নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও রাজনীতিতে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার খর্ব হচ্ছে বলে মন্তব্য এসেছে প্রতিবেদনে।
Published : 30 Dec 2022, 10:41 PM
শেষ হতে যাওয়া বছরে ‘যথেচ্ছ’ গায়েবি মামলা দায়ের এবং এগুলোতে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখছে বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)।
এ ধরনের মামলা সরকারবিরোধী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির বিরুদ্ধে ‘মাত্রারিক্ত’ হারে বেড়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটির অভিযোগ, “পুলিশ বাহিনী সরকারি দলীয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে কি না এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র।”
এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২২ ও এমএসএফ’র পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন মূল্যায়ন করা হয়েছে।
১৮টি সংবাদমাধ্যম ও নিজস্ব উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা যায়- ২০২২ সালে প্রায় সর্বক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিস্থিতির ‘অবনতি’ হয়েছে, একে ‘উদ্বেগজনকও’ বলছে প্রতিষ্ঠানটি।
‘গায়েবি মামলার’ জালে বিরোধীরা
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে মানবাধিকারের বিচারে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় ছিল যথেচ্ছ গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তার। বিএনপির মহাসচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতা গ্রেপ্তার রয়েছেন, তারা জামিনও পাচ্ছেন না। এখনও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে।
এমএসএফ বলছে, ২২ অগাস্ট থেকে ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি মামলা’ হয়েছে ৩১২টি, যাতে এজাহারভুক্ত আসামি ৮ হাজার ৪৮৬ জন। এছাড়া এসব মামলায় আরও ২৫ হাজার ১১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিএনপির ১ হাজার ৩০৯ জনকে। বাকিদের গ্রেপ্তারে প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।
বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের তরফে নানা কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বিএনপির ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশের স্থল নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সংঘর্ষের সময় পুলিশের ‘আচরণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থার সাথে একেবারেই বেমানান’ বলে মন্তব্য করা হয়।
প্রতিবেদনে এ বছর রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৪১টি ও সভা সমিতিতে বাধা দেওয়ার ৬৮টি ঘটনায় ৩৬ জন নিহত ও ৪ হাজার ৯২৮ জন আহত হয়েছেন বলে তুলে ধরা হয়। নিহতদের মধ্যে ১০ জন বিএনপির এবং ১৮ জন আওয়ামী লীগের এবং ৮ জনের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে ২০২২ সালে ইউপি নির্বাচন, উপ নির্বাচন ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে ১৯২টি নির্বাচনী এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় ৫০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২ শিশু রয়েছে। এসব সহিংসতায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১ হাজার ৫৪১ জন।
প্রতিবেদনে ‘গুম’ ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হয়নি দাবি করে বলা হয়, ২০২২ সালে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ২২টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ২৩টি অভিযোগের ঘটনা ঘটেছে। ৩০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন।
২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে এমএসএফ বলছে, আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১১ জন। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে পালানোর চেষ্টায় পানিতে ঝাঁপ বা অন্যান্যভাবে ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া পুলিশের কিছু সদস্যের অনৈতিক কাজের পাশাপাশি তাদের অশোভন আচরণ, নির্যাতন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ৬৯টি অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া ২০২২ সালে কারা হেফাজতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪২ জন বেশি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে অসুস্থতাজনিত কারণে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর দেশে একজন সাংবাদিক নিহত ও ২৬৬ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও ৫ জন সাংবাদিকের লাশ উদ্ধার ও ১ জন সাংবাদিক ইউএনও’র গাড়ির চাপায় নিহত হয়েছেন। সাংবাদিক নির্যাতনের ৩৯টি ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের এবং ২০টি ঘটনায় পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮২টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭৭ জন। চট্টগ্রামে ২ বছর ১০ মাস বয়সী আল নাহিয়ান বিন হাসানকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আসামি হয়েছে।
এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৪৯২ জন নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ২৫৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১৭ জন, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ১৩ জন, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছেন ১ জন। এছাড়া ধষর্ণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯২ জনকে ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৪৮ নারী। ৩৩ প্রতিবন্ধী নারীও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অ্যাসিড আক্রান্ত হয়েছেন ১২ নারী।
২০২২ সালে ৯৩৩টি শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ৫৪২ জন শিশু ও কিশোরী ধর্ষণ এবং ৮১ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে ২০ জন শিশুকে, ৪১ জন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
প্রতিবেদনে ২০২২ সালে সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হয়নি এমন তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৬ বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে ১৩ বাংলাদেশিকে জোরপূর্বক আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সীমান্তে এলাকা থেকে ৮টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে তিন বাংলাদেশিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ভারতীয় নাগরিকেরা এবং দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে আহত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) গুলিতে একজন বাংলাদেশি জেলে নিখোঁজ এবং অপর এক বাংলাদেশি জেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মাইন বিস্ফোরণে ১ রোহিঙ্গা নিহত, ৩ বাংলাদেশি নাগরিক ও ২ রোহিঙ্গা নাগরিকের পা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ‘প্রতিনিয়ত’ মর্টার শেল কক্সবাজরের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় এসে পড়লে জনমনে আতঙ্ক ছড়ায়।