হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব।
Published : 02 Oct 2024, 10:49 AM
দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হল শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
বুধবার ভোর থেকে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ সারাদেশে মণ্ডপে-মণ্ডপে চণ্ডীপাঠ, মঙ্গলঘট স্থাপন, ঢাক-কাঁসা ও শঙ্খ বাজিয়ে দেবীকে আহ্বান জানালেন ভক্তরা।
হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। আশ্বিন মাসের এই শুক্ল পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ।
দেবীপক্ষের শুরু হয় যে অমাবস্যায়, সেদিন হয় মহালয়া; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় ‘কাত্যায়নী মুনির কন্যা’ রূপে মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বুধবার ভোর ৬টায় ঢাকের বোলে চণ্ডি পাঠে শুরু হয় সেই মহালয়ার পর্ব।
প্রথমে চণ্ডীপাঠ করে দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। এ সময় মঙ্গলঘট স্থাপন করে তাতে ফুল, তুলসী ও বেলপাতা দিয়ে করা হয় পূজা।
আগমনী গানের মাধ্যমে শুরু হয় আড়ম্বরপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় 'দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধ' দেখানো হয়। এরপর ভক্তদের মাঝে হয় প্রসাদ বিতরণ।
মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস চন্দ্র পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চণ্ডীপাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্ব ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এরপর কল্পারম্ভ আবাহনে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন, ঘট স্থাপন, পূজার্চনা, আরাধনা, পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে স্মৃতি তর্পণ অনুষ্ঠিত হবে।”
ঢাকেশ্বরীতে মহালয়ার দ্বিতীয় পর্বের মূল আচার-অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ১০টায় । এই পর্বে ভক্তরা পূর্ব পুরুষের আত্মার শান্তি কামনায় তিল তর্পণ করেন। পরে মহালয়ার ঘট স্থাপন ও বিশেষ পূজা হবে।
মহালয়ার অন্যতম অনুষঙ্গ হল তর্পণ শ্রাদ্ধ। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোক বা যমলোকে বাস করেন। আর এই পিতৃলোকের অবস্থান স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে।
পিতৃলোকের শাসক মৃত্যু দেবতা যম। তিনি সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। এরপর পরের প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে আগের প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন। একই সঙ্গে পরমাত্মায় বা ঈশ্বরে বিলীন হন।
এ কারণে মহালয়ায় হিন্দুরা তাদের পূর্বে মারা যাওয়া তিন প্রজন্মের ব্যক্তিদের স্মরণ বা তর্পণ করে থাকেন। এ দিন শ্রদ্ধানুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি দেন।
তর্পনের মাধ্যমে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটে, শুরু হয় দেবীপক্ষের। ঘট স্থাপনের পর নানা স্তব-স্তুতিতে দেবীকে মর্তে আহ্বান জানানো হয়।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসা অপূর্ব কর্মকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছরের মহালয়ার অনুভূতি ভিন্ন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এই প্রথম মহালয়ার অনুষ্ঠানে আমার অংশগ্রহণ। প্রথমেই চণ্ডিপাঠ এবং তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল আড়ম্বরপূর্ণ। 'মহিষাসুরমর্দিনী' প্রদর্শনী ছিল চোখ ধাঁধানো। সব মিলিয়ে বেশ আনন্দপূর্ণ একটি সকাল কাটল।”
এদিন সকালে মন্দির প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের পাশাপাশি দায়িত্বে ছিলেন সেনা সদস্যরা।
ঢাকেশ্বরী ছাড়াও রাজধানীর স্বামীবাগ ও বনানীসহ বিভিন্ন মণ্ডপে আহ্বান জানানো হয় দেবীকে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ষষ্ঠী পূজার অপেক্ষা।
সরকারি হিসাবে সারা দেশে এবার ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে এবার দুর্গাপূজা উদযাপন করা হবে।
পঞ্জিকা অনুযায়ী আগামী ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন, দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা।পাঁচদিনব্যাপী দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সুচনা হবে সেদিন। পরদিন ১০ অক্টোবর সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার।
অষ্টমী ও নবমী শেষে ১৩ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসবের।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, এবারে দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসছেন দোলায় চেপে, ফিরবেন গজের পিঠে চড়ে।
শাস্ত্র বলছে, “রবৌ সোমে গজরূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়ৌঃ। দোলায়ঞ্চ গুরৌ শুক্রে, নৌকায়ং বুধবাসরে।”
অর্থাৎ, দুর্গার গমনাগমন যদি রবি বা সোমবার হয়, তাহলে তার বাহন হয় গজ বা হাতি। আবার শনি বা মঙ্গলবার হলে তিনি চড়েন ঘোটকে বা ঘোড়ায়৷
কিন্তু বৃহস্পতি বা শুক্রবার যদি দুর্গার গমনাগমন ঘটে তাহলে তিনি দোলায় বা পালকিতে যাতায়াত করেন ৷ আর সেটা বুধবার হলে তার বাহন হয় নৌকা৷
সপ্তমী এবার বৃহস্পতিবার পড়ায় দুর্গা আসবেন পালকিতে চড়ে, আর রোববার দশমীতে তিনি কৈলাসে দেবালয়ে ফিরবেন হাতির পিঠে চেপে।
শাস্ত্র বলছে, দোলা অর্থাৎ পালকিতে আগমন বা গমনের ফল হল- ‘দোলায়াং মকরং ভবেৎ’; অর্থাৎ মহামারী, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধ ও অতিমৃত্যুর ইংগিত।
আর গজ বা হাতিতে গমন-আগমনের ফল হয়- ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’; অর্থাৎ পৃথিবী শস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, অশুভ শক্তির বিনাশে ঘটবে সমৃদ্ধি।