সাংস্কৃতিক মানচিত্রে মিরপুর

mofidul_hoque
Published : 6 May 2009, 11:53 PM
Updated : 6 May 2009, 11:53 PM

এক.
মুক্তির সঙ্গে জড়িত থাকে আনন্দ, অমারাত্রির অবসানে আলোয় স্নাত হওয়ায় তৃপ্তি কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে সমাপন বিজয়ে, সেখানে মুক্তির আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিচ্ছেদের অপার বেদনা। যে কোনো জয়ের পেছনে তো রয়ে যায় অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানে
—————————————————————–
এক গভীর বেদনার অধ্যায় রচিত হয়েছিল মিরপুরে, ঢাকার যে উপকণ্ঠে অস্ত্রের পাহাড় গড়ে এক অর্থহীন ও নিষ্ঠুর লড়াই চালিয়েছিল পাকবহিনীর কতিপয় সদস্য মূলত তাদের অবাঙালি দোসরদের ওপর নির্ভর করে।… এই মরণদংশন প্রকাশ পেয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যায়, প্রকাশ পেয়েছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মিরপুরে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা পাকাবাহিনীর দোসরদের নির্মমতায়, যাদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল জহির রায়হান, ডিএসপি লোদী, লেফটেন্যান্ট সেলিমসহ আরো অনেককে। অথচ মিরপুরের অবাঙালি প্রতিরোধের কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না, আত্মসমর্পণ না করে তাদের কোনো উপায় ছিল না।
—————————————————————-
মানুষ যখন পেল মুক্তির আস্বাদ, সেই আনন্দ-মুহূর্তে তো বিপুল মূল্যদানের স্মৃতিও বড়ভাবে আবার জেগে ওঠে। যুদ্ধের সমাপ্তি-লগ্নে আবিষ্কৃত হয়েছিল

……
১৯৭১ সালে মিরপর বধ্যভূমি
…….
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হাজারো মানুষকে হত্যা করার প্রায় এক ইণ্ডাস্ট্রিয়াল মেথড, মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার অতলস্পর্শী পতন। তবুও বিজয়ের আনন্দ ও মাহাত্ম্য তা কোনোভাবে খর্ব করতে পারে না, কেননা সেই বিজয় ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের, দানবের বিরুদ্ধে মানবের। কিন্তু বাংলাদেশের বিজয়ের সঙ্গে বেদনার যে মিশেল তার নিকট তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। একাত্তরের নয় মাস জুড়ে জাতিহত্যার যে যজ্ঞ পরিচালনা করেছিল পাকবাহিনী, সেটা তাদের কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারে নি, বরং ঠেলে দিয়েছিল অমোঘ পরাজয়ের দিকে। পরাজিত পাকবাহিনীর পলায়নের কোনো পথ ছিল না, ছিল না নিজস্ব কোনো পশ্চাৎভূমি, যেখানে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচে যেতে পারে তারা। তাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে গণ্য হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষপুট এবং ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পনে উদগ্রীব হয়েছিল তারা। এহেন পাকবাহিনী নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো যে পাশবিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছিল তা বাঙালির বিজয়ের আনন্দের ওপর মেলে দিয়েছে বেদনার নিবিড় ছায়া। এমনি আরো এক গভীর বেদনার অধ্যায় রচিত হয়েছিল মিরপুরে, ঢাকার যে উপকণ্ঠে অস্ত্রের পাহাড় গড়ে এক অর্থহীন ও নিষ্ঠুর লড়াই চালিয়েছিল পাকবহিনীর কতিপয় সদস্য মূলত তাদের অবাঙালি দোসরদের ওপর নির্ভর করে। এসবই ছিল শত্রুর মরণকামড়, প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকে বাঙালি জাতির সর্বনাশ ডেকে আনতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে তারা পিছ পা ছিল না। এই মরণদংশন প্রকাশ পেয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যায়, প্রকাশ পেয়েছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মিরপুরে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা পাকাবাহিনীর দোসরদের নির্মমতায়, যাদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল জহির রায়হান, ডিএসপি লোদী, লেফটেন্যান্ট সেলিমসহ আরো অনেককে। অথচ মিরপুরের অবাঙালি প্রতিরোধের কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না, আত্মসমর্পণ না করে তাদের কোনো উপায় ছিল না। যে-কারণে সরাসরি সংঘাতে অবতীর্ণ না হয়ে মিত্রবাহিনী চেয়েছিল প্রতিরোধের অসারতা প্রমাণ করে অস্ত্রধারীদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে। ফলে মিরপুর মুক্ত হতে বিলম্ব হয়েছিল। আর ৩০ জানুয়ারি যখন নিখোঁজ ভাই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে উদভ্রান্ত জহির রায়হানের দলের ওপর হামলা করে বেশ কয়েকজন বাঙালিকে তারা হত্যা করলো তখন মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর পাল্টা-আক্রমণে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো তথাকথিত সেই প্রতিরোধ। মিরপুর মুক্ত হতে বিলম্ব হয় নি আর, তবে সেই মুক্তি কেনা হয়েছিল অনেক তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে। তাই মিরপুর মুক্ত দিবস একই সঙ্গে আনন্দের ও বিষাদের এবং সেই বিষাদ যতো নিবিড়ই হোক শেষ পর্যন্ত মুক্তদিবস জয়গান করে আনন্দেরই, কেননা মানুষ তো জীবন দিয়েছিল মুক্তির পথ উন্মুক্ত করতে, আর তাই সকল শহীদ শেষ পর্যন্ত মুক্তির আনন্দের উদগাতা হিসেবে বরিত হন, তাঁরা হয়ে ওঠেন আগামীর যাত্রাপথের সঙ্গী।

দুই.
মিরপুরের সাত্ত্বিক নাট্য গোষ্ঠী তাই যখন মিরপুর মুক্ত দিবসের উৎসব আয়োজনে আমাকে সঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সেটা আনন্দ-বেদনার অংশী হয়ে শেষ বিচারে হয় প্রেরণার উৎস। এই প্রেরণা জীবনের বিকাশের যে সম্ভাবনা তৈরি করে স্বাধীনতা-উত্তর মিরপুর তার সাক্ষ্য বহন করছে। মিরপুর ঢাকার অদূরের এক প্রাচীন ভূমি, সংযোগ-নদী ঘেরা মিরপুর নৌপথে সহজে পৌঁছানো-সম্ভব স্থল, তদুপরি এখানে রয়েছে ঢেউ-খেলানো টিলা-সদৃশ ভূমি, যা বন্যাজলের প্রকোপ থেকে মুক্ত। ফলে মিরপুরে বসতি বেশ প্রাচীন, যদিও তা কোনো বিশাল জনপদ ছিল না। মিরপুরের সেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এখন আর নেই, সব কেটে-পিষে সমতল করে নেয়া হয়েছে উন্নয়নের বুলডজার চালিয়ে। পুরনো প্রকৃতির স্মৃতি বহন করছে সেনপাড়া পর্বতা নামটি, আর এর একমাত্র পরিচয় হয়ে রয়েছে টিলার ওপরের মাজার। বছর কয়েক আগে দিল্লি থেকে আগত এক লেখিকা আমাকে বলেছিল তাঁর ঠাকুরমার কথা, তিনি কখনো ভুলতে পারেন নি বাল্যকালের স্মৃতি। লেখিকার অবশ্য এমন কোনো স্মৃতি বা পিছুটান নেই, কোথায় ছিল ঠাকুরমার গ্রাম সেসবের কিছুই জানেন না। বিচ্ছিন্নভাবে মনে করতে পারেন পিতামহীর বাস ছিল ঢাকার অদূরে এক গ্রামে, সেই গ্রামের নাম মিরপুর এবং তাদের বাড়িতে ছিল এক পাঠশালা, আর বাড়ির নাম ছিল সিদ্ধান্তবাড়ি। এটুকু তথ্য থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না সেই গ্রাম এখন ঢাকার করতলগত এবং আদিবাড়ির কোনো চিহ্ন না থাকলেও মিরপুর সিদ্ধান্ত উচ্চ বিদ্যালয় উৎখাত হয়ে যাওয়া এক পারিবারিক জীবনের দাগ বহন করছে, জন্মদাগের মতো যা কখনও মুছে যাওয়ার নয়।

উৎখাতের পাশাপাশি নতুন বসতি গড়াও শুরু হয়েছিল নগরায়ণের চাপে। উন্মুক্ত উদার মিরপুর এ-কাজে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। দেশভাগের পর, বিশেষত ষাটের দশকের শুরু থেকে, মিরপুর হয়ে ওঠে পাকিস্তানি শাসকদের নতুন তরিকার দেশ গড়বার বড় ভিত্তি। মিরপুর ও মোহাম্মদপুর জুড়ে গড়ে তোলা হয় রিফিউজি টাউনশিপ, যে ধরনের বসতি পাঞ্জাব পার্টিশনের ভিকটিমদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান ও পশ্চিম ভারতে অনেক গড়ে উঠেছিল। মিরপুর মোহাম্মদপুরে সরকারি উদ্যোগে যে কলোনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে পাকিস্তানি বাঙালি-বিদ্বেষ নীতির চরম প্রকাশ ঘটিয়ে অবাঙালি মোহাজেরদের দেয়া হয় অগ্রাধিকার। উদ্দেশ্য ছিল এভাবে ঢাকা শহরে একটি বিশাল তাবেদার গোষ্ঠী তৈরি করা, যারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মদদদাতা হিসেবে কাজ করবে। এই দুই এলাকায় যেসব প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তার তথ্য উপাত্ত আমাদের হাতের কাছে নেই, কিন্তু বাস্তবতার পরিচয় তো সেকালে সর্বভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে, বিশেষভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ৬-দফা দাবিনামা ঘোষণার পর থেকে যে প্রতিরোধ আন্দোলন পূর্ববাংলায় জেগে উঠতে থাকে, ঊনসত্তরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির লক্ষ্যে যে আন্দোলন হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য, তা সংগঠিত করা সহজ ছিল না এবং মিরপুর-মোহাম্মদপুরে ছিল আরো অনেক দুরূহ ও কষ্টসাধ্য। কেননা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী করুণার প্রসাদ বিতরণ করে নিম্নবর্গীয় অবাঙালি মুসলিম মোহাজেরদের ভেতর থেকে একটি বিশাল অনুগতগোষ্ঠী তৈরি করে চলছিল। আর আমরা জানি, সবচেয়ে যারা ভাগ্যাহত, জমি-জমা ভিটেমাটি সবকিছু থেকে উচ্ছেদ হয়ে যারা সহায়-সম্বলহীনভাবে নতুন জীবন গড়ে তুলতে চাইছে, তাদের মধ্যে থাকে লুম্পেন প্রলেতারিয়েত, যারা পথভ্রষ্ট হয়ে নিজ শ্রেণীর স্বার্থের বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান নিতে দ্বিধা করে না এবং সমাজের ও মানুষের মুক্তির বিপরীতে এরা হয়ে ওঠে মরীয়া এক গোষ্ঠী। মিরপুরে এমনি এক সমর্থক সম্প্রদায় গড়ে তুলতে চেয়েছিল পাক সামরিক শাসক আইয়ুব খান, আর এর স্বীকৃতিস্বরূপ মোহাম্মদপুরে প্রবেশের মুখে নির্মিত হয়েছিল দ্বার, নাম দেয়া হয়েছিল আইয়ুব গেট। পাশাপাশি মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন সড়কের নাম রাখা হয়েছিল মোগল বাদশাহদের নাম-অনুসরণে, এমন কি শের শাহের সেখানে স্থান হয়েছিল, কেবল মহান এক মোগল সম্রাট এই পাকিস্তানি 'সম্মান' থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন আকবর, সমন্বয়ের ও সহনশীলতার সংস্কৃতি তুলে ধরে যিনি উপমহাদেশের ইতিহাসে সদা কীর্তিত হয়ে আছেন। বাদশা আকবর যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে পরিত্যাজ্য বিবেচিত হবেন সেটা স্বাভাবিক, কেননা যে-ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক ঘৃণার আদর্শ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবলম্বন সেখানে আকবরের উপস্থিতি তাদের কাছে কেবল অনভিপ্রেত নয়, তাদের জন্য ভীতিপ্রদও বটে।

মিরপুর-মোহাম্মদপুর তাই ঢাকার বুকে ভিন্নতর এক চারিত্র নিয়ে বিকশিত হচ্ছিল। গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের আন্দোলনকারীদের কাছে বিশেষ বিবেচ্য হয়ে উঠেছিল মিরপুর-মোহাম্মদপুর এলাকা। শাসকগোষ্ঠী এই এলাকায় নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলছিল, এর বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হয়েছে প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় মিরপুরের অবাঙালি অধিবাসীদের ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা নেয়া হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এখানে পথসভা ও মিছিল করে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাঙালি-অবাঙালি সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হলে বেগম সুফিয়া কামালসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন, কেননা সেটা ঘটলে গণ-আন্দোলনের জন্য হয়ে উঠতো ক্ষতিকর।

আবার মিরপুর-মোহাম্মদপুরের অবাঙালি অধিবাসীদের মধ্যেও পড়ছিল আন্দোলনের অভিঘাত। তাদের মধ্য থেকেও আন্দোলনের কাতারে এসে যোগ দিচ্ছিলেন কেউ কেউ, সংখ্যায় কম হলেও এই প্রবণতার ছিল বিশেষ তাৎপর্য। আমার মনে পড়ে মিরপুরের নবীন যুবার একটি গোষ্ঠী বিশাল ছাত্র-গণমিছিলে যোগ দিয়ে শ্লোগান ধরতো উর্দূতে, যোগ করতো মিছিলে নতুন মাত্রা। তাঁদের এক উচ্চকণ্ঠ শ্লোগান আজো কানে অনুরণন তোলে, "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়। সাচ আজাদি ছিন লো, রুটি-কাপড়া সব কো দো।"

কিন্তু গণতন্ত্রের পথে তো পাকিস্তান এগোতে পারলো না, ফলে গণতন্ত্রের শক্তি বিকাশের সুযোগ পেল না, লুম্পেনরাই হয়ে উঠলো নিয়ন্তা, সেটা যেমন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে হয়েছিল, তেমনি ঘটেছিল মিরপুরের অবাঙালি অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। এই লুম্পেনদের একাংশ ছিল বাস্তব সহায়-সম্পদহীন হিসেবে লুম্পেন, আরেক অংশ ছিল আদর্শগত ও মানবিক মূল্যবোধহীন লুম্পেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের ঘৃণাবোধ দ্বারা আচ্ছাদিত মানুষ, এদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল বিশ শতকের নৃশংসতম এক গণহত্যা, বেসমারিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল যথেচ্ছ হত্যাভিযান, কেবল বাঙালি হওয়ার অপরাধে খুনের শিকার হয়েছিলেন অগণিত মানুষ।

তিন.
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ কাক্সিক্ষত পথ বেয়ে এগোতে পারে নি। নানা বাধা-বিঘœ এসে মুক্তিপথে অগ্রগমন বাধাগ্রস্ত করেছে। পরাজিত শত্র" যে ঘৃণাভাণ্ড রেখে গিয়েছিল সেখান থেকে অনেক বিষ সমাজদেহে সঞ্চারিত হয়েছে। তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজশ ও বিদেশী ইন্ধন পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। এমনি পটভূমিকাতে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হত্যাকারীর আদর্শ বলপূর্বক প্রতিষ্ঠা পেল সমাজে, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা হলো ভূলুণ্ঠিত, ইতিহাসকে বদলাতে চললো নানা বিকৃত আয়োজন। এরই মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তির যে অব্যাহত অভিযাত্রা সেটা তো এগিয়ে চলে নানাভাবে, আর এই প্রয়াসে সংস্কৃতির রয়েছে অনন্য স্থান ও ভূমিকা।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নগরবাস্তবতা বিবেচনায় নিলে আমরা এক দ্রুত প্রসারমান নগরায়ণের দেখা পাই। ঢাকা শহর প্রসারিত হয়ে মহানগরে রূপান্তরিত হয়েছে, শহরে যত মানুষের বাস ছিল একাত্তরে তার চেয়ে অন্তত সাত-আট গুণ বেশি লোক এখন ঢাকায় বাস করে। ঢাকার জনসংখ্যার বিশাল অংশ আবার ভাসমান জনগোষ্ঠী। এর সঙ্গে তো রয়েছে নগরজীবনের নানা সমস্যা, সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা। এসবের অভিঘাতে নগরের যৌথজীবনযাত্রা নানাভাবে ভেঙে পড়ছে, জীবনযাত্রার আনন্দ যেন হরণ করছে জীবনযাপনের গ্লানি। এর প্রতিফল হিসেবে আমরা দেখি মহল্লা বা এলাকাভিত্তিক জীবনধারার বৈশিষ্ট্য ক্রমে অপসৃত হচ্ছে, সেই জায়গায় পরস্পর-বিচ্ছিন্ন এমন এক নগরজীবন গড়ে উঠছে যেখানে সামাজিক মিলনের অবকাশ বিশেষ নেই, যোগাযোগহীনতার মধ্যে মানুষ ক্রমশ হয়ে পড়ছে একা ও নিঃসঙ্গ।

দ্রুত নগরায়নের চাপে কুণ্ঠিত মানুষের বিনোদন, সংস্কৃতি ও সংবাদের একান্ত নির্ভর হয়ে পডছে টেলিভিশন, টেলিভিশনের মাধ্যমে এক কাল্পনিক যোগসূত্র রচনা করে মানুষ সামাজিক জীব হয়ে উঠতে চাইছে, যা আসলে সোনার পাথরবাটি চাইবার মতোই বিষয়। এহেন পরিস্থিতিতে সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব অনেক বেশি তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতি মানুষকে সমাজবদ্ধ করে রাখে এবং সমাজবদ্ধ মানুষই পারে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য ভূমিকা পালন করতে। ঢাকা মহানগরীর সাংস্কৃতিক মানচিত্র যদি আমরা বিবেচনায় নেই তবে মিরপুরের জায়মান ও ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক অবস্থান আমাদের একটি ভরসা যোগায়। নগরায়ণ মানুষকে গ্রাস করে নির্মানব করে তুলতে চাইছে আর সংস্কৃতি গড়ে তুলছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন, তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে। জগতের আনন্দযজ্ঞে এই নিমন্ত্রণ বিভিন্নভাবে বিভিন্নজনের কাছে পৌঁছে দেয় সংস্কৃতি।

পুরনো ঢাকা, বায়ান্নো বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও সমাজ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিল। একদিকে ছিল চকবাজার, পাটুয়াটুলি, বংশাল, মাহুৎটুলি ঘিরে নবাবি আমলের ঢাকার জের-বহনকারী মিশ্র সংস্কৃতি, অপরদিকে গেণ্ডারিয়া, ওয়ারি, পুরানা পল্টন বলয়ে মূলত শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে আধুনিক সংস্কৃতি। এর সঙ্গে আরো কতোই-না উপাদানের মিলন-মিশ্রণ ঘটেছিল। দেশভাগের পর যে নতুন বিকাশ শুরু হয় কমলাপুর-মালিবাগ অঞ্চলে সেখানে ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হয়েছিল, তবে উচ্চবিত্তের ধানমণ্ডিতে তার কোনো আভাস ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী নগরায়ণ কীভাবে যেন গ্রাস করে নিল ঢাকার এই পাড়াভিত্তিক সাংস্কৃতিক শক্তি। সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে মহল্লা বা এলাকাভিত্তিক সম্পৃক্তি ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে, বহুতল ভবনের চাপে হারিয়ে যায় পুরনো আবহ, পাড়ায়-মহল্লায় মিলনের পরিসর বলতে কিছু থাকে না, উঁচু উঁচু অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা কেউ কাউকে চেনেন না, আজ আছেন তো কাল নেই, কোনো মানবিক বন্ধন গড়বার সুযোগ বা অবকাশ নেই। নগরায়ণ যখন সংস্কৃতির টুটি চেপে ধরছে তখন বিগত আশির দশক থেকে, বিশেষত এরশাদের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের পথ বেয়ে মিরপুরে একটি সাংস্কৃতিক উজ্জীবন আমরা লক্ষ্য করি। সঙ্গীত ও নাটকের চর্চায় মিরপর নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। অনেকগুলো দল বিশাল তরুণগোষ্ঠী নিয়ে সংস্কৃতি-চর্চায় ব্রতী রয়েছে। মিরপুর সাংস্কৃতিক ঐক্য ফোরাম নামে একটি জোটও গড়ে উঠেছে। অথচ নগরপালেরা শহর-পরিকল্পনায় সংস্কৃতির জন্য কোনো আলাদা জায়গা রাখেন নি, আলাদা কোনো বরাদ্দের তো প্রশ্নই নেই। তারপরও মিরপুরে সমাজ যে তার নিজ শক্তি খুঁজে পাচ্ছে সেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ঢাকা মহানগরের পাড়া বা বসতিগুলো যখন মরে যাচ্ছে তখন মিরপুরের এই জাগরণ কিংবা বলা যায় জাগরণের লক্ষণ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। প্রতি বছর মিরপুর মুক্ত দিবস কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক আয়োজন নিবেদিত হয় তা মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক মেলবন্ধনের অনুপম প্রকাশ ঘটায়। মিরপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নানা দিক এর ফলে প্রকাশের নতুন মাত্রা খুঁজে ফিরছে। এমনি এক তাগিদের পরিচয় আমরা দেখতে পাই বাংলা কলেজ বধ্যভূমি ঘিরে ছাত্রছাত্রীদের নেয়া উদ্যোগে। স্থানীয় তরুণ সমাজ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে পরিচালিত এই আন্দোলন এখন জাতীয় স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং আমরা আশাবাদী হতে পারি অচিরে এই বধ্যভূমি ঘিরে নির্মিত হবে যথাযথ স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সুবাদে জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ ঘিরে যে নানামুখি কর্মকাণ্ডের স্ফূরণ আমরা দেখি সেটাও স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজের শক্তিময়তার দিক।

বস্তুত ভারতবর্ষীয় সমাজের এই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারবার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন পশ্চিমী ধারণা-প্রসূত শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারতে কখনো ছিল না, তেমন রাষ্ট্র নির্মাণে ভারতবাসীর আগ্রহও ছিল না, তারা বরং নির্ভর করেছে সমাজের শক্তির উপর। উপনিবেশিক যুগ ভারতে যে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের ধারণা বয়ে এনেছিল এবং তা ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দিয়েছিল সেটা রবীন্দ্রনাথের কাছে মনে হয়েছিল উপনিবেশিকতার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক। রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন যে, সামাজিক ভিত্তির কথাটা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রিক ইমারতের কল্পনায় মুগ্ধ হয়ে কোনো লাভ নেই। তাঁর মতে পাশ্চাত্য রাজার শাসনে এইখানে ভারতবর্ষ আঘাত পেয়েছে, গ্রামে গ্রামে তার যে সামাজিক স্বরাজ পরিব্যাপ্ত ছিল, রাজশাসন তাকে অধিকার করলো। তিনি লিখেছিলেন "চিরদিন ভারতবর্ষে ও চীনদেশে সমাজ-তন্ত্রই প্রবল, রাষ্ট্রতন্ত্র তার নিচে, দেশ যথার্থভাবে আত্মরক্ষা করে এসেছে সমাজের সম্মিলিত শক্তিতে। … … … রাষ্ট্রপ্রধান দেশে রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যেই বিশেষভাবে বদ্ধ থাকে দেশের মর্মস্থান, সমাজপ্রধান দেশে দেশের প্রাণ সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে থাকবে।"

সমাজের শক্তিতে রবীন্দ্রনাথ যে-আস্থা প্রকাশ করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি, বরং অর্জন করেছে অধিকতর তাৎপর্য। মিরপুরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সামজের এই শক্তিময়তার একটি পরিচয় আমরা পাই, বুঝতে পারি আমাদের নতুনভাবে ভাববার প্রয়োজন রয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধ যে সামাজিক শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছিল সেই গৌরব থেকে প্রেরণা নিয়ে সমাজশক্তির বিকাশমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিপথের দিশা আমরা পেতে পারি। সমাজশক্তির সেই বন্দনাগান গাইছেন মিরপুরবাসী এবং মিরপুরের নবীন-নবীনা। তাদের জয় হোক।

(সাত্ত্বিক নাট্য সম্প্রদায় আয়োজিত মিরপুর মুক্ত দিবস ও মিরপুর উৎসবের নবম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পঠিত প্রবন্ধ)

mofidul_hoque@yahoo.com
—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts