শীতের তীব্রতায় বাড়ছে নানা ঠান্ডাজনিত রোগও। হাসপাতালে হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে দুর্ভোগে দিন কাটছে স্বজনদের।
Published : 05 Jan 2023, 08:26 PM
এক দিন বাদে দুপুরের দিকে সূর্যের দেখা মিলল, তাতে কুশায়ার চাদর সরে একটু রোদের দেখা মিললেও শীতের কাঁপন কমেনি; উত্তরী হাওয়ায় জবুথবু হয়ে পড়েছে নগর জীবন।
শীতের তীব্রতায় বাড়ছে নানা ঠান্ডাজনিত রোগও। হাসপাতালে হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে দুর্ভোগে দিন কাটছে স্বজনদের। ঘন কুয়াশায় সকালে ও রাতে স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে যান চলাচল।
পৌষের শেষার্ধে বেশ কয়েকদিন ধরেই তীব্র শীত ও কুয়াশায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ পেরেশানিতে রয়েছেন; তা গত দুই তিন দিন থেকে তা ঢাকাতেও ছড়িয়েছে। শীত ও কুয়াশার দাপটে রাজধানী ঢাকার দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন তাল হারিয়েছে।
আগের দিনের কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব বৃহস্পতিবার কিছুটা কাটলেও কনকনে হাওয়া এদিনও ভুগিয়েছে নগরবাসীকে। এ অবস্থা দ্রুতই কাটার আভাস নেই আবহাওয়ার খবরেও। উল্টো তা আরও কয়েকদিন থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
আবহাওয়াবিদ আব্দুল হামিদ মিয়া জানান, বৃহস্পতিবার রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
এদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসময় রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৭ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এই আবহাওয়াবিদ বলেন, সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তবে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় দেশের উত্তর, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি হচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
শীতের কারণে গ্রামে শ্রমজীবীদের কাজের সংকট দেখা দিয়েছে। কুড়িগ্রাম সদরের শিবরাম গ্রামের দিনমজুর নুরবানু ও নাজিনা বেগম জানান, শীতে কষ্ট হলেও পেটের দায়ে বের হতে হচ্ছে। সকাল পেরিয়ে কাজ ধরলে গৃহস্থরা কাজে নেন না। যে কারণে সকাল থেকেই তীব্র শীতে কাজ করতে গিয়ে ঠান্ডায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
নীলফামারীর পলাশবাড়ি ইউনিয়নের দোগাছী গ্রামের কৃষি শ্রমিক মুকুল রায় বলেন, “এই শীতোত ক্ষেতোত কাম করা যাছে না। কামাই না থাকায় হামার সংসারোত টান ধরিছে।”
ঢাকাতেও থেমে নেই কাজ
শীতের মধ্যেই ভোর বেলায় কাজের খোঁজে বের হতে হচ্ছে ঢাকার স্বল্প আয়ের মানুষদের। নির্মাণ শ্রমিক ওমর ফারুকও বেরিয়েছিলেন ভোরে। মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড় এলাকা থেকে এক ঠিকাদারের সঙ্গে এসেছেন ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করতে।
দিনভরই পানির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে তাকে। পাতলা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে থাকা ফারুক বলেন, “কাম করলে শইলে গরম আহে, শীতে কামুড় মারতে পারে না। এহন থামলেই লাগব জন্মের শীত।”
ফুলগেঞ্জির ওপর হাফশার্ট চাপিয়ে ভোরে রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন রিকশাচালক মহসিন। তিনি বলছেন, বের হওয়ার পরপর ঠান্ডা লাগে। কিছুক্ষণ চালানোর পর আর ঠান্ডা লাগে না, তখন আবার ঘামতে শুরু করবেন।
তাদের মত শীত উপেক্ষা করেই পোশাক কর্মীদের কারখানামুখী স্রোতও অন্য সকালগুলোর মতই সড়কে ছুটে চলতে দেখা গেছে।
রাজধানীর আদাবরের দুই বোন নাজমা ও আকলিমা অন্যদিনের মত সকালের আলো ফোটার আগেই বের হয়েছেন। নাজমা কাজ করেন বাসা-বাড়িতে। আকলিমা যান শ্যামলীর একটি পোশাক কারখানায়।
শীতের তীব্রতা বোঝাতে নাজমা বলেন, “আইজকা সকালে যহন বাইরাই তহন টিপটিপ কইরা বৃষ্টির মত কুয়াশা পড়তাছে। বোরকাটা গায়ে থাকায় পুরাপুরি ভিজিনি।”
আকলিমার ভাষ্য, “গার্মেন্টসে গিয়া কিছুক্ষণ গাও গরম করা লাগে। হাত অসাড় হইয়া থাহে, মেশিন চালামু ক্যামনে। তয় ফ্লোরের মইদ্দে বাইরের মত ঠান্ডা নাই, কিছুক্ষণ থাকলেই গরম ধইরা যায়।”
হাসপাতালেও জবুথবু অব্স্থা
নিউমোনিয়া আক্রান্ত ছয় মাসের সন্তানকে নিয়ে ঢাকার শিশু হাসপাতালে এসেছেন জাফর আহমেদ ও সুমি আক্তার দম্পতি। শিশু রোগীর সঙ্গে মাকে থাকার অনুমতি দেয় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। তার সে সুযোগ নেই বলে বাধ্য হয়ে শীত ও কুয়াশার মধ্যেই শিশু হাসপাতালের বাইরে বাগানে মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করছিলেন জাফর।
এ হাসপাতালের ভেতরের করিডোরগুলোতে রোগীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের থাকতে দেওয়া হয় না। এ কারণে হাসপাতালের প্রবেশমুখের গাড়ি বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছেন জনা দশেক মানুষ। বাইরের করিডোরে সার বেঁধে কম্বল পেঁচিয়ে শুয়ে আছেন কয়েকজন। যারা এখানেও জায়গা পাননি তারা পাটি বিছিয়ে শুয়েছেন শিশু হাসপাতালের খোলা বাগানে কিংবা আউটডোরের সামনের বারান্দায়।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। আর অনেক বাবা-মাই অসুস্থতার চূড়ান্ত পর্যায়ে শিশুদের নিয়ে হাসপাতালমুখী হচ্ছেন।
‘গ্রামের মত শীতে’ কাবু ঢাকাবাসী
এ বিষয়ে বাবা-মায়েদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি অবহেলা না করে এসময়ে শিশুর ঠান্ডা-কাশি হলে দ্রুতই হাসপাতালে আনার কথা বলেন।
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে হাসপাতালে ১ হাজার ৮৪টি নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু ভর্তি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছে ডিসেম্বরে ৪৩৭ জন।