“বইমেলার পরিসর তো এখন অনেক বড়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেভাবে না করা হলেও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এলে কিন্তু একুশের আমেজ পাওয়া যাবে,” বলেন মেলা কমিটির সদস্য সচিব।
Published : 28 Feb 2024, 11:41 PM
একুশের চেতনাকে ধারণ করে শুরু হওয়া বইমেলা এখন কতটা সেই চেতনার পথ ধরে হাঁটছে, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। শেষ হতে যাওয়া মেলায় অনেকের মধ্যেই এ নিয়ে হতাশার সুর।
দর্শনার্থী, লেখকদের অনেকে বলছেন-মেলায় এখন আর একুশের আমেজ পাওয়া যায় না। এ যেন কেবলই বইয়ের বাণিজ্যমেলায় রূপ নিয়েছে, বলছেন তাদের কেউ কেউ।
এক সময় বইমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে মাইকে নিয়মিত বাজানো হতো একুশের সেই অমর গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি'। মেলা প্রাঙ্গণে সেই গান এখন নিয়মিত বাজতে শোনা যায় না।
আগে বিভিন্ন সময় মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন চত্বরের নামকরণ করা হত ভাষা শহীদদের নামে। সেটিও এবার দেখা যায়নি। মেলায় ভাষা বিষয়ক বইয়ের প্রকাশও এ বছর হাতেগোনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শরীফ নাসরুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছাত্রজীবনে প্রায় প্রতিদিনই মেলায় এসে আড্ডা দিয়েছি। তখন মেলা প্রাঙ্গণে আসলেই একুশের গান বাজতে শুনতাম। মেলার প্রবেশ গেইট এমনভাবে করা হত, সেখানে একুশের আমেজ পাওয়া যেত। এবার মেলায় এসে সেই আমেজ পাচ্ছি না। মনেই হচ্ছে না এটা একুশের চেতনাকে ধারণ করা বইমেলা।“
বুধবার মেলায় ঘুরে দেখা যায়, মূল মঞ্চ, লেখক বলছি মঞ্চের পাশাপাশি আরেকটি নতুন মঞ্চ করা হয়েছে, নাম 'বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন' মঞ্চ। সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবার স্টল রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে।
প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে কোথাও সেভাবে চোখে পড়ে না ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে বহন করার চিত্র।
তবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এসে কিছুটা সেই আমেজ পাওয়া যায়। কারণ বাংলা একাডেমি নিজেই বহন করে চলেছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি।
এদিন মেলায় এসে অনেকগুলো বই কিনেছেন আকিব বাবু নামের একজন। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, মেলায় এসে কি একুশের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে?
তার ভাষ্য, এটা স্রেফ যেন একটা বইয়ের বাণিজ্যমেলায় পরিণত হয়েছে। কোথাও একুশের স্মৃতিচিহ্নও নেই। কেউ এই মেলায় এসে বুঝতেই পারবে না, এটা একুশের বইমেলা। এই মেলার পেছনে একুশের চেতনা জড়িত।
শুধু বইয়ের বাণিজ্যই তো এই মেলার মূল বৈশিষ্ট্য নয় মন্তব্য করে মাছরাঙা প্রকাশনের প্রকাশক আবুল কাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার মেলা দুই দিন বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রকাশকরা হয়ত আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হবেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই মেলা এখন কতটা একুশের চেতনার বইমেলা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এটা নিয়ে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি এবং লেখক-প্রকাশকসহ সবাইকে চিন্তা করতে হবে।
এ মেলায় বাণিজ্যের চেয়েও বেশি জরুরি একুশের যে বৈশিষ্ট্য-তাতে ফিরে যাওয়া, বলেন তিনি।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বইমেলার পরিসর তো এখন অনেক বড়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেভাবে না করা হলেও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এলে কিন্তু একুশের আমেজ পাওয়া যাবে।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মূল মঞ্চের পেছনে একাডেমির অফিসে প্রবেশের যে পথটি রয়েছে, তার দু-পাশে সারি সারি বিলবোর্ড। যেখানে বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলনের নানা ইতিহাস লেখা রয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের নানা স্মৃতিচিহ্নও উঠে এসেছে বিভিন্ন আলোকচিত্রে।
তবে এই বিলবোর্ডগুলো যেখানে রাখা, সেই জায়গাটি রয়েছে পুরো বইমেলার আড়ালে। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের বেশির ভাগই আসেন না এ জায়গায়।
ভাষার স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে এ প্রদর্শনী যেমন মূল মঞ্চের আড়ালে পড়ে রয়েছে, একইভাবে বইমেলায়ও যেন আড়ালেই রয়ে গেছে ভাষার গৌরবাজ্জ্বল চেতনা।
মাইকে একুশের গান না বাজানোর বিষয়ে কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, প্রকাশকদের কেউ কেউ আপত্তি করেছেন, সারাক্ষণ গান বাজানোর কারণে তাদের বই বিক্রিতে সমস্যা হয়।
বুধবার ছিল বইমেলার ২৮তম দিন। মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।
মেলা পরিচালনা কমিটি জানায়, এদিন তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই এসেছে ৮০টি।
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান, কবি তারিক সুজাত, কথাসাহিত্যিক সমীর আহমেদ ও শিশুসাহিত্যিক আবেদীন জনি।
'বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন' মঞ্চে বিকেল ৫টায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘সংস্কৃতি ও সদাচার’ বই নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. মো. হাসান কবীর এবং সম্পাদকীয় পর্ষদের সদস্যবৃন্দ।
মূল মঞ্চ
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ মুনীর চৌধুরী এবং স্মরণ হুমায়ুন আজাদ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে অধ্যাপক ফিরোজা ইয়াসমীন ও অধ্যাপক হাকিম আরিফ। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম, অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক, ওসমান গনি ও মৌলি আজাদ। সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি প্রদীপ মিত্র, তাহমিনা কোরাইশী, চঞ্চল শাহরিয়ার, হাসান মাহমুদ, আসাদ আহমেদ, মীর রেজাউল কবীর, লোকমান হোসেন পলা, কাজী বর্ণাঢ্য, দীপন দেবনাথ, গোলাম মোর্শেদ চন্দন, কৌমুদী নার্গিস, ফারজানা ইসলাম ও বোরহান মাসুদ।
আবৃত্তি পরিবেশন করেন জ্যোতি ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ সেলিম ভূঁইয়া, মছরুর হোসেন, ফারজানা ও সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ।
এছাড়া ছিল কোহিনূর রহমান শিল্পীর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আনন্দ নিকেতন সংগীতালয়’, নারায়ণ চন্দ্র শীলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘লোকাঙ্গন সাংস্কৃতিক সংগঠন’, আরিফুজ্জামান চয়নের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘উদ্ভাস নৃত্যকলা একাডেমী’ এবং রোকেয়া ইসলামের পরিচালনায় ‘প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন সংস্থা’ এর পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন শাহীন সামাদ, ফেরদৌস আরা, দীপ্তি রাজবংশী, আবদুল মান্নান তালুকদার (নয়ন সাধু), আঁখি আলম, শেখ মিলন, সরদার হিরক রাজা, আরিফ বাউল, বেবী আকতার, রবিউল হক, রিদওয়ানা আফরীন, রীতা ভাঁদুরী ও নয়ন বাউল। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন কাজী মো. ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), মো. নূর এ আলম সজীব (কী-বোর্ড), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), রিচার্ড কিশোর (গিটার), নজরুল ইসলাম (বাংলা ঢোল)।
বৃহস্পতিবার যা থাকবে
বৃহস্পতিবার বইমেলার ২৯তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকাল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন মেলা সমাপনীর আনুষ্ঠানিকতা হওয়ার কথা থাকলেও প্রকাশকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মেলার মেয়াদ দুই দিন বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে মেলা শেষ হবে শনিবার।