“সমালোচনার জন্যই শুধু সমালোচনা করা হচ্ছে, জেনে সমালোচনা করা হচ্ছে না।”
Published : 10 Aug 2023, 07:25 PM
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিকদের যত উদ্বেগ ছিল, নাম বদলে নতুন আইনে তা দূর হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক; যদিও সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়েও একই উদ্বেগ ইতোমধ্যে জানিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো।
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাদ দিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের তিন দিন বাদে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন আইনমন্ত্রী।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশন শুরু করে সাংবাদিক পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ মানুষ এ ধরনের আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তাদের লক্ষ্য ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সেই জায়গাগুলো একটু সংশোধন করা, যাতে সংবাদ মাধ্যম এবং স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশনের যে ভাবনা-চিন্তা, সেটা যেন ব্যাহত না হয়।
“আমরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে আমরা সেই জায়গাটায়, সেই প্রশ্নটায়, সেই উত্তর দিতে পেরেছি। সেই প্রশ্নটা আমরা নিরসন করতে পেরেছি এবং সেই ভয়টা আমরা দূর করতে পেরেছি।”
বহুল বিতর্কিত তথ্য প্রযুক্তি আইন বাদ দিয়ে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে সরকার। তবে এই আইনটিও পড়ে সংবাদ মাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মীদের সমালোচনায়।
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আবার বিতর্কে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অন্তরায় বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও চিহ্নিত করে।
সমালোচনার মধ্যেও এই আইন রাখার পক্ষে সরকার অনড় অবস্থান ছিল সরকারের। তবে এক পর্যায়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও এই আইনটি স্থগিতের আহ্বান জানালে নির্বাচনের আগে সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে।
আইনটির কিছু ধারা সংশোধন করা হবে বলে আইনমন্ত্রী কিছু দিন ধরে জানিয়ে এলেও সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর জানান হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার করে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন আইন হচেছ। তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধিকাংশ ধারা থাকবে। তবে বিতর্কিত কিছু ধারায় পরিবর্তন আসবে।
যেসব ধারা নিয়ে বেশি বিতর্ক ছিল, কয়েকটি ক্ষেত্রে সেগুলোর সাজা কমিয়ে আনা হবে। ‘জামিন অযোগ্য’ কয়েকটি ধারাকে করা হচ্ছে ‘জামিন যোগ্য’।
মানহানি মামলায় কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে রাখা হবে শুধু জরিমানার বিধান। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে কমানো হবে সাজা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ৭ হাজারের বেশি মামলার বিচার যে নতুন আইন পাসের পর আগের আইনের অধীনে চলবে, সে কথা সোমবারই জানিয়েছিলেন আনিসুল হক।
নতুন আইন নীতিগত অনুমোদনের পর একে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এক বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে, নতুন আইনটিও মুক্ত গণমাধ্যম এবং স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে বাধা হতে পারে।
সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতে বলেছে, নতুন প্রস্তাবিত আইনটিতে চরিত্রগত কোনো পার্থক্য না থাকলে শুধু নাম পরিবর্তন করা হবে ‘অর্থহীন’।
“আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষ্য থেকে সংবাদমাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে সম্পাদক পরিষদ শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। কারণ কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি কমানো ও অজামিনযোগ্য কিছু ধরা জামিনযোগ্য করা ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।”
শাস্তি কমলেও দুটি বিধান রেখে দিলে তার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে সম্পাদক পরিষদ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘অগ্রহণযোগ্য’ ধারাগুলো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও থেকে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ জানিয়েছে তারা।
এমন সব সমালোচনার মধ্যে আইনটি প্রণয়নকারী আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বুধবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য ও কয়েকজন সচিব ছাড়া আইনটি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে কেউ জানত না।
“গতকাল পর্যন্ত যারা এটা সম্বন্ধে কমেন্ট করেছেন, তারা অবশ্যই এটার সম্পূর্ণটা জেনে কমেন্ট করেছেন, এমন কথা বলা যাবে না।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় থাকা কারাদণ্ড বাদ দিয়ে নতুন আইনে কেবল জরিমানা এবং ২১ ধারায় ১০ বছরের জেল থেকে সাত বছর করার কথা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, “সকল ধারায় দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে যে উপধারাগুলো ছিল, সেটাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেটাও কি পরিবর্তন না? সেটাও কি এক আছে?
“তাহলে এইগুলো বিচার করার পরে কেউ যদি বলে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আর সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নতুন বোতলে পুরোনো মদ, তাহলে আমাদের বলতে হবে সমালোচনার জন্যই শুধু সমালোচনা করা হচ্ছে, জেনে সমালোচনা করা হচ্ছে না।”
প্রস্তাবিত আইন নিয়ে মতামতের সুযোগ ১৪ দিন
প্রস্তাবিত আইন নিয়ে আগামী ১৪ দিন লিখিত মতামত দেওয়া যাবে বলে এক প্রশ্নে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
অংশীজনদের থেকে নতুন আইনের বিষয়ে মতামত নেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “ওয়েবসাইটে আপলোড করার মাধ্যমে কিন্তু আপনাদের কমেন্ট আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা সেটা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি যে, আপনারা যেন এটার উপর কমেন্ট করেন। আর আমাদের কথা বলতে তো আপত্তি নাই।”
আইনমন্ত্রী বলেন, “যতটুকু জেনেছি, গতকাল থেকে ১৪ দিন গণনা করা হবে। এই ১৪ দিন এটা ওয়েবসাইটে থাকবে। আমি এটা আগেও বলেছি, আপনারা যদি লিখিতভাবে আমাদের কাছে পাঠান, আমরা সেগুলো দেখে আপনাদের কমপ্লেইনগুলি অবশ্যই বিবেচনা করার চেষ্টা করব।
“আমি একটা কথা বলতে পারি, এই আইনের ব্যাপারে যে কেউ কথা বলতে পারে এবং সেটা শোনার জন্য আমাদের সকলের কান খোলা থাকবে।”
সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস করার আগে অংশীজনদের মতামত নিতে সরকারের প্রতি ইতোমধ্যে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।