Published : 09 Oct 2024, 07:37 PM
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে বদলি, পদোন্নতি ও জনবল নিয়োগে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নেওয়াসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পরিবারসুদ্ধ দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক এর চার মামলায় আসামি হয়েছেন।
স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, পুত্র সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি, মেয়ে সাফিয়া তাসনিম খান- আসাদুজ্জামানের পরিবারের সবাই অবৈধ টাকা-কড়ি ও সম্পদ অর্জনে যুক্ত বলে দুদকের অভিযোগে দাবি করা হয়েছে।
বুধবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাগুলো দায়ের করা হয়। দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন মামলা দায়েরের বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন।
৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান আসাদুজ্জামান। অবশ্য কিছু গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সম্প্রতি তাকে ভারতের কলকাতায় দেখা গেছে। তার ছেলে জ্যোতি ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকার পতন পর্যন্ত হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, গুমসহ বিভিন্ন অভিযোগে এরই মধ্যে বহু মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আসাদুজ্জামানকেও আসামি করা হয়েছে।
দুদকের দুর্নীতির চারটি মামলার সব কয়টিতেই সন্দেহভাজন আসামি আসাদুজ্জামান। সংস্থাটির নথি অনুযায়ী, প্রথম মামলায় সরাসরি নিজে এবং অন্য তিনটিতে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের দুর্নীতির সহযোগী তিনি।
এসব মামলায় আসাদুজ্জামানের পরিবারের বিরুদ্ধে ৬০ কোটি ৫৫ লাখ টাকার অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ৩৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৪১৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে অর্থপাচারের সংশ্লিষ্টতা দেখছে দুদক।
এর আগে ১৪ অগাস্ট স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ আসাদুজ্জামানের সব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-বিএফআইইউ। তারও আসাদুজ্জামানের পরিবারের সন্দেহজনক লেনদেন তদন্ত করছে।
এদিকে বুধবারই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের এপিএস মনির হোসেনের বিরুদ্ধেও ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ১২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩১ কোটি ৩১ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক।
আসাদুজ্জামান খান কামালকে সরাসরি আসামি করে মামলাটি করেছেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
এই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ৭৩ বছর বয়সি আসাদুজ্জামান অসাধু উপায়ে জ্ঞাতআয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৫৭ হাজার পাঁচশ ৭৪ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন ও দখলে রেখে এবং আটটি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনকভাবে ৫৫ কোটি ৯২ লাখ ৪৪ হাজার চারশ ৩৬ টাকার লেনদেন করে মানিলন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ “দুর্নীতি ও ঘুস” সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে উহার রূপান্তর বা স্থানান্তর বা হস্তান্তর করেছেন।
মামলার এজাহারে ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানকালে দেখা যায়- আসাদুজ্জামান খান কামাল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।
২০১৫ সালের ১৪ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান আসাদুজ্জামান। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় শপথ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১২ আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মোট ২ কোটি ৫৭ লাখ ৫৯ হাজার পাঁচশ ৫০ পঞ্চাশ টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জন করেন।
এজাহারে দেওয়া আসাদুজ্জামানের অর্জিত সম্পদের তালিকা অনুযায়ী, ঢাকার তেজগাঁওয়ের মণিপুরিপাড়ায় ৩.৩ কাঠা জমির ওপর চারতলা বাড়ি নির্মাণ, যার ব্যয় ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৭০০ টাকা; মহাখালী ও মিরপুরে ৮.৫ শতাংশ জমি ক্রয়, যার মূল্য ২৩ লাখ টাকা; ঢাকা জেলার সাভার থানার আওতায় ১৪৫ শতাংশ কৃষি জমি ক্রয়, যার বাজারমূল্য ১৮ লাখ ৭৫ হাজার ৮৫০ টাকা; পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট ক্রয়, যার বাজারমূল্য ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা; দোহার শাইনপুকুর খালপাড়ে ৪০০০ বর্গফুটের তিনতলা ভবন নির্মাণ, ব্যয় ৮০ লাখ টাকা এবং সাভারের আশুলিয়ার পাতালিয়ায় ২৬ শতাংশ জমি ক্রয়, যার বাজারমূল্য ৮৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
এই স্থাবর সম্পদের পাশাপাশি আসাদুজ্জামান খান ১৭ কোটি ৩ লাখ ৯৬ হাজার চারশ ১৪ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন বলে দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার নথি অনুযায়ী, আসাদুজ্জামান মোট ১৯ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার নয়শ ৬৪ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। তিনি একজন আয়কর দাতা।
তার আয়কর নথিতে ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত তার দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য মোট আয় পাওয়া যায় ৬ কোটি ১০ লাখ ৭৮ হাজার ৩১০ টাকার। একই সময়ে তার প্রদর্শিত পারিবারিক ব্যয় ২ কোটি ৯০ লাখ ৭৯ হাজার ৯২০ টাকা। পারিবারিক ব্যয় বাদে তার সঞ্চয় তিন কোটি ১৯ লাখ ৯৮ হাজার তিনশ ৯৯ টাকা। তার অর্জিত মোট সম্পদের মূল্য ১৯ কোটি ৬১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬৪ টাকা।
ওই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার সঞ্চয় বা গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৩ কোটি ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৩৯০ টাকা। তার অবশিষ্ট ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৭৭ হাজার পাঁচশ ৭৪ টাকার সম্পদের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস তিনি দাখিল করতে পারেননি; যা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে।
দুদকের অভিযোগ অনুযায়ী, আসাদুজ্জামান তার নিজ নামে থাকা আটটি ব্যাংক হিসাবে মোট ৫৫ কোটি ৯৯ লাখ ৪৪ হাজার চারশ ৩৬ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। এভাবে তিনি মানিলন্ডারিং-এর সম্পৃক্ত অপরাধ “দুর্নীতি ও ঘুস” সংঘটনের মাধ্যমে বর্ণিত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে তার রূপান্তর বা স্থানান্তর বা হস্তান্তর করেছেন বলে এজাহারে বলা হয়েছে।
আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খানের বিরুদ্ধে ১৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪ হাজার পাঁচশ ৯১ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলাটি দায়ের করেছেন উপ-পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন।
এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানকেও আসামি করা হয়েছে।
মামলা এজাহারে বলা হয়েছে, আসাদুজ্জামান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তাহমিনা খানকে অপরাধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
লুৎফুল তাহমিনা খান মামলার দ্বিতীয় আসামি কামালের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নিজ এবং তার আংশিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামের ১০টি ব্যাংক হিসাবে জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত মোট ৪৩ কোটি ৭৭ হাজার সাতশ ৪৫ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন এবং এই অর্থের স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।
আসাদুজ্জামানের ছেলে সাফি মুদ্দাসিরের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ। এই মামলায় আসাদুজ্জামানকেও আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পরস্পর যোগসাজশে ১৯ কোটি ৭৯ লাখ ৭৮ হাজার পাঁচশ ২ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে জ্যোতি নিজ ভোগ দখলে রেখেছেন। তার নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে নিজ এবং প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহৃত ব্যাংক হিসাবে ৮৪ কোটি ৭৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭২ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর বা স্থানান্তরের মাধ্যমে সন্দেহজনক অসংখ্য লেনদেন করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে।
আসাদুজ্জামান খান কামালের মেয়ে সাফিয়া তাসনিম খানের বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার ৪৮৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলাতেও আসামি আসাদুজ্জামান।
তাসনিম খান নিজ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে নিজ ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহৃত ব্যাংক হিসাবে মোট ২৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার ৫৪২ টাকা সন্দেহজনক অসংখ্য লেনদেনের মাধ্যমে রূপান্তর, স্থানান্তর ও হস্তান্তর করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে এজাহারে বলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম ।
আসাদুজ্জামান খান কামালের এপিএস মনির হোসেনের বিরুদ্ধে ১৮ কোটি ৮২ লাখ ৫৬ হাজার ১৪২ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তার নিজ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহৃত ব্যাংক হিসাবে অপরাধলব্ধ মোট ৩১ কোটি ৩১ লাখ ৭০ হাজার ৮৩৪ টাকা স্থানান্তর বা হস্তান্তর বা রূপান্তরের মাধ্যমে সন্দেহজনক অসংখ্য লেনদেনের অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নাছরুল্লাহ হোসাইন।