ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার রাতে তিন দফায় চিকিৎসকদের ওপর হামলার পর কাজ বন্ধ করে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
Published : 01 Sep 2024, 11:46 PM
হামলার পর নিরাপত্তার দাবিতে সোচ্চার হওয়া চিকিৎসকদের কর্মবিরতির তাৎক্ষণিক ফল ভোগ করতে হলো হাজার হাজার রোগীকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার রাতে তিন দফায় চিকিৎসকদের ওপর হামলা ও মারধরের প্রতিবাদে রাতেই কাজ বন্ধ করে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তখন থেকেই সেখানে চিকিৎসা সেবার অচলাবস্থা শুরু।
ঢাকা মেডিকেলের অন্য চিকিৎসকরাও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতিতে সংহতি জানান। ফলে রোববার সকালটি নতুন বিপদ নিয়ে শুরু হয় রোগীদের। কোথাও কোনো চিকিৎসক দেখা যাচ্ছিল না, কেউ রোগীর কাছেও আসেননি।
এ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসার সব বিভাগে সেবা বন্ধ হয়ে যায়। তৈরি হয় চরম চিকিৎসা সংকট।
রোববার সন্ধ্যায় দেখা দেয় আশা। বিকালে সেখানে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। তার সঙ্গে বৈঠক হয় চিকিৎসকদের। বৈঠকে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে কর্মবিরতি স্থগিতের ঘোষণা দেন চিকিৎসকরা।
এসব শর্ত না মানা হলে সোমবার সন্ধ্যা থেকে শাটডাউন কর্মসূচিতে ফিরবেন চিকিৎসকরা।
সরকার বা চিকিৎসক যে দিক থেকেই হোক না কেন, চিকিৎসকরা রোগীর সেবায় না ফিরলে, তা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের।
চিকিৎসকদের স্পষ্ট দুই দাবি ছিল- হামলাকারীদের আটক ও শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং সারাদেশে চিকিৎসক ও রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
প্রথমে এই দুই দফা দাবি নিয়ে চিকিৎসকরা সরব হলেও দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস না মেলায় দুপুরে সারা দেশে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা।
সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের আশ্বাসের ভিত্তিতে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কর্মবিরতি স্থগিত করেন চিকিৎসকরা। এরপর রাত পৌনে ৮টার দিকে বিজিবির সদস্যদের উপস্থিতিতে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সেবা শুরু হয়।
এর আগে দুপুরে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণার পর ঢাকা মেডিকেলের পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি বড় সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে তথ্য আসতে থাকে।
সেই কারণে বিকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, কলাপসিবল গেইট বন্ধ। বাইরে কাতরাচ্ছেন বহু রোগী।
দেখা গেল, গেইটের ভেতর থেকে নার্সিং অফিসার ইশরাত জাহান রোগীদের শান্ত হওয়ার অনুরোধ করছেন।
জানতে চাইলে ইশরাত বলেন, “ফ্লোরে কোনো চিকিৎসক নেই। আমরা একেবারে মরণাপন্ন রোগী ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিতে পারছি না।”
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের পাঁচ তলায় মেডিসিন বিভাগেও রোববার সকালে এক রোগীর স্বজনেরা চিকিৎসকদের ওপর হামলা করেন বলে তথ্য দিলেন সেখানকার একজন নার্স।
তিনি বলেন, “সকালে এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রোগীর স্বজনেরা এক ডাক্তারের গায়ে হাত তোলে। তারা ডাক্তারদের বসার রুমটিতে গিয়ে তছনছ করে। এ কারণে ঢাকা মেডিকেল থেকে কর্মবিরতির যে ঘোষণা এসেছে, তাতে এখানকার ডাক্তারেরাও যোগ দেন।”
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা স্ট্রোকের রোগী সালেমা খাতুনের ছেলে আব্দুস সালাম বলেন, দুপুরের পর তার মাকে নিয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে, পরে সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী এসেছেন। তবে তার মাকে ভর্তি করাতে পারেননি। সালাম ও তার স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব সালেমা খাতুনকে দুই পাশে ধরে অনেক কষ্ট করে সোহরাওয়ার্দীর বারান্দা দিয়ে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেলে রোববার সকাল থেকেই চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা।
সকালে ঢাকা মেডিকেলে কিডনি রোগী ৬২ বছর বয়সি আরমান হোসেনকে নিয়ে আসেন স্বজনেরা। দীর্ঘক্ষণ তাদের ঢাকা মেডিকেলের নতুন বিল্ডিংয়ের নিচতলায় অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
জানতে চাইলে আরমানের ছেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে আব্বাকে নিয়ে আসছি। টিকিট নিয়ে এখানে আসছি, বললো চারতলায় যেতে। কিন্তু চারতলায় গিয়ে তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও কোনো ডাক্তার পাইনি। শুনেছি, তারা চিকিৎসা দেবেন না। আব্বার অবস্থা ভালো না। কেউ বলতেছে প্রাইভেটে নিতে, কিন্তু তেমন টাকা পয়সার জোগাড় নাই যে বাইরে নেব। এই জন্যে বইসা আছি “
বগুড়া থেকে রেফার্ড রোগী কোহিনুর বেগম (৪৮) দুপুর ১২টার দিকে আসেন ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু ভর্তি হতে পারেননি।
কোহিনুরের ভাই মাসুদ রানা বলেন, “আমার বোনের অবস্থা গুরুতর, সেখানকার চিকিৎসকরা বলেছেন দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ভর্তি করান। কিন্তু আমরা এখানে আইসা দেখি টিকিট কাউন্টারটাও বন্ধ।
“হাসপাতালে না কি ডাক্তারদের ধর্মঘট। ভাই, আমরা তো গরিব মানুষ, আমরা এখন কোথায় যাব?”
ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে সকাল থেকে দেখা গেছে প্রচুর রোগী অপেক্ষা করছেন, নতুন নতুন রোগীও আসছিলেন। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেককে টিকেট কিনতে দেখা গেল। কেউ কেউ ডাক্তার দেখাতে পারলেও পরে চিকিৎসকশূন্য হয়ে যায় জরুরি বিভাগ। অনেকে টিকেট কিনেও সেবা নিতে পারেননি।
সেখানকার একজন টিকেট বিক্রেতা বলেন, তারা প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টিকেট বিক্রি করেন আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজারটি। রোববার টিকিট বিক্রি করেছেন দেড়শর মত। তবে টিকেট নিয়েও অনেকে চিকিৎসক দেখাতে না পারায় একপর্যায়ে তারা কাউন্টার বন্ধ করে দেন।
জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করে পাওয়া গেল, সকাল থেকে টিকেট বিক্রি হয়েছে ৭২টি। রোগী ভর্তি হতে পেরেছেন মাত্র ১২ জন।
ঢাকা মেডিকেল সরকারি পর্যায়ে দেশের সর্ববৃহৎ রেফারেল হাসপাতাল। দুই হাজার ছয়শ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে চার হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকে। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগ মিলিয়ে দৈনিক আরও পাঁচ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন এই হাসপাতালে।