‘একুশের সংকলন’- একটি দুর্লভ পুস্তিকা

ফারুক আলমগীরফারুক আলমগীর
Published : 21 Feb 2020, 04:19 AM
Updated : 21 Feb 2020, 04:19 AM


১.
কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলনের কথা সর্বজনবিদিত। ১৯৫৪ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিলো। পুঁথিপত্র প্রকাশনীর পক্ষে তার প্রকাশক ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সৈনিক ও পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রের স্বাপ্নিক বামপন্থী নেতা মোহাম্মদ সুলতান। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সেই সময়ের তরুনদের প্রতিবাদী, সংগ্রামী ও দীপ্তিময় লেখা ও কবিতায় উচ্চকিত একুশের এই সংকলন 'একুশে ফেব্রুয়ারি' অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিলো। অনস্বীকার্য যে, কবি হাসান হাফিজুর রহমানকৃত উল্লিখিত সংকলন এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। এই সংকলনটি তৎকালীন স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের রুদ্ররোষে পতিত হয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।



'একুশে ফেব্রুয়ারি' সংকলনটির পর পর আর কোন সংকলনের সন্ধান পাওয়া যায়নি, অন্তত আমি পাইনি। তবে ১৯৫৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরূপে খুব সম্ভবতঃ স্কুলের কাছাকাছি কিম্বা বাংলা বাজারের বইয়ের দোকানের সামনের ফুটপাত থেকে একটি সংকলন সংগ্রহ করেছিলাম, যা এতদিন, এতকাল পর স্তুপীকৃত আমার নানা সংগ্রহ সম্ভার থেকে আচানক বেরিয়ে এসেছে। আমার বালক হাতের নামাঙ্কিত সপ্তম শ্রেণী লেখা ১৯৫৬ সালের এই 'একুশের সংকলন'-টি খুঁজে পেয়ে যারপর নাই আশ্চর্য ও উত্তেজিত বোধ করলাম, কারণ এই সংকলনটির প্রেক্ষিতে ভাষা সংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তিনি তখন ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের শিক্ষক। আমি ঐ স্কুলের ছাত্র না হলেও আমার ছোটবেলার বসবাসের সন্নিকটে ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে লালবাগ, আজিমপুর, শেখ সাহেব বাজার, পলাশী ও ঢাকেশ্বরীর অধিকাংশ আমার বয়সী ও খেলার সঙ্গীরা পড়াশুনা করতো। আমাদের বন্ধুদের শিক্ষক বলে আমিও তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করতাম। তিনি সাইকেলে চলাচল করতেন এবং মনে পড়ে একদিন পলাশীর মোড়ে বাস থেকে নেমে তাঁর সামনে পড়লাম। সদরঘাট থেকে স্কুল ফেরৎ আমার পাঠ্য-পুস্তকের সঙ্গে 'একুশের সংকলন' পুস্তিকাটি দেখে তিনি অবাক হলেন ও কৌতুহলী হলেন। তিনি আমার নাম ঠিকানা জানতে চাইলেন এবং এই বইটির মুদ্রন ও প্রকাশে তাঁর ভূমিকার কথা জানালেন। দেখলাম এই বইয়ের ব্লক ও টেলপিস পুঁথিপত্র ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সৌজন্যে প্রাপ্ত। তিনি আমাকে এস.এম হলের সামনে টিন ও বাঁশের বেড়া দেয়া লাইব্রেরির মতোন একটি দোকানে নিয়ে গেলেন। এই দোকানটিই ছিলো পুঁথিপত্র প্রকাশনীর দপ্তর, একুশের প্রথম সাড়া জাগানো হাসান হাফিজুর রহমানের 'একুশে ফেব্রুয়ারি'-র আঁতুড়-ঘর। ঐ আঁতুড়-ঘরেই আমি সংকলটি স্যারের কল্যানে দেখার এবং উল্টে-পাল্টে কিছুটা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সংকলনটি তখন দুষ্প্রাপ্য ও নিষিদ্ধ গ্রন্থ।

যাক্ মূল কথায় আসি। আমার সংগ্রহ সম্ভারে আচানক আবিষ্কৃত ঊনপঞ্চাশ পৃষ্ঠার সংকলনটির নাম "একুশের সংকলন"। সম্পাদনা করেছেন যৌথভাবে ডি.এ. রশীদ ও মহিউদ্দীন আহমদ; প্রকাশ করেছেন ৩৪ শরৎ গুপ্ত রোড থেকে ফারুক মোজাম্মেল, মুদ্রাকর মোহাম্মদ আছলামঃ তাজ প্রিন্টিং ওয়ার্কাস ঢাকা, পরিবেশকঃ নওরোজ কিতাবিস্তান, ৪৬ বাংলা বাজার, ঢাকা। পুস্তিকাটির মূল্য সেই কালের তুলনায় অনেক বেশী মনে হয়, এক টাকা আট আনা। অত পয়সা দিয়ে কেনার সামর্থ্য আমার বালক বয়সে ছিলো না। খুব সম্ভবতঃ ফুটপাত থেকে আমি বড়জোড় আট আনায় তা কিনেছি অথবা কোনভাবে সংগ্রহ করেছি।

সম্পাদক দু'জনের একজনের পরিচিতি বড় হয়ে আমি জেনেছি। তিনি হলেন ডি.এ. রশীদ, একজন নির্ভীক সাংবাদিক, লেখক ও সাহিত্য কর্মী, দৈনিক সংবাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। তাঁর করা নায়ায়ণগঞ্জের নিষিদ্ধ পল্লীর ধারাবাহিক রিপোর্ট সেই সময় আলোড়ন তুলেছিলো। অন্যজন বোধ করি প্রগতিশীল লেখক-গল্পকার ও পরবর্তীতে চলচ্চিত্রকার মহিউদ্দীন আহমদ। দু'জনেই তাদের সময়ে খুবই বিখ্যাত ছিলেন।


'একুশের সংকলন' পুস্তিকাটির শুরু হয়েছে জহির রায়হানের বিখ্যাত 'একুশের গল্প' দিয়ে, নায়ক তপু নামের একজন মেডিকেল ছাত্র যার সতীর্থ লেখক নিজে আর রাহাত, অর্থাৎ তিনজন। চার বছর আগে তপুকে ওরা শেষ হাইকোর্টের মোড়ে দেখে, সেই তপু কিনা চার বছর পর ফিরে এসেছে। অথচ ডাক্তারি পাশ করে তার ঢাকায় থাকার কথা ছিলো না, সে দু'বছর তাদের সাথে পড়ার পর একদিন মস্তবড় লাল কালিতে লেখা "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" প্ল্যাকার্ড নিয়ে মেডিক্যাল গেট, কার্জন হল পেরিয়ে হাইকোর্টের মোড়ে পৌঁছাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলো কপালের মাঝখানটায় গোল রক্তাক্ত গর্ত নিয়ে। সেই তপু ফিরে এসেছে তাদের কাছে এনাটমির বিষয় হয়ে মেডিক্যাল হোস্টেলে তপুর সিটে আসা নতুন ছেলের কাছে যার স্কালের মাঝখানটায় ছিলো গর্ত আর বাঁ-পায়ের 'টিবিয়া ফেবুলা'টা দু'ইঞ্চি ছোট, যেমনটি ছিলো তপুর বাঁ হাড়টা দু'ইঞ্চি ছোট। মনে পড়ে ছোট বেলায় এই গল্পটি পড়ে বার বার শিউরে উঠেছি। পরবর্তীতে জহির রায়হানের 'গল্প সমগ্র' গ্রন্থে এটি স্থান করে নিয়েছে।

ডি.এ. রশীদ লিখেছেন 'একুশের ডায়রী' শীর্ষক লেখা যেখানে ১৯৫৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশে ৯২ (ক) ধারার শাসন ও একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারীর কথা। ১১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হলেও সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের নির্দেশে ছাত্র-ছাত্রীসহ আপামর মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারি ভোর হবার আগেই নগ্নপদ মিছিলে প্রভাত ফেরি করে বেরিয়ে আসে। পুলিশ বিভিন্ন ছাত্রাবাসসহ মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গনে নির্মিত 'শহীদ স্মৃতি স্তম্ভের' স্থানে জমায়েত হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হামলা করে দশজনকে গ্রেফতার করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। ডি.এ. রশীদের ভাষায় "বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষে ওঠে কালো পতাকা। তারপর আম গাছের নীচে জমা হয়ে তারা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, শহীদ স্মৃতি অমর হউক, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, পুলিশী জুলুম বন্ধ কর। মূহুর্তেই ঘিরে ফেলে শত শত পুলিশ। তারা হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ঢুকে নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের উপর চালায় বেপরোয়া লাঠি। তারপর বহু আহত ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেফতার করে পুলিশ লালবাগে নিয়ে চলে। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খবর আসে বহু ছাত্রের গ্রেফতার হওয়ার। …………… যে আইন আমাদের কণ্ঠকে রোধ করতে চেয়েছিলো আমাদের বুকের দাবীকে পদদলিত করতে চেয়েছিলো, তাকে ভেঙ্গেছিলাম আমরা। আর তাতেই বন্দী হয়ে ঢুকলাম ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। আমরা দু'শ এক পঞ্চাশ জন। পাকিস্তানের গণ আন্দোলনের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে আজ। ২২ জন বোনও ভাষার দাবীতে বন্দী হয়ে এসেছে। প্রীতি, কল্পনার দেশের বোনেরাও আজ আর ঘরে বসে নেই।" ডি.এ. রশীদের ডায়রির এই ভাষ্য থেকে ১৯৫৫ সালে ৯২ (ক) ধারা ভাঙ্গার সাহসী ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায় যেখানে শুধু মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকা নয়, তিনি জেলে ঢুকে দেখেছেন স্কুলের দশ বছরের বাচ্চা ছেলেরাও ভাষার দাবীতে বন্দী হয়ে এসেছে।


এই সংকলনে দু'টি কবিতা রয়েছে একটি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা গাজীউল হক ও অন্যটি সংকলনটির প্রকাশক ফারুক মোজাম্মেলের। এছাড়া মোরশেদ চৌধুরী ও মহিউদ্দীন আহমদের গল্প এবং টিপু সুলতানের একটি ইতিহাস ভিত্তিক রচনা। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক ও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন মেধাবী ছাত্র ও ভাষা সংগ্রামী আনিসুজ্জামানের "একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা" নামক দীর্ঘ প্রবন্ধ। সংকলনের ৪১ থেকে ৪৮ পর্যন্ত প্রায় আট পাতার দীর্ঘ প্রবন্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান "বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত দাবীই এদিনের প্রধান আওয়াজ হলেও" ও এর প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্ন এবং ঐসব ক্ষেত্রে আশাহত হবার বিশদ বিষয় অত্যন্ত বিশ্লেষণমূলকভাবে তুলে ধরেন। সেদিনের মেধাবী শিক্ষার্থী বলছেন "একুশে ফেব্রুয়ারি অন্য কোন ভাষার সঙ্গে আমাদেরকে বিরোধ করতে শেখায়নি, জনসাধারণের ভাষার মর্যাদা, অধিকার ও উন্নতির প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়েছে। এ দিনের চৈতন্য তাই সমগ্র দেশকে ডেকে বলেছেঃ মাতৃভাষাকে ভালবাসুন, তার উন্নতির চেষ্টা করুন, তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন- ভাষাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করুন।"
স্মতর্ব্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের তরুণ বয়সে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সরাসরি ছাত্র হওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম এবং ষাট দশকের প্রথমার্ধে সেই সময়ে তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ ও নির্দেশ গ্রহণ করেছিলাম।


'একুশের সংকলন' পুস্তিকাটি শেষ হয়েছে 'একুশের গান' শীর্ষক একটি গীতি-কবিতা দিয়ে। এটির রচয়িতা আরেকজন ভাষা সংগ্রামী তোফাজ্জল হোসেন। এই তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে আমি অনেক পরে পরিচিত হয়েছি, তখন তিনি আমার বয়ঃজেষ্ঠ্য সহকর্মী (সিনিয়ন কলিগ)। সেটা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকাল, সত্তর দশকের প্রথমার্ধ। বয়সে অনেক বড় এই সজ্জন ব্যক্তিটিকে আমি 'অগ্রজ' বলে সম্বোধন করতাম এবং তিনিও আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। এই ভাষা সংগ্রামীর আরেক পরিচয় হলো তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাতের পিতা। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদপ্তরের 'অতিরিক্ত প্রধান তথ্য অফিসার' হিসেবে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। তাঁর লেখা 'একুশের গান' শীর্ষক রচনাটির কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করলামঃ
"শহিদী খুন ডাক দিয়েছে/ আজকে ঘুমের ঘোরে/ আজ রক্তপথের যাত্রী মোরা/ নতুন আলোর ভোরে/ ভেঙ্গে ঘুমের স্বপ্ন নীল/ এক মিছিলে হও সামিল/ এগিয়ে চলেই হানব আঘাত/ নূতন যুগের দোরে ………..। [উল্লেখ্য ১৯৫৬ সালের শহীদ দিবসে ঢাকার রাজপথে প্রভাত ফেরীর গান হিসেবে গীত হয়েছিল বলে রচনাটির শেষে সম্পাদকীয় মন্তব্য রয়েছে।
আমার মনে হয় কবি হাসান হাফিজুর রহমানের 'একুশে ফেব্রুয়ারি', সেই আলোড়িত প্রথম সংকলটির পরে ভাষা আন্দোলনের উপর একুশের দিনে প্রকাশিত এটিই হয়তো দ্বিতীয় সংকলন যা কলেবরে ছোট ও দামেও সস্তা। 'একুশের সংকলন'-এর প্রচ্ছদ কার করা কোথাও উল্লেখ না থাকলেও তুলির আঁচড় দেখে মনে হয় এটি আরেক ভাষা সংগ্রামী শিল্পী এমদাদ হোসেনের অংকন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে।