১৯৭১-এর দুর্লভ স্মৃতিময় চিঠি

shamimanasrin_lily
Published : 1 April 2013, 06:56 AM
Updated : 1 April 2013, 06:56 AM

একাত্তুরের উন্মাতাল দিনগুলিতে লেখকের এই স্মৃতিচারণামূলক রচনাটি বিডিনিউজ২৪.কম-এর সমাজ বিষয়ক সম্পাদক ও মাননীয় সংসদ সদস্য বেবী মওদুদ-এর কাছ থেকে পাওয়া। লেখক শামিমা নাসরিন চৌধুরী লিলি আইসিডিডিআরবি-র প্রাক্তন কর্মকর্তা। রচনাটি প্রামাণ্য তথ্যে সমৃদ্ধ ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তথ্য ও মতামতের সকল দায়-দায়িত্ব লেখকের। পত্রের ভাষা যথাসম্ভব অবিকৃত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। একাত্তর সম্পর্কে এ-ধরনের আরো প্রামাণ্য চিঠি বা উপাত্ত পেলে আমরা তা আপলোড করতে আগ্রহী। – বিভাগীয় সম্পাদক

৩১শে জানুয়ারি ২০১২ সালে আইসিডিডিআরবি-র চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছি। বাসা বদলের সময় পুরনো কাগজপত্র বাছাই করতে বসেছি। পঁয়ত্রিশ বছরের কাগজপত্র বাছাই করা কি চাট্টি খানি কথা! কুড়ি বছরের বেশী হয় ঐ বাড়ীতে ছিলাম। আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। পুরানো কাগজ ফাইল গুছাতে যেয়ে বেশ কটি মূল্যবান তথ্যপূর্ণ চিঠি ও কাগজ পাই। দেখি লাল রং-এর একটি এরোগ্রাম। আমরা পাকিস্তান আমলে চিঠি লিখতাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম। চিঠিটি আমি ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সনে আমার বড়বোন সুরাইয়া কাজী ও দুলাভাই আজিজুল হক কাজীকে লিখেছিলাম। লেখা পড়তে গিয়ে আরো বিস্মিত হলাম, এটি যেন এক ছোট দলিল! যেখানে ঐ সময়ের অর্থাৎ ৭ই মার্চ ১৯৭১- এর আগে ও পরের ঘটনার বিবরণী আছে। চিঠিটি লেখা ছিলো ঠিকই, কিন্তু পরদিন পোস্ট করা হয় নি। ১৯৭১ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বহুবার আমার বড় বোনের সাথে দেখা হয়েছে- এ চিঠির কথা মনেই ছিলো না।একচল্লিশ বছর এক মাস লাগলো ওদের কাছে এ চিঠি পৌঁছাতে । এখানে বলে রাখা প্রয়োজন আমার বড়ো বোনের বিয়ে হয় ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর দুলাভাইয়ের সাথে আমেরিকাতে পাড়ি জমায় – সংসার জীবন শুরু হয় ওর ওখানেই।


চিঠিটা নীচে তুলে দিলাম:
"বড়াপু, দুলাভাই
অনেকদিন তোমদেরকে লিখিনি। পরীক্ষা ছিল তাই লেখা হয় নি। শুরু হয়েছিল ১৮ই জানুয়ারি '৭১। দেশের অবস্থা তোমরা নিশ্চয়ই voice of America থেকে শুনেছে। তাই পরীক্ষা বন্ধ হয়। এখনও7th & 8th paper এবং Viva বাদ আছে। 1st March-এ যখন ইয়াহিয়া ১টা ৫মিনিটে রেডিওতে ঘোষণা করলেন 3rd of March G National Assembly বসবে না এবং এটা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হল। তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না – কেমন করে, কোথা থেকে এত তাড়াতাড়ি ঢাকার পথে সব লোক জন বেরিয়ে এল। নানা ধরনের slogan দিতে লাগল। মনে হলো যেন within a second সব লোকজন বেরিয়ে পড়ল। ওরা সবাই বিক্ষুব্ধ। সারা প্রদেশের মানুষ কিভাবে এমন জেগে উঠল সেটা এক কথায় শেষ করা যাবে না। তোমাকে বলবো কি করে এ অবস্থার কথা। তারপর শুরু হলো ঢাকায় লুটতরাজ খুনোখুনি। সামরিক বাহিনী এল। তাদের গুলিতে মরলো অনেক। তারপর ৭ই মার্চ শেখ মুজিব রেস কোর্সের ময়দানে ঘোষণা করলেন আমাদের (পূর্ব পাকিস্তান, এখন এটাকে বলা হয় বাংলাদেশ) দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্তু আমরা Next কোন National যোগ দেব না। বড়াপু, দুলাভাই, এরমধ্যে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পোড়ানো হোলো। তার পরিবর্তে বাংলাদেশের তৈরী করা হলো। সেটা হলো ঘন সবুজের মাঝে লাল গোলক। তার মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র। লালটা সংগ্রামের প্রতীক। মানচিত্রটার রং সোনালী। কল্পনা করে নিয়ে জানাবে তোমাদের কেমন লাগলো। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস ছিল। শেখ মুজিবের কথামত এটা ছুটির দিন ছিল। সমস্ত বাংলা দেশে বাংলাদেশের পতাকা উঠানো হয়। ৭ই মার্চের পরে থেকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন (Non-violent, Non cooperation Movement) চলছে। হরতাল চলেছে অনেকদিন। স্কুল, কলেজ অফিস আদালত সব বন্ধ। আজকে National Assembly বসবাস কথা ছিল। সেটা স্থগিত রাখা হলো। শেখ মুজিব বললেন, আমাদের দাবী না হওয়া পর্যন্ত N.A. তে উনি যোগ দেবেন না। এটা তো জানোই Mujib Single Majority ভোট পেয়েছেন। ও হো, ৭ই মার্চের পরে থেকে আজও আমরা বাংলাদেশের সবাই কালো পতাকা তুলে বসে আছি। এর মধ্যে Governor Ahsanকে সরিয়ে দিয়ে আরেক জনকে এই পদে নিযুক্ত করা হলো। জনাব আহসান কিন্তু খুব ভালো লোক ছিলেন। যাক Tikka Khanকে পাঠানো হলো। আমাদের বিচারপতি ওনার oath নিলেন না। কত বড় অপমান টিককা খানের ভেবে দেখ। যাক অনেক দেশের কথা লিখলাম। আমি মলি ৯ই মার্চে বাড়ী এসেছি। জানি না কবে ঢাকা যাব। তোমরা এর মধ্যে আমাকে এখানের ঠিকানায় চিঠি লিখবে। রবিন, ম্যাকাইনকে আমার চুমু দিও। তোমরা সালাম জেন।
আমরা বাসার সবাই ভালো, লিলি।"


আজও ভেবে পাই না কি করে ঐ চিঠি একচল্লিশ বছর লুকিয়ে থাকলো। এতদিন কেন আমার মনে পড়ে নি? ঐ চিঠিটা এবং মেজর জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে "জয় বাংলা" লেখা স্বাক্ষর করা একটা কপি আমার কাছে কি করে পড়েছিল। হারিয়ে যেতে বা ছিড়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারতো। এ দুটো হাতে পাবার পর মনে হলো টাইম মেশিনের আলোর গতিকে ছাড়িয়ে ঐ উত্তাল দিনে চলে গেলাম।


৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনলাম রোকেয়া হলের প্রধান ভবনের পাঁচ তলা বারান্দার কোণা থেকে। রেস কোর্স মাঠ লোকে লোকারণ্য। সাহস পেলাম না সবার সাথে মাঠে যেতে। আমি পাঁচতলার ৬৩ নম্বর রুমে থাকতাম। ভাষণ শোনার পর আমরা সবাই আঁচ করতে পারলাম ভয়াবহ কঠিন কিছু আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে।

আমাদের বি.কম অনার্স পরীক্ষা চলছিলো তখন। ছয় পেপার পরীক্ষা শেষ, আরো দুটি বাদ রয়েছে! উত্তাল সময়। পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেল। আমার ছোট বোন মলি (সামিনা চৌধুরী) তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ও হোস্টেলে থাকে।আমরা দু'বোন ৮ই মার্চ সকালে ট্রেনে করে সিরাজগঞ্জ চলে এলাম। এসে দেখি মা-বাবা অস্থির হয়ে আছেন। আমরা যারা বাইরে আছি তারা সময় মত ফিরলাম কিনা, ফিরবো কিনা।

৯ই মার্চ অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো, সমস্ত যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হলো। দিন দিন সিরাজগঞ্জ শহর উত্তপ্ত হতে শুরু হলো। জেল থেকে সব কয়েদিকে ছেড়ে দেওয়া হলো। লোকজন সব মিছিল করতে শুরু করলো, দেখলাম বড় বড় রামদা তাদের হাতে। বিহারী, বাঙ্গালী, হিন্দু, মুসলমান, পাকিস্তানী নানা ধরনের বিরোধ। সামলানো কঠিন। রেডিওতে খবর শুনতাম। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা খবর শোনার জন্য। খুব তাড়াতাড়ি সিরাজগঞ্জের অবস্থার অবনতি হতে লাগলো। আব্বা প্রমাদ গুণলেন। ভাবলেন আমাদের বোনদেরকে 'ভারতে' পাঠাবেন। কিভাবে? ভেয়ে পেলেন না। ছোট মামা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলেন। বাসায় আমরা একটু প্রশিক্ষণও নিলাম বন্দুক চালানোর। এখানে উল্লেখ্য, আমরা বাড়ীর সবাই ভালো ভাবেই রাইফেল শুটিং পারতাম।

শহরের অবস্থার ভীষণ অবনতি দেখে আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদেরকে গ্রামে নানা বাড়ী ও দাদাবাড়ী পাঠিয়ে দেবেন। শহরের অনেক পরিবার বাড়ী ছেড়ে গেছে। ২রা এপ্রিল ১৯৭১ শেষ রাতের দিকে আমরা গরুগাড়ী করে গ্রামের যাব। আব্বাকে এত অসহায় কখনো দেখিনি। তার অভিভাবকত্বে তখন ছিলো চাচা, ফুফু, মামা আর আমরা ছয় ভাইবোন। শেষ রাতের আলোয় আব্বা আমাদের সবাইকে ৩০০ করে টাকা দিলেন আর বললেন, "জানিনা তোমরা আমরা কে কোথায় থাকবো! যেখানে থাকো বেঁচে থাকার চেষ্টা করো!" সে যে কি এক অসহায় চেহারা!! আমরা সবাই যার যার মত ছোট ছোট কাপড়ের ব্যাগে দু'তিনটা শাড়ি শালোয়ার কামিজ ও নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিলাম। অবস্থা ভালো হলে তো সবাই ফিরবো।

নানা বাড়ী ছেড়ে আরো ভিতরে লক্ষ্মীকোলা দাদাবাড়ী গেলাম। গেলাম বললে ভুল হবে; আমরা পালালাম। দাদাবাড়ীতে পূর্ব পুকুর ধারে মসজিদ ছোট্ট মক্তব, পশ্চিমে পুকুর, মাঝ খানে দাদাবাড়ী।

আমরা ভালো সাঁতার জানিনা। সাঁতার প্রশিক্ষণ নিলাম। পুকুরের মাঝখানে কয়েকটা বাঁশ পুঁতে দেওয়া হলো। যদি পাক আর্মি আসে তখন বিশেষ করে মেয়েরা পুকুরের মাঝখানে যাব; যাবার আগে পুকুর পাড়ের পেঁপে গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে মুখে করে পানিতে ডুব দেব। পেঁপে ডাল পাইনের মত কাজ করে। সাঁতার শেখা ও গোসল করতে করতে আমাদের প্রায় সবারই কানে অসুখ হলো। পুকুরে গোসল করার পর প্রায়শ:ই ৩০০টাকা ভিজে যেতো। তা আবার লুকিয়ে লুকিয়ে শুকাতে হতো।

আমাদের সাথে থাকতেন কওমী জুট মিলের ম্যানেজার সাহেবের পরিবার, তার মা, আর এক জন অফিসার জাফর সাহেব ও লোটাস কামাল। সে অনেক কথা। কিভাবে খাওয়া দাওয়া চলছে। বাড়িতে আরো অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন। যুদ্ধ লেগেছে। মরে যাব ভেবে অনেকে প্রতিদিন ঘরের পালা মুরগী খেতে থাকলো। এক মামা বললেন, "মরবু বলে সব খাবু বাঁচলে পরে কি খাবু?" কথাটা কত মূল্যবান।


যুদ্ধ চলাকালীন সেপ্টেম্বর মাসে আমরা আবার সিরাজগঞ্জ শহরে ফিরে এলাম। দেখলাম সমস্ত সিরাজগঞ্জ আগুনে পুড়ে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। আমরা চলে গেলাম কওমী জুট মিলে ম্যানেজার সাহেবের কোয়ার্টারে। জানতে পারলাম ঢাকা এখন স্বাভাবিক হয়েছে, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। বিশ্বাস হয়নি। সিরাজগঞ্জে থাকাও নিরাপদ নয়। চলে এলাম আমরা দু-বোনে ঢাকায়। উঠলাম ফুফুর বাড়ীতে ডিআইটি কোয়ার্টারে। হলে গিয়ে দেখলাম সমস্ত রুম ভরা ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র। তালা দেওয়া স্যুটকেস ও ট্রাংক ভাঙ্গা। কাপড় চোপড় লুট হয়ে গেছে। ভীষণ অস্বাভাবিক সে দৃশ্য।

ডিসেম্বর ১৯৭১ এগিয়ে এলো। ডিআইটির কোয়ার্টারে থাকি পাকিস্তান আর্মির সমর্পণের দিন এগিয়ে এলো। মুক্তিযোদ্ধারা ও ভারতের আর্মি বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এরপর ঢাকায় এলো। মর্টারের শব্দ শুনলাম। ১৬ই ডিসেম্বর সমর্পণের দিন। পাকবাহিনী অস্ত্র হাতে লাইন ধরে রেসকোর্স ময়দানে যাচ্ছে। দেখলাম যাবার পথে এলোপাথাড়ি গুলি করতে করতে তারা গেলো।

সেই যুদ্ধদিনের এক আতঙ্কভরা জীবন থেকে বিজয়ের দিনে এলাম। বিজয়ের আনন্দ যে কত বড় সেদিন বুঝতে পারলাম। আজ শুধু উপলব্ধি করি অনেক বেশি।