ঈদযাত্রায় টিকেটের চাহিদা ‘কম’, পরিবহন খাতে ‘হতাশা’

শ্যামলী পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক শাহ জাহান বলেন, “আগে ঈদের প্রস্তুতি নিতে আমাদের ঘাম ছুটে গেছে, এখন আর কিচ্ছু নাই।”

শাহরিয়ার নোবেলনিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2023, 11:08 AM
Updated : 7 April 2023, 11:08 AM

ঈদে বাড়ি ফেরার যে তাড়া, তা এবার থাকবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত বাস মালিকরা। আগাম টিকেট বিক্রির প্রথম দিনে টিকেটের জন্য স্বাভাবিক ভিড় না দেখে এই ধারণা করছেন তারা।

বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কার মধ্যে এবারের ঈদে কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছে। রোজার অর্ধেক চলে গেল, বিপণী বিতানগুলোতে নেই তেমন ভিড়। দর্জির দোকানিরা অর্ডারের অপেক্ষায় এখনও।

এর মধ্যে শুক্রবার ঈদ যাত্রায় বাস ও ট্রেনের টিকেট বিক্রি শুরু হলো একযোগে। প্রতি বছর সকাল নয়, আগের দিনের রাত থেকেই টিকেটের জন্য কমলাপুরে থাকে ভিড়। এবার সব টিকেট অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে বলে কাউন্টারের সামনের চিত্র ছিল পুরোপুরি ফাঁকা।

বাসের টিকেটও কাটা যাচ্ছে অনলাইনে। তবে বিক্রির ব্যবস্থা আছে কাউন্টারেও। তবে সকালের দিকে কিছুটা লাইন দেখা গেলেও তা খুব বড় ছিল না।

বাস কোম্পানির কর্মীরা বলছেন, অর্থনৈতিক চাপের কারণে এবার স্বাভাবিক চাপ নাও থাকতে পারে। টিকেট কিনতে আসা যাত্রীদের পক্ষ থেকেও পাওয়া গেল একই মত।

প্রতি বছর বাড়তি টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ পাওয়া যায়, তাও দেখা যায়নি এবার।

এবার ঈদের ছুটি শুরু ২১ এপ্রিল শুক্রবার থেকে। তার আগে বৃহস্পতিবার কর্মদিবস শেষে বিকেলের টিকেটের জন্যেই চাহিদা বেশি দেখা গেছে। 

ব্যবসা না হওয়ার শঙ্কা

পরিবহন ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, চলমান ‘আর্থিক সঙ্কটে’ অনেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেবেন ঈদযাত্রা থেকে।

গাবতলীতে ঢাকা থেকে পাটুরিয়া ঘাট হয়ে কুষ্টিয়া রুটে চলাচল করা লালন শাহ পরিবহনের টিকেট ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান প্রবাল বলেন, "লোকজন টিকেট নেওয়া শুরু করেছে। অল্প সংখ্যক নিয়েছে৷ এমন কোনো ভিড় এখনও শুরু হয়নি।"

তার আশঙ্কা- এ বছর ব্যবসা হবে না।

প্রবাল বলেন, “কুষ্টিয়া যাওয়ার খরচ আছে ১৭ হাজার টাকা। ৬৫০ টাকা ভাড়ায় টিকেটে উঠবে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। ব্যবসা হল কই? গাড়ি ফেরার সময় তো খালি আসবে।”

ঢাকা থেকে পাবনা, ঈশ্বরদী, শাহজাদপুর রুটে চলা শাহজাদপুর ট্রাভেলসের টিকেট ব্যবস্থাপক সাগর সূত্রধর পুরোপুরি হতাশ। তিনি বলেন, “ভিড় কোথায় বসে আছি।”

তার পাশে থাকা কাউন্টার ব্যবস্থাপক বলতে থাকেন, “পাঁচটা না ছয়টা টিকেট গেছে সকাল থেকে। ঈদের ব্যবসা কী হবে বুঝতেসি না।”

শ্যামলী পরিবহনের টিকেট দেওয়া হচ্ছে কল্যাণপুর ও আসাদগেট থেকে। কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক শাহ জাহান বলেন, “আগে ঈদের প্রস্তুতি নিতে আমাদের ঘাম ছুটে গেছে, এখন আর কিচ্ছু নাই।

“নারায়ণগঞ্জ, সায়েদাবাদের যাত্রীও এখানে আসত। আগের মত ইদের আমেজ বাড়ি যাওয়ার ফুর্তি আর নাই। আগেরদিন থেকে এসে লোকজন এখানে লাইনে থাকত। আনন্দ নিয়ে প্রস্তুতি নিতাম, করোনার পর থেকে সব ঈদেই এমন হয়ে গেছে।”

ঈদে নতুন গাড়ি নামানোর পরিকল্পনা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “ঈদের সিজন পাঁচ দিন চালানো হবে। যদি ৩০ রোজা হয় তাহলে ২২ রোজা পর্যন্ত চলবে৷ একেক রুটে একেক সংখ্যায় ট্রিপ চলবে। ট্রিপ বাড়ামু কি? এইবার অর্ধেক ট্রিপই নাই।”

আগাম টিকেটের জন্য নয়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর যাবেন বলে গাবতলীর শাহজাদপুর ট্রাভেলসে এসেছিলেন আনোয়ারুল কবির। এবারের ঈদে যাত্রী চাপ কম থাকবে, এমনকি মনে করছেন তিনিও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টেফোর ডটকমকে আনোয়ারুল বলেন, “আসতে যেতে একজনের দুই হাজার টাকা লাগে। পরিবার গেলে আরও বেশি। বেতনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ভাড়া দিয়ে যদি বাড়ি যাওয়া লাগে তাহলে অনেকেই যাবে না। এর থেকে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দেবে বা এ দিয়ে বাজার সদাই করবে।” 

আছে যানজটের ভয়ও

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটে সড়ক উন্নয়ন কাজ শেষ না হওয়ায় গত বছর যে যানজট হয়েছিল, তার স্মৃতি এখনও ভোলেনি ভুক্তভোগীরা। বাস মালিকদের আশঙ্কা, দুর্ভোগের কারণে বাড়ি যাওয়ার স্রোত এবার কম হবে। যানজটের আশঙ্কায় ট্রিপ কমানোর কথাও বলেছেন তারা।

হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক আরাফাত আলী বাবু বলেন, “একদিনে যেহেতু ছুটি হচ্ছে, এবার রস্তায় বেশি জ্যাম হবে। এই জ্যাম ছুটতে ছুটতে ঈদ শেষ। তাই এবার গাড়ি বাড়ানোর প্রস্তুতি নাই। পারলে আরও কমাতে হবে। টিকেট দিলে তো গাড়ি চাইবে। এখন গাড়ি রাস্তায় আটকে থাকলে আমি গাড়ি কোত্থেকে দিব। ”

একই শঙ্কা হক এন্টারপ্রাইজের ফয়েজের, “আমার ব্যানারে গাড়ি কম। দিনে ৫ থেকে ৬ ট্রিপ চলবে। গাড়ি রুট কন্ডিশনের উপর নির্ভর করে চলবে। এই সেক্টরে গতবারে যে দীর্ঘ যানজট ছিল এ কারণে মানুষ এবছর অনেকেই ঢাকা থেকে ঈদে বাড়ি যাবে কি না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে।”

চাহিদা বেশি ২০ এপ্রিলের

চাঁদ দেখা সাপেক্ষ আগামী ২২ কি ২৩ এপ্রিল উদযাপন হবে ঈদ। বুধবার শবে কদরের ছুটি থাকলেও পরের দিন ২০ এপ্রিল কর্মদিবস। সেদিন বিকাল থেকে টিকেটের জন্যই চাহিদা বেশি দেখা গেল।

হানিফ পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক মো. আরাফাত আলী বাবু বলেন, “ভোর ছয়টা থেকে টিকেট দিচ্ছি, সবাই একই দিনে যেতে চায়। ২৮ রমজানে মানে ২০ তারিখ সপ্তাহের শেষদিন সব ছুটি হবে। এজন্য চাপ বেশি। এইদিনের সব টিকেট শেষ। পেছনের লাইনে হয়ত দুই-একটা পাওয়া যাবে।” 

২৮ রমজানের টিকেট না পেয়ে কুষ্টিয়াগামী লালন শাহ পরিবহনে পরের দিনের টিকেট কিনেছেন মো. আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “ছুটি থাকলেও নানাকিছু বিবেচনায় ঈদের আগে আগেই যেতে হবে। তখন অনেক ভিড় হবে এই চিন্তা করে আগেই টিকেট কাটতে এসেছি। ভালো সিট পেলাম, ভাড়াও ঠিক আছে।"

রংপুর ও চিরিরবন্দর রুটে চলা হক এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারেও সকালে ভিড় হয়েছে। সবাই ১৮ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে টিকেট চাইছেন বলে জানালেন পরিবহন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপক ফয়েজ আহম্মেদ৷

পূর্বাশা পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম খুশি বলেন, "১৯-২০ তারিখের সব গাড়ির টিকেট বিক্রি করে ফেলেছেন প্রথমদিনেই। ১৫ থেকে ১৮ তারিখ, আর ২১ ও ২২ তারিখের টিকেট পাওয়া যাবে কাউন্টারে এলে।"

ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে যাওয়ার জন্য পূর্বাশা ও রয়েল এক্সপ্রেসের দুই কাউন্টার ঘুরে টিকেট না পেয়ে ফোনে কারও কাছে ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন ব্যাংকার মারুফ হাসান। তিনি বলেন, "একদিনে সবাই যাবে, এইজন্য টিকেট নাই৷ একটু দেরি করায় মিস করলাম। এই রোদের মধ্যে কাউন্টার-কাউন্টার ঘুরছি। কোথাও টিকেট পাচ্ছি না। এরা অনলাইনেও ছাড়েনি।"

কল্যাণপুরের শ্যামলী কাউন্টারের ম্যানেজার শাহ জাহান বলেন, “২০ তারিখে কোনো গাড়ির সিট নেই, সকাল থেকে এসে সব নিয়ে গেছে। সেহেরি খেয়ে সব চলে এসে বসে আছে।”

গাইবান্ধা ও পাবনা বেড়া রুটে চলা আলহামরা পরিবহনের টিকেট ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন কাউন্টারের বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্ট। তিনি বললেন, "সকালে থেকে মোটামুটি টিকেট বিক্রি হচ্ছে। এপ্রিলের ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখের চাপ বেশি।”

টিকেট নিতে আসা শামীম হোসাইন বলেন, “ আমার বন্ধু দেশের বাইরে থাকে, ২৪ রমজানে তার পরিবার যাবে, বাচ্চাকাচ্চা যাবে। পরে তো টিকেট থাকে না, বিক্রি হয়ে যায়৷ আমি কাছাকাছি থাকি তাই আমাকে দিয়ে এখনই নিয়ে রাখছে।"

এস আর পরিবহনে টিকেট কাটতে এসে ১৯ বা ২০ এপ্রিলের রাতের বাসে ননএসি বাসের টিকেট পাননি নওগাঁগামী শোয়াইব আহম্মেদ। পরে ২১ এপ্রিল দিনের বেলায় এসি বাসের টিকিট কেটেছেন৷

শোয়াইব আহম্মেদ বলেন, "ঢাকা থেকে নওগাঁ এসি বাসে দুই হাজার নিচ্ছে। যেতে হবে তাই যে ডেইটে মিলেছে সেইটে ডেইটের নিলাম।" 

‘বেশিরভাগ টিকেট অনলাইনে’

হানিফ পরিবহনের কাউন্টারের ম্যানেজার মো. আরাফাত আলী বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আশানুরুপ বিক্রি কাউন্টারে নাই। অনলাইনে আছে তো, সবাই বাসায় বসে কিনে নিচ্ছে। আমরাও ডিজিটাল হতে চাইছি।”

আলহামরা পরিবহনের টিকেট ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, “অনলাইনে সহজ থেকে দিচ্ছি। গ্যাদারিং কমাতে যাত্রীর সুবিধার্থে আমরা দুই কাউন্টার আর অনলাইন এই তিন জায়গা থেকে টিকেট দিচ্ছি।”

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে চলা এস আর ট্রাভেলসের সেলস অফিসার মানিকুর রহমান আরিফ বলেন, " সকালে দুই ঘণ্টার মতো লাইন ছিল। এখন আবার অনলাইনেও সব পরিবহনের টিকেট পাওয়া যায় তাই লাইনে তেমন লোকজন থাকে না।"

হক এন্টারপ্রাইজের জেনারেল ম্যানেজার ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, "আমার কাউন্টার কোটায় এই কয়দিনের যত টিকেট ছিল সব শেষ। অনলাইনে সহজ ডটকমে পাবেন।”

এদিকে নাবিল পরিবহনের ১৭ তারিখের টিকেট কাউন্টারে মিললেও এর পরে তারিখগুলোর টিকেট কিনতে হচ্ছে অনলাইনে।

ভাড়া নিয়ে অভিযোগ ‘কম’

কাউন্টারগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে বিআরটিএর বেঁধে দেওয়া হারেই নেওয়া হচ্ছে ভাড়া। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া যেহেতু বিআরটিএ ঠিক করে না, তাই তাদের ক্ষেত্রে হিসাবটা আলাদা।

কাউন্টারগুলোতে সাধারণ বাসের সরকারি ভাড়া টানানো থাকলেও পূর্বাশা, এসআরসহ বেশকিছু কাউন্টারে এসি বাসের ভাড়া পরিবহন কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নির্ধারণ করে দিয়েছে।

গাবতলী কাউন্টারে আল হামরা পরিবহনের টিকেট ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “আমাদের নিজেদের কোনো কালোবাজারি নাই। সরকারি চার্ট অনুযায়ী নির্ধারিত ভাড়াই নিচ্ছি আমি। আগে মানুষের মধ্যে ঈদের টিকেট নেওয়ার একটা হিড়িক ছিল, অর্থনৈতিক সমস্যায় এবার এটা কম।”