শেখ মুজিবকে নিয়ে একাত্তরে বার্তাসংস্থার তিনটি সংবাদ

andalib_rashdi
Published : 20 Dec 2015, 02:02 PM
Updated : 20 Dec 2015, 02:02 PM

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে আগে জার্মান পত্রিকা ডার স্পিগেল এবং বার্তা সংস্থা রয়টার্স পাকিস্তানে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকার্য বিষয়ক তিনটি সংবাদ প্রকাশিত করে। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, বিরোধীদল এবং বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এই বিচারকার্য এবং রায়ে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই প্রতিবেদনগুলোতে। কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক আন্দালিব রাশদীর অনুবাদে পাঠকদের জন্য তা এখানে উপস্থাপিত হলো। বি.স.

'তাঁর অবশ্যই মৃত্যদন্ড হবে' –ডার স্পিগেল

বন, ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি, ৩০ আগস্ট ১৯৭১। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবর রহমানের নিয়তি পশ্চিম-পাকিস্তানি সামরিক ট্রাইবুনাল গোপনে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। বিচারক শফি এরই মধ্যে তা জেনে গেছেন: 'অবশ্যই তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে।'

'মহিষের যেমন সিং, বাঘের যেমন থাবা, মৌমাছির যেমন হুল, মিথ্যে তেমনি বাঙালির' বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস অষ্টাদশ শতকে এই রায় দিয়েছিলেন।

[ডার স্পিগেলের প্রতিবেদক এই উদ্ধৃতিটি সম্ভবত তার স্মৃতি থেকে নিয়েছেন, এটি অসম্পূর্ণ, কথাটি ওয়ারেন হেস্টিংস-এর নয়, থোমাস বেবিংটন ম্যাকলের; ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর ও পরে ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন। ম্যাকলে (১৮০০-১৮৫৯) ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ পর্যন্ত ভারতে ছিলেন, বোর্ড অব কন্ট্রোলের সেক্রেটারি হিসেবে।]

বাংলার নতুন শাসক পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মিলিটারিরা তাদের পূর্বসুরী ব্রিটিশদের বর্ণগত পূর্বধারণা নিয়ে শাসন করেছে। ওয়ারেন হেস্টিংস এর ২০০ বছর পর বাঙ্গালির 'মিথ্যে'র বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চালু করেছে।

গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলা থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে লায়লপুর জেলে গোপনে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন বাংলার জন্য পর্যাপ্ত স্বায়ত্বশাসনের দাবীদার মুজিবর রহমান। তার অপরাধ গত বছর একটি অবাধ নির্বাচনে তিনি তার দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেছেন।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা যারা এতোদিন ধরে শাসন করে আসছে, পাকিস্তানে বাঙ্গালিদের আধিপত্য তাদের ভালো লাগার কথা নয়। তারা একটি রক্তাক্ত গণযুদ্ধ চাপিয়ে বাঙ্গালিদের আক্রমন করেছে। অভিযোগ হচ্ছে: 'পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা দেওয়া।'

পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ইয়াহিয়া খান রায়টি অনুমান করে নিয়েছেন। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি মিস্টার কারগিল প্রেসিডেন্টকে অভিযোগ প্রত্যাহারের অুরোধ করেন, জেনারেল ইয়াহিয়া বিষোদগার করে বলেন, 'এই লোকটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মহা-অপরাধ করেছে। তার ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়া উচিত।'

বিচার প্রক্রিয়াটি যে যথার্থ তা দেখানোর জন্য ইয়াহিয়া খান অভিযুক্তকে নিজের আইনজীবী পছন্দ করতে বললেন। মুজিবের পছন্দ এ কে ব্রোহী আতঙ্কে মামলাটি প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিলেন; মর্নিং নিউজ এর সমালোচনা করে লিখেছে:

পাকিস্তানে মুজিবকে সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ আইনি সহায়তা দেবার জন্য এবং ন্যায় বিচার ও পক্ষপাতহীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য আসামী পক্ষের মামলা গ্রহণ করতে সরকার ব্রোহীকে বাধ্য করেছে।

তা সত্ত্বেও পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক শফি জানেন কী হবে মুজিবের মামলায় সামরিক রায়!

"অবশ্যই তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে, পরে তা ক্ষমা করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হবে।

এই সর্বোচ্চ শাস্তি পাকিস্তানে বৈধ আইনি বিচারকে প্রতিষ্ঠা করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্রোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। আর মৃত্যুদন্ড মার্জনা করে আমরা বিশ্বব্যাপী সুনাম ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারব।'

পাকিস্তানের সুনামের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে; কেবল মুজিবের মামলাই একমাত্র বিষয় নয় যা পাকিস্তানের সুনাম ক্ষুন্ন করছে।

আওয়ামী লীগের ১৬৭ জন জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যের মধ্যে মাত্র ৮৮ জন পশ্চিমের সাাথে সহযোগিতার কথা ব্যক্ত করেছে।

পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের ২৮৮ জন মুজিব অনুগামীর মধ্যে মাত্র ৯৪ জন নতুন পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে।

বাকী যারা শেখ ও তার দলের প্রতি এবং স্বায়ত্বশাসনের দাবির প্রতি বিশ্বস্ত রয়েছেন তাদের ২৬ আগস্ট ৮ টার মধ্যে স্ব স্ব জেলার সামরিক প্রশাসকের দপ্তরে হাজির হবার নির্দেশ দিয়ে দাপ্তরিক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। সেখানে পছন্দের উকিলবিহীন একটি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত তাদের অপেক্ষায় আছে।

যদি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা সত্যিই এই আদালতে হাজির হন তাহলে কি ঘটবে তার ধারণা মেজর ইফতেখার ডার স্পিগেলকে দিয়েছেন: 'একেক জন এমন আতঙ্ক ছড়াবে যে পর্যায়ক্রমে তার তিনপুরুষ এটা নিয়ে ভাবতে হবে।'

'পিপলস পার্টির নেতা রাজাকার সন্ত্রাসের কথা স্বীকার করছেন' — রয়টার্স


করাচি ১১ অক্টোবর ১৯৭১। পিপলস পার্টির একজন কর্মকর্তা পূর্ব বাংলা রওয়ানা হবার কয়েক ঘন্টা আগে নিজেকে প্রতিনিধি দল থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন দেশের পূর্বাঞ্চলে ক্ষমতা জনবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

পিপলস পার্টির করাচি শাখার সেক্রেটারি মিরাজ মোহাম্মদ খান গতকাল (১০ অক্টোবর) বলেছেন, তিনি মনে করেন, প্রতিনিধি হিসেবে তার যাওয়া একটি নিষ্ফল চর্চা মাত্র।

আওয়ামী লীগ সদস্যদের দখলে থাকা ৭৮টি আসনে আসন্ন পুননির্বাচনের জরিপ চালাতে দশ সদস্যের প্রতিনিধি দলের ঢাকা যাবার কথা।

মিরাজ অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনে পরাজিত এবং জনগণের প্রত্যাখ্যাত জনবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠির কাছেই প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে।

তিনি একটি রাজনৈতিক দল-মুসলিম জামায়াত-ই-ইসলামির নাম উল্লেখ করে বললেন, 'তারা রাজাকারদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পাইকারি হারে হত্যা করছে।'

বিশেষ করে ছাত্রদের উপর প্রভাব বিস্তারকারী এই নেতা আরো বলেছেন, 'যে সরকারের সদস্যদের মধ্যে জনবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি রয়েছে তাদের অধীনে অবাধ নির্বাচন হতে পারে না।'

গতকাল ১০ অক্টোবর পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুখ খুলেন। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও সরকার রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের জন্য কঠোর আচরণ বিধি বহাল করছে।

পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো গতকাল পার্টি প্রতিনিধিদের বলেন, 'আমরা গভীর মনস্তাপের সাথে গত আট মাসের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি চাই আপনারা আমাদের পূর্বাঞ্চলীয় ভাইদের বলুন: জাতীয় সমঝোতা সৃষ্টি হোক এবং প্রগতিশীল ও প্রশান্ত পাকিস্তান গড়তে আমাদের প্রতিশ্রুতি আগের মতোই বহাল রয়েছে।

ভুট্টো বলেছেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ও সবার প্রতি সদয় হয়ে টিকে থাকতে হবে।

ভুট্টো বলেছেন, 'অনেক রক্ত বয়ে গেছে এবং আমরা ভয়াবহ ট্র্যাজেডি দেখছি: পাকিস্তানিরা পাকিস্তানিদের হত্যা করছে যা রাষ্ট্রকে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে।' তিনি বলেন, 'পূর্ববঙ্গ অতীতেও শোষণের শিকার হয়েছে, ফলে তারা দরিদ্রই রয়ে গেছে।'

ভুট্টো আরো বলেছেন; 'পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কন্ঠস্বরকে অবশ্যই প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে হবে।'

'পাকিস্তানি নেতারা শেখের মুক্তি দাবি করেছেন' —রয়টার্স

পাকিস্তানের ৪২ জন রাজনৈতিক নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, আইনজীবী, লেখক ছাত্রনেতা সমাজকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গতকাল (৪ নভেম্বর ১৯৭১) শেখ মুজিবর রহমানের আশু মুক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।

ইশতেহারে সাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন ইশতিকলাল পার্টির প্রধান সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান, লেনিন পুরস্কার বিজয়ী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। তারা বলেন, যে সঙ্কট পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকি দিচ্ছে তা নিরসনের জন্য গণতান্ত্রিক সরকার গঠনই সর্বোত্তম পন্থা।

লাহোরে প্রকাশিত সম্মিলিত ইশতিহারে তারা বলেন, বিচারে মৌল আইন অনুসরণ করেই শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া যায়।

রাষ্ট্রদ্রোহের গুরুতর অভিযোগে সামরিক ট্রাইবুনালে বিচারাধীন শেখ মুজিবকে যদি মুক্তি দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে উম্মুক্ত আদালতে তাকে যথার্থ আইনি বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

রাওয়ালপিন্ডি থেকে তিন দিনের সফরে লাহোরে প্রেসিডেন্টের আসার সাথে এই ইশতেহার প্রকাশের তারিখ মিলে গেছে।

সাক্ষরদাতারা নিউজউইক পত্রিকাকে দেওয়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরে মুজিবের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। সাক্ষাকারে প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতি দাবি করলে তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত রয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয় যে গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকি দিচ্ছে, একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তা নিরসন করা সম্ভব হবে।

গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মাধ্যমেই এই সরকার গঠন করতে হবে। এটিই ছিল পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এই ইশতিহারে সাক্ষরকারী সকলেই বামপন্থী । সবচেয়ে বড় মুজিব-বিরোধী কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লাহোরেই প্রেসিডেন্টের কাছে এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিব মুক্তির দাবিনামা পেশ করা হলো।