‘গ্রামের মত শীতে’ কাবু ঢাকাবাসী

পৌষের মাঝামাঝি দেশের সর্বত্র শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে; ভোগান্তিতে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের ঠাণ্ডার মধ্যে না বেরিয়ে উপায় নেই।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Jan 2023, 07:00 PM
Updated : 4 Jan 2023, 07:00 PM

মানুষ আর যানবাহনের চলাচল কমে এলে গভীর রাতে সড়কে ঝাড়ু হাতে কাজে নেমে পড়েন জাকির, ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রতিদিনের এ রুটিনে কাজ সারলেও কয়েক দিন ধরে তীব্র শীতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এই পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, হিম বাতাসের সঙ্গে নগরীতে শীত জেঁকে বসলেও রাত ৩টার দিকে কাঁপতে কাঁপতেই তাকে সড়কে ছুটতে হয়। শীত যতই হোক, কাজের সঙ্গে তার আপসের সুযোগ নেই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রাত ৩টা বাজে বাইর হই, নাইলে পুরা রাস্তা ঝাড়ু দিয়া শেষ করন যায় না। রাত্রে ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাস থাকে। দুই দিন যাবত অনেক বেশি বাতাস।”

টানা কয়েক দিন ধরে তাপমাত্রা কমার প্রবণতার মধ্যে পৌষের মাঝামাঝি দেশের সর্বত্র শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে। শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও উত্তরের হিম হাওয়ার বেগ টের পাচ্ছেন ঢাকাবাসী।

সকাল সকাল কাঁপতে কাঁপতে স্কুলমুখী হচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীরা। নগরীর শ্রমজীবী আর পেশাজীবীরাও গায়ে মোটা কাপড় জড়িয়ে ছুটছেন গন্তব্যে।

ঘন কুয়াশার কারণে বুধবার বিকাল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের অনেক এলাকায় সূর্যের দেখা মেলেনি। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসায় মাঝারি থেকে তীব্র শীত অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বুধবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে সর্বত্র সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কামাল সরণী (৬০ ফুট সড়ক) এলাকায় টং দোকানের নিচে বুধবার ভোরে শীতে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলেন বৃদ্ধ সফর আলী। কাছে গিয়ে শীতের প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, “শীতের কথা কইয়া আর লাভ নাই। মোটা কোনো কাপড় নাই। এই বয়সে ভিক্ষা কইরা খাওয়া লাগে।

“দুই মাইয়া আছিল আমার আগেই চইলা গেল। এই শীতের মইধ্যে ফজরের নামাজে যে মুসুল্লিরা আইয়ে, তারার কাছ থাইকা চাইয়া খুঁইজা খাই।”

রাতের শীত আরেকটু বেশি টের পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিরাপত্তাকর্মী মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, “রাত ১০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ডিউটি করলাম। বাতাস যে আসে মনে হয়, বরফের বাতাস, দুই তিনটা মোটা কাপড় পইরাও শরীর বাঁকা হয়ে যাওয়ার অবস্থা।”

বাগেরহাট থেকে আসা তরুণ রিকশাচালক ইমরানের কাছে শীতের সকালে রিকশা প্যাডেল চালানোই প্রথম চ্যালেঞ্জ। তিনি বললেন, “একবার চালানো শুরু করলে আর শীত লাগে না, শরীর গরম হয়ে যায়।”

ভ্যানে করে চা বিস্কুটের দোকানে কেক-বিস্কুট ফেরি করা রায়হানেরও একই কথা।

কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসা রিকশাচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আইজকার (বুধবার) থিকা গতকাইল আরও বেশি শীত হইছে। সকালে গাড়ি নিয়া বাইর হইছি, পরে আর টিকতে না পাইরা ১১টা বাজে বাসায় চইলে গেছি। এত শীতের ভিতরে রিকশা চালানি যায় না।"

একই অবস্থা নরসিংদী থেকে ঢাকায় আসা ফরিদ মিয়ার। তিনি বলেন, “গ্রামের মত শীত পড়ছে ঢাকায়। এই শীতে বেশি চালাইতে পারি না। সন্ধ্যা হইলে বন্ধ কইরা দেই।”

সকাল ৭টার মধ্যেই কাজে পৌঁছাতে হয় সামিরন বেগম ও গৃহকর্মী কুলসুম আরার। হিম বাতাসে তারাও কাঁপছিলেন। বললেন, “ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে ছিল না, তবে উপায় নেই।”

বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। আকাশ আংশিক মেঘলা এবং সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। সেইসঙ্গে আগামী তিন দিনে আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।

আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় দেশের উত্তর, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি হচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

এমন আবহাওয়ায় দিনের অল্প যেটুকু সময় কুয়াশা ভেঙে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় তার বাইরে সারাদিনই গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

ভোটার আইডি তথ্য সংশোধনের জন্য কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন জ্যোৎস্না আক্তার। গ্রাম আর ঢাকার শীতের পার্থক্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গ্রামে একটু শীত বেশি। তবে ঢাকাতেও কম না। এত শীত হবে ভাবি নাই। জরুরি দরকারে এই শীতের মধ্যেই আসতে হল।”

মেগাসিটির বুকে এই শীতই আবার কারো কারো কাছে বেশ উপভোগ্য। শীতের সকালে হাঁটতে ব্যায়াম করতেই অনেকে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন।

আগারগাঁওয়ে তেমনই একজন জিএম মঞ্জুর হাসান বলেন, “আজ দুদিন ধরে শীত একটু বেশি। আজ আমার ছুটি তাই বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়েছি। প্রায়ই বের হই। শীতের সকালে একটু বেড়াতে। ভাপাপিঠা বা চিতই পিঠা খেতে ভালোই লাগে।”

শীতের সকালে ইট ভাঙতে বসা শেরেবাংলা নগর বস্তির হাসি বেগম বললেন, “শীত আর রোদ নাই, কাজ কইরাই খাওয়া লাগবে। রাইতে অনেক কষ্ট। বেড়ার ফাঁকে ঠাণ্ডা বাতাস আহে। ইট ভাঙ্গি, শীতের দিন একটা বাড়ি হাতে পড়লে ভীষণ ব্যথা হয়।”

একই বস্তির লাকড়ি দোকানি নূরজাহান বেগম মালা বলেন, “কাউন্সিলর কিছুদিন আগে কম্বল দিছে। সেই কম্বল পাইছে তাদের কাছের লোকে। মুখ চাইয়া চাইয়া দিছে, আমরা পাই নাই। এমন লোকে কম্বল নিছে, যারা সেই কম্বল নিয়া আবার বেইচাও দিছে।”

মিপুরের কাজীপাড়ায় কাজের একপর্যায়ে আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করে নিচ্ছিলেন শ্রমিক জব্বার সর্দার, সগীর আলী, সিদ্দিক মিয়ারা। তাদের ভাষ্য, ঠাণ্ডায় কাজ করা কঠিন। তাই বিরতি নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে চেষ্টা করছেন নিজেদের গরম করে নিতে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শীতটা থাকবে পুরো এই মাসজুড়েই। তবে এই কদিন যে ঠাণ্ডা পড়ছে সেটা আমরা আশা করছি আর দুই-তিনদিন থাকবে।”

বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে।

টানা কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা কমার প্রবণতার মধ্যে পৌষের মাঝামাঝিতে দেশের সর্বত্র শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে।

জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি মাসে ২-৩টি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।