স্কুল বন্ধ থাকলেও অনেক অভিভাবক যে বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারে পাঠান, সেটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
Published : 29 Apr 2024, 01:33 AM
দেশজুড়ে চলমান তাপপ্রবাহকে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিবেচনায় ‘জরুরি পরিস্থিতি’ মন্তব্য করে ঘরের বাইরের কাজ এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এ বি এম আব্দুল্লাহ।
এই চিকিৎসক মনে করেন, চলমান পরিস্থিতিতে শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীতে রয়েছে। যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি নিয়ে নতুন মূল্যায়ন করা উচিত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ‘ইনসাইড আউট’ এ অংশ নিয়ে এমন পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক আবদুল্লাহ, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
ইংরেজিতে সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ অনুষ্ঠান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজে ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে এ বি এম আব্দুল্লাহ অসহনীয় গরমের বিপদ থেকে বাঁচতে করণীয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের আবহাওয়া আগের তুলনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। চলতি বছর টানা ২৯ দিন ধরে দেশে তাপপ্রবাহ চলছে, যা নজিরবিহীন।
ডা. আব্দুল্লাহ বলছেন, “উচ্চ তাপমাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। এর মারাত্নক আঘাত হিসেবে হিটস্ট্রোকের ঘটনা ঘটছে।”
মূলত যারা শ্রমিক; মাঠে, সড়কে, যানবাহনে দীর্ঘ সময় কাজ করছেন এবং যথেষ্ঠ পানি ও ছায়া পাচ্ছেন না তাদের হিটস্ট্রোকের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন তিনি। কারণ, শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ঝুঁকি তৈরি হয়।
স্কুল কি আরও বন্ধ রাখা উচিত?
তীব্র গরমে স্কুল খোলা থাকা উচিত কি না, সে বিষয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা নিয়েও এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে প্রশ্ন রাখে ইনসাইড আউট।
ঈদ ও বাংলা নববর্ষের ছুটির পর তীব্র গরমের কারণে এক সপ্তাহ বাড়তি বন্ধ শেষে স্কুল ও কলেজ খুলেছে রোববার। তবে অনেক অভিভাবকই তার সন্তানদেরকে পাঠাননি। কয়েক জায়গায় স্কুলে শিশুদের অসুস্থ হওয়ার খবরও এসেছে।
শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাংলাদেশে নতুন কিছু না। সব প্রতিষ্ঠান চলছে স্কুল কেন বন্ধ থাকবে।
তবে কোনো জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসন সেখানে স্কুল বন্ধ বা ক্লাসের সময় পরিবর্তনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় রোববার রাতে জানায়, ঢাকা, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও খুলনায় মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজগুলো সোমবার বন্ধ থাকবে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকালে ক্লাস হয় বলে সেগুলো খোলা থাকবে।
সরকার স্কুল বন্ধের সময় বাড়াতে পারত না কি এই সিদ্ধান্তই সঠিক হয়েছে- এমন প্রশ্ন ছিল অধ্যাপক আব্দুল্লাহর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, দেশে গরমের যে জরুরি পরিস্থিতি চলছে, তা সাময়িক। এই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা চালু রাখা নিয়ে ভাবা দরকার।
তিনি বলেন, “শিশুদের স্কুলে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের বাইরে যেতে হবে, দৌঁড়াবে। বাইরের খাবার খাবে। এসব সমস্যা রয়েছে। এটা তো সাময়িক পরিস্থিতি, এজন্য তো সব সময় বন্ধ রাখতে হবে না। এটা সত্যিই জরুরি পরিস্থিতি।”
এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, অনেক অভিভাবক তাকে বলেছেন যে, তারা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না।
“অবস্থা খারাপ হলে ছুটি বাড়ানো উচিত। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওরা বাসায় পড়বে। কারণ শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। তাদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। উন্নতি হলে আবার স্কুল খুলবে, এর আগে বন্ধ থাকা উচিত।”
তবে স্কুল বন্ধ থাকলেও অনেক অভিভাবক যে বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারে পাঠান, সেটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
যেসব লক্ষণ দেখলে সাবধান
হিটস্ট্রোকের লক্ষণ কী-এই প্রশ্নে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, “অতি গরমে হিট ক্র্যাম্প, ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথা ঘুরানো, মাথা ব্যাথা ও বমি বমি ভাবের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক পর্যায়ে মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে বা হিটস্ট্রোক করে; যা খুবই বিপদজনক।
“তাদেরকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার, এমনকি আইসিইউ এর প্রয়োজন হতে পারে।”
চলতি মৌসুমে গরমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর এসেছে।
দুর্গম এলাকা এবং যেসব স্থানে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান নেই-সেসব স্থানে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি দেখছেন তিনি। বলেন, “যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা না হলে মানুষ মারা যেতে পারে।”
গরমে কী সমস্যা তৈরি হয়-এই প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেন, “গরমের প্রধান সমস্যা হচ্ছে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি করে; এতে শরীরে পানির পাশাপাশি লবণও কমে যায়।
“ফলে রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরে শক্তি কমে যাওয়া, মাথা ঘুরানোর মত সমস্যা তৈরি হয়। ভারসাম্য রাখতে না পেরে ব্যক্তি পড়ে যেতে পারে।”
শীতল হওয়ার চেষ্টায় ক্ষতি
তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে মানুষ সচরাচর অভ্যাসবশত যেসব কাজ করে সেগুলো তার জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে বলে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই এমিরিটাস অধ্যাপক।
তিনি বলেন, “মানুষ তৃঞ্চার্ত থাকছে। সেজন্য বাইরে থেকে পানি, জুস, কোমল পানীয়- যেখানে যা পাচ্ছে খাচ্ছে। এটি কি বিশুদ্ধ না কি দূষিত তা দেখছে না। এটা একটা সমস্যা।”
এর ফলে ডায়রিয়া, বমির মত সমস্যা হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
বাইরের খাবারের বিপদ তুলে ধরে এ বি এম আব্দুল্লাহ বলছেন, এসব খাবারের জীবাণু হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, জন্ডিস, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েডের মত রোগে আক্রান্ত করতে পারে।
“গরম থেকে বাসায় গিয়েই অনেকে খুব ঠান্ডা পানি বা বরফ পানি খাচ্ছে। এতে করেও ঠান্ডা, টনসিল, সাইনোসোটিসের মত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যারা বাচ্চা বা বয়স্ক; যাদের নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ রয়েছে তাদের জন্য এসব বিপজ্জনক হতে পারে।”
ঝুঁকি বেশি যাদের
অধ্যাপক আব্দুল্লাহর মতে, তাপপ্রবাহে শিশু থেকে বয়স্ক-সবাই ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে কিছু মানুষের ঝুঁকি বেশি।
তিনি বলেন, “বিশেষ করে ক্রনিক রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, লিভার, হার্টের সমস্যায় ভুগছেন, স্ট্রোক করেছেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অন্তসত্ত্বা, তারা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।”
শহর এলাকায় যানজটে দীর্ঘ সময় রাস্তায় বসে থাকা যে ঝুঁকিপূর্ণ, সেটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
করণীয় কী
তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে সম্ভব হলে বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক। তবে যারা কাজ করেন তাদের জন্য এই পরামর্শ মেনে চলা যে কঠিন হবে, সেটিও বলছেন তিনি।
“কাজ বন্ধ করে দেওয়া তো সম্ভব নয়। কিন্তু যারা ঝুঁকিতে তাদের জন্য বিশেষ যত্ন নিতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বাইরে বের হতে হলে বিশেষ কিছু সতর্কতা মানার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
“যারা শ্রমিক, কৃষক, শিল্প কারখানা বা গরমের মধ্যে কাজ করেন- তারা ছাতা, টুপি ব্যবহার করতে পারেন। টাইট কাপড় না পরে ঢিলেঢালা জামা পড়বেন। রঙিন কাপড় না পরে সাদা বা হালকা রঙের কাপড় পড়বেন।”
সম্ভব হলে খুব গরমে কাজ না করে সকালে বা বিকালে কাজ করার পরামর্শ তার। কর্মজীবীদের অনেক বেশি বিশুদ্ধ তরল খেতে বলেছেন তিনি। এর সঙ্গে লবণ যুক্ত করে নেওয়া এবং রাস্তার খাবার ও পানীয় এড়িয়ে যেতে বলেছেন তিনি।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, “তাপপ্রবাহে শিশুরা মারাত্নক ঝুঁকিতে রয়েছে। অভিভাবকদের উচিত হবে তাদের যথেষ্ঠ পানি পান করার অভ্যাস করানো। একই সঙ্গে যথাযথ খাবার নিশ্চিত করতে হবে।”
পথশিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তা
শিশুদের সুরক্ষায় বাড়িতে বড়রা না হয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু লাখ লাখ পথশিশুকে কে দেখবে, এই প্রশ্নে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, “সত্যিই এটা দুর্ভাগ্যজনক। তাদের জন্য কারো না কারো থাকা উচিত।”
তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও পানীয় ব্যবস্থা করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
সেই সঙ্গে তারা কিছু সময় যেন গাছের নিচে ছায়ায় বা বাসায় গিয়ে বিরতি নেয়, দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণ না করে, সে বিষয়ে সতর্ক করার ওপরও জোর দেন তিনি।
“সরকার ও প্রশাসন এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে পারে। রাস্তায় এসব বাচ্চাদের জন্য খাবার ও পানি সরবরাহ করতে পারে। বিত্তবানরাও সহযোগিতা করতে পারে।”