তার; আর সেসব মনে এলেই অঝোরে চোখের পানি ঝরছে সুখীর।
চোর ‘শনাক্ত’ সিসি ক্যামেরায়
হাসপাতালের গাইনি বিভাগ ও নবজাতক ওয়ার্ড থেকে শিশু চুরির ঘটনা নতুন কিছু নয়। ওইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয় বেশ কিছু পদক্ষেপ। ওয়ার্ডগুলোতে বসানো হয় ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা, বাইরের লোকজনের চলাচলও নিয়ন্ত্রিত করা হয়, নবজাতক নিয়ে বাইরে যেতে হলে তার বাবা-মা অথবা নিবন্ধিত আত্মীয়দের ওয়ার্ডে রাখা রেজিস্ট্রারে সই করতে হয়। আনসার সদস্যরা সবসময় সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন।
সুখী ও শরিফুল দম্পতির এতসব নিরাপত্তার কথা জানার কথা নয়, এসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যাপার, অন্তত হাসপাতাল পরিচালনার নাগরিক নির্দেশিকা অনুযায়ী তাই হওয়ার কথা। অথচ দেখা গেল অন্য চিত্র।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শরিফুলকে সিসিটিভির ভিডিও দেখিয়েছে, যেখানে তিনি তার শিশুটিকে কে চুরি করেছে, তা শনাক্ত করতে পেরেছেন বলে দাবি করেছেন।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, আনসার সদস্যদের সামনে দিয়েই কালো বোরখা ও হলুদ রঙের ওড়না জড়ানো এক নারীকে তাদের শিশুটিকে নিয়ে হেঁটে বের হয়ে যায়। আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথাও বলতে দেখা যায় তাকে। আনসারদের একটি ভিজিটিং কার্ড দেখিয়ে তাদের এক সন্তানকে নিয়ে নিয়ে বের হয়ে যায় বোরখাওয়ালি ওই নারী।
নেপথ্যে আরও করুণ দশা
ভুক্তভুগী পিতা শরিফুল জানান, গাইনি বিভাগে মঙ্গলবার সকালে শিশু দুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপর বাইরে এনে তাদের কাছে দেওয়া হয়। এক কন্যাকে তার কোলে, আরেকটিকে তার মা হাসিনা বেগমের কোলে দেওয়া হয়। তাদের বলা হয়, শিশু দুটিকে নবজাতক বিভাগে নেওয়ার জন্য। তারা সেখানে নিয়ে যান। সেখানে ডিউটিতে থাকা আনসার সদস্যরা শিশু দুটির তথ্য খাতায় লিখে নিয়ে শরিফুলের সই নেন। সব প্রক্রিয়া শেষে শরিফুল জানতে পারেন, তার দুই কন্যাকে রাখার মত জায়গা নেই নবজাতক ওয়ার্ডে, সিট খালি নেই; তাদের ঠাঁই হয়নি সেখানে।
এরপর কী করবেন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তারা শিশু দুটিকে কোলে নিয়ে নবজাতক ওয়ার্ডের বারান্দায় বসে ছিলেন বলে জানালেন শরিফুল।
তারপর তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হল।
সেখানে এক যুবক শরিফুলকে বললেন, “এখানে নিয়ে বসে আছেন কেন? বাইরে কোথাও (অন্য কোনো হাসপাতালে) নিয়ে যান। তবে বাইরে গেলে দিনে কিন্তু ১০-১২ হাজার করে টাকা লাগবে। পরে এখানে সিট খালি হইলে নিয়ে আইসেন।”
এসব শুনে শরিফুল তাকে বলেন, “আমরা গরিব মানুষ ভাই, আমাদের কাছে এমন কোনো টাকা তো নাই।”
এই বলে সেখানেই শিশু দুটিকে নিয়ে বসে ছিলেন শরিফুল ও তার মা, সঙ্গে তার জ্বরে আক্রান্ত আট বছরের ছেলে। কিছু সময় পর আনসার সদস্যরা তাদের সেখান থেকে উঠিয়ে দেন। পরে শিশু দুটিকে নিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে আরেক গলিতে গিয়ে বসেন তারা।
উপকারী সেজে আসে চোর
শরিফুলের ভাষ্য- এরপরে কী করবেন, সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকা অবস্থায় সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। এসব শুনে কালো বোরখা ও হলুদ ওড়না পরা এক নারী তাদের কাছে এগিয়ে এসে জানতে চান, বাচ্চা দুটি কি জমজ? ছেলে না মেয়ে?
শরিফুল জানান, জমজ দুটি মেয়ে হয়েছে তাদের। পরে মহিলা চলে যান। কিছু সময় পর আবার এসে বলেন, বাচ্চাগুলোর মুখ তো শুকিয়ে যাচ্ছে। তাদের কিছু খাওয়াতে হবে। বাচ্চাদের মা কোথায় তাও জানতে চান তিনি।
শরিফুল ওই নারীকে জানান, বাচ্চাদের মা ওয়ার্ডে (পোস্ট অপারেটিভ) আছে। সেখানে তো পুরুষ ঢুকতে দেয় না। সঙ্গে থাকা আট বছরের ছেলেরও খুব জ্বর। তার দাদি তাকে নিয়ে বসে আছেন। এসব শুনে ওই নারী বলেন, চলেন বাচ্চাদের মায়ের কাছে, তাদের দুধ খাওয়ায়ে নিয়ে আসি।
শরিফুলের বক্তব্য অনুযায়ী, ওই কালো বোরখাওয়ালির কথামত তিনি এক সন্তানকে কোলে নিয়ে আরেক সন্তানকে ওই নারীর কোলে দিয়ে পোস্ট ওয়ার্ডে যান। তিনি ওয়ার্ডের বাইরে একজনকে কোলে নিয়ে রাখেন, আরেকজনকে নিয়ে ওই নারী ভেতরে দুধ খাওয়াতে সুখী বেগমের কাছে যান। পরে প্রথম শিশুটিকে বাইরে এনে শরিফুরের কাছে দিয়ে দ্বিতীয় শিশুটিকে দুধ খাওয়াতে নিয়ে যান। ‘দুধ খাওয়ানো’ শেষে তাদের দুজনকেই শরিফুলের কাছে দিয়ে ওই নারী চলে যান।
এরপর বেশ কিছু সময় পর আবার আসেন ওই নারী।
শরিফুল বলেন, “তিনি এসে ছেলের গা ধরে বলেন, ‘এর তো অনেক জ্বর। তার জন্য বাইরে থেকে ওষুধ নিয়ে আসেন। দেখেন আবার, তারনি কিছু হয়ে যায়। আপনি যান সে সময়টুকু আমি আছি’।”
ওই নারীর কথায় বিশ্বাস রেখে শিশু দুটির একটিকে নিজের মায়ের কোলে আরেকটিকে ওই নারীর কোলে রেখে ছেলের জন্য কম্বল আর ওষুধ আনতে হাসপাতালের বাইরে যান শরিফুল। ফেরার পর এসে দেখেন তার মা এক বাচ্চা কোলে বসে আছেন, ওই নারী উধাও।
শরিফুল বলেন, “আমার মা সাদাসিধা। আমি আইসা পরে এদিক-ওদিক সবখানে খোঁজাখুজি করলাম, তাকে (বোরখাওয়ালি নারী) আর পাইনি। সেখানে আনসারদের জিগাই, তারা বলে, ‘আমরা কীভাবে বলব’। পরে লোকজনের পরামর্শে হাসপাতালের স্যারদের জানালাম।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে যায়, সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখায়, সেখানে সন্দেহভাজন ওই নারীকে বাচ্চা কোলে বের হতে দেখা যায় বলে বিডিনিউজকে জানান শরিফুল।
‘শোকে পাথর’ শরিফুল অসহায় কণ্ঠে বলেন, “মানুষ যে এমন খারাপ হয়, আগে বুঝতে পারি নাই। ওই মহিলা আমাকে সহযোগিতা করলেন, বাচ্চাদের ওয়ার্ডে মায়ের দুধ খাওয়ায়ে আনলেন, তখন মনে হইছিল, মানুষটা কত ভালো!”
বুধবার বিকালে সুখী বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই নারী শরিফুলকে ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন। তার বুকে এখনও দুধ আসেনি। সে কারণে আরেকটি শিশুকেও তিনি খাওয়াতে পারছেন না। ডাক্তাররা দুধ লিখে দিয়েছে, সেটা শরিফুল এনে দিয়েছেন। কিন্তু তাকে একবার পুলিশ, আরেকবার র্যাব, আবার হাসপাতালের ‘স্যারেরা’ ডাকাডাকি করছে। সে কারণে তার স্বামীও তার পাশে থাকতে পারছেন না।
“কেউ যে গরম পানি এনে দেবে দুধ বানানোর জন্য, এমন মানুষও দুপুর থেকে পাচ্ছি না।”
দায় কার?
হাসপাতালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসারের প্লাটুন কমান্ডার মিজানুর রহমান মঙ্গলবার বলেছিলেন, “আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, ওই বাচ্চার বাবাই সন্দেহভাজন মহিলার কাছে শিশুটিকে দিয়েছিলেন। ওই মহিলা তাদের আত্মীয় কিনা, তা তো আমাদের ডিউটিতে থাকা আনসারা বুঝতে পারেননি।”
আনসারের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, শিশুটির বাবা খাতায় এন্ট্রি করেই শিশুটিকে নিয়ে বের হন। পরে বাচ্চাটিকে ওই মহিলার কাছে তুলে দেন।
এ বিষয়ে শরিফুলের দাবি, ‘এন্ট্রি’ কী, তাই তিনি বোঝেন না। তিনি নবজাতক বিভাগে বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আনসাররা তার কাছ থেকে সই নিয়েছিলেন। পরে দুই সন্তানসহ তাদের মাকে ওয়ার্ডের ভেতরে রেখে তিনি বাইরে ওষুধ কিনতে যান। ফিরে এক সন্তানকে আর পাননি।
এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছে। থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান বলছেন, “বাচ্চা উদ্ধারের জন্য আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে।”
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেছেন, শিশু চুরির ঘটনাটি তদন্তে হাসপাতালে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন তারা। কমিটির প্রধান করা হয়েছে গাইনি বিভাগে প্রধান অধ্যাপক ফিরোজা ওয়াজেদকে।