ইউনিসেফ বলছে, “বাংলাদেশ এখন বড় এক পরিবর্তন, প্রত্যাশা ও রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে।”
Published : 13 Feb 2025, 08:44 PM
জুলাই-অগাস্টের আন্দোলন ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রতিবেদনে যে মর্মান্তিক ঘটনাগুলো উঠে এসেছে, তাকে ‘হৃদয়বিধারক ও উদ্বেগজনক’ হিসাবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রধান রানা ফ্লাওয়ার্স বলেছেন, “আসুন আমরা এই মুহূর্তটিকে অর্থপূর্ণ সংস্কারের জন্য কাজে লাগাই এবং নিশ্চিত করি যে বাংলাদেশের কোনো শিশু, পরিবার এবং কমিউনিটিকে আর যেন এ ধরনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়।”
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন আন্দোলন ঘিরে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তথ্যানুসন্ধান কমিটির এই প্রতিবেদন বুধবার প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশন।
প্রতিবেদনে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে, “বাংলাদেশের সাবেক সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস উপাদানগুলোর পাশাপাশি, গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের সাথে জড়িত ছিল।”
ওই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় সিদ্ধান্ত পৌঁছেছে, জুলাই-অগাস্টে বড় আকারের অভিযানগুলোতে প্রাণহানির ঘটনাগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের ‘নির্দেশনা ও তদারকিতে’ সংঘটিত হয়েছে।
“জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তার সাক্ষ্য অনুযায়ী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯ জুলাই এক বৈঠকে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরকে ‘বিক্ষোভের হোতা-দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার, তাদের হত্যা এবং লাশ গুম করতে’ বলেছেন তিনি,” লেখা হয়েছে প্রতিবেদনের একটি অংশে।
জুলাই ঘটনাবলির পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ বলেছে, নিরস্ত্র মানুষের ওপর পরিচালিত ওই হত্যাযজ্ঞ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। বহু ঘটনা আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারের আওতায় আসার উপযোগী বলেও মত দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্ক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্টের মধ্যে যে এক হাজার ৪০০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতাধিক ছিল শিশু। নিহতদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে নিহত হওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। নিহতদের মধ্যে ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে এমন গুলির ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা যুদ্ধে ব্যবহার হওয়ার কথা।
নিহত শিশুদের অনেকের বিষয়ে ইউনিসেফের তরফে এর আগে প্রতিবেদন প্রকাশ এবং মোট কত শিশু নিহত বা আহত হয়েছে, তা স্পষ্ট করার জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বিবৃতিতে বলেন ঢাকায় ইউনিসেফের প্রতিনিধি।
রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, “নারীদের বিক্ষোভে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার জন্য শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের হুমকি সহ নানা প্রকার জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতার ঘটনার নথি পাওয়া গেছে। শিশুরাও এই সহিংসতা থেকে রেহাই পাইনি; তাদের অনেককে হত্যা করা হয়, পঙ্গু করে দেওয়া হয়, নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়, অমানবিক অবস্থায় আটক করে রাখা হয় এবং নির্যাতন করা হয়।”
কয়েকটি শিশুর হৃদয়বিদারক মৃত্যুর বর্ণনা প্রতিবেদন থেকে তুলে ধরে ইউনিসেফ বলেছে, “ধানমন্ডিতে দুইশ ছররা গুলি ছোড়ার কারণে ১২ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারী অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মারা যায়।
“আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে; সেখানে ছয় বছর বয়সী এক কন্যা শিশু তার বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। এই বিক্ষোভের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন ৫ অগাস্ট পুলিশের গুলি চালানোর বর্ণনা দিয়ে আজমপুরের ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে বলেছে, ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মত গুলি চলছিল’; সে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল সেদিন।”
বাংলাদেশে ইউনিসেফ প্রধান বলেন, “এই ঘটনাগুলো অবশ্যই আমাদের সকলকে আতঙ্কিত করে তুলছে। বাংলাদেশের শিশুদের সাথে ‘আর কখনোই যেন এমনটি না ঘটে’ তা নিশ্চিত করার জন্য ইউনিসেফ বাংলাদেশের সকল মানুষের কাছে আহ্বান জানায়।”
শিশু, যুবসমাজ এবং পরিবারগুলোকে শারীরিক ও মানসিক ক্ষত সারিয়ে উঠতে এবং আশা সঞ্চার করে এগিয়ে যেতে সহায়তা করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সরকার ও নীতিনির্ধারকদের আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ।
তিনটি বিশেষ ক্ষেত্রে জোর দিয়ে রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, “প্রথমত, যেসব শিশুরা প্রাণ হারিয়েছে এবং তাদের শোকাহত পরিবারবর্গের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
“দ্বিতীয়ত, আসুন আমরা সবাই, যারা এখনও আটক অবস্থায় আছে এবং যাদের জীবন কোনো না কোনোভাবে এই ঘটনাগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তাদের সকলের জন্য পুনর্বাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একজোট হই।
তৃতীয় পদক্ষেপকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “এই সময়টাকে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সার্বিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সব রাজনৈতিক নেতা, দল এবং নীতিনির্ধারকদের পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একজোট হতে হবে যাতে বাংলাদেশের কোনো শিশুকে আর কখনও এমন বিচার বহির্ভূতভাবে ও যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাবে আটক থাকতে না হয়।
“শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নিশ্চিত করা, যাতে কিনা তাদের অধিকারের জন্য নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হতে না হয়। আর এভাবে বাংলাদেশের শিশুদের সুরক্ষা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের অধিকার সমুন্নত রাখা সম্ভব।”
ইউনিসেফ বলছে, “বাংলাদেশ এখন বড় এক পরিবর্তন, প্রত্যাশা ও রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে। সংস্কার কমিশনগুলো বর্তমানে পুলিশ, আদালত এবং বিচার ব্যবস্থার পুনর্নির্মাণে কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে যেভাবে কাজ করছে, তাতে তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও আরও ন্যায়সঙ্গত পরিবেশ তৈরি করার সুযোগ রয়েছে।