আমার বন্ধু হাসান আজিজুল হক

গোলাম মুরশিদ
Published : 16 Nov 2021, 04:48 PM
Updated : 16 Nov 2021, 04:48 PM


নিজের নামের আগে আর-একটা নাম জুড়ে দিয়েছিলেন হাসান। সেটা আরবি কী বাংলা, আমার জানা নেই। আমি ধরে নিতাম বাংলা। সমাস ভেঙে নামটার অর্থ আমি করেছিলাম: অন্যদের যিনি হাসান, সেই আজিজুল হক। সবাই কিনা জানি না, কিন্তু বিষাদে আক্রান্ত হলে আমি সোজা হাসানের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হতাম। উনি দুপুরে খাবার পর সুখ নিদ্রায় নিমজ্জিত, নাকি অন্য কোনো কাজে জড়িয়ে গেছেন –সেটা আমি বিবেচনা করতাম না; সম্ভবত অন্যরাও করতো না, এমন কি উনিও না। কেবল অসময়ে যাওয়ার জন্যে ভাবী হয়তো বিব্রত হতেন। সেই হাসানো আজিজুল হক কয়েক ঘণ্টা আগে বন্ধুদের ছেড়ে চলে গেলেন। শেষ মুহূর্তে তাঁর মাথায় কি হাস্যরসের ধারাটি কাজ করছিলো? মৃত্যুদূতকে দেখে হাসান কি এমন কোনো রসিকতা করেছিলেন, যা শুনে মৃত্যুদূত স্বয়ং হেসে খুন।
হাসানকে প্রথম দেখি ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি। সেদিন আমরা কয়েক বন্ধু মিলে বিদ্যাসাগরের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিদ্যাসাগর সার্ধশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ নামে আমরা একটি বই প্রকাশ করি। আনুষ্ঠানিকভাবে সে গ্রন্থ প্রকাশ করতে আমরা হাসানকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম প্রধান অতিথি হিসেবে। শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করার মতো একটি অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন তিনি। সামনেই ঐতিহাসিক এবং আশা-জাগানো সাধারণ নির্বাচন। দেশে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে। স্বাধীনতার সুখস্বপ্ন সবার চোখে। হাসান তাঁর পুষ্পিত ভাষায় বললেন যে, আমাদের স্মারকগ্রন্থটি এই অশান্ত পরিবেশের মধ্যে মহুয়ার নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। পরের দিন প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতা হাসানের কথা—আমাদের কথা—তুলে ধরেছিলো।
হাসান তখন অধ্যাপনা করতেন খুলনার বিএল কলেজে। তাঁর বক্তৃতা আমাদের সবাইকে আকৃষ্ট করেছিলো। তবে যুদ্ধের মাসগুলোতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। যুদ্ধের পরে অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ উপাচার্য হয়ে রাজশাহীতে এলেন। তারপর কয়েক মাসের মধ্যেই হাসানকে দৌলতপুর থেকে রাজশাহী নিয়ে এলেন। হাসান রাজশাহীতে এসেই সেখানকার আকাশে দেখা দিলেন মধ্যাহ্নের সূরযের মতো। কোনো একজন শিক্ষক যে, একটা বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে অমন করে উজ্জীবিত করতে পারেন, হাসানের আবির্ভাব তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খান সারওয়ার মুরশিদ এবং হাসান দুজনই এই কৃতিত্বের দাবিদার। কে বেশি, সেটা বিশ্লেষণের ব্যাপার।
আমরা ন-দশজন শিক্ষক ক্লাবের বাইরে একটি বাঁধানো চত্বরে বসে আধা-অন্ধকারে আপাতদৃষ্টিতে হাতিঘোড়া মারতাম। আমাদের নিয়ে ক্লাবের আলোকিত ঘরগুলোতে যাঁরা ধূমায়িত গুরুত্বপূর্ণ গুরুগম্ভীর গল্পগুজব করতেন, তাঁরা বিস্তর বক্রোক্তি করতেন। কিন্তু আমাদের আলোচনা অচিরে পত্রিকার পাতায় ছাড়া পেতো। অন্তত আমি বলতে পারি, হাসান, সনৎ, আলী আনোয়ার এবং অন্য অনেক বন্ধুর চিন্তাধারা আমাকে প্রভাবিত করেছিলো।
১৯৭৮ সালে আমি সপরিবারে মেলবোর্নে যাই পোস্ট-ডক্টোরাল কাজে। ইন্ডিয়ান স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়। আমার অনুরোধে তিনি হাসানের জন্যে একটি স্কলারশিপ জোগাড় করে দেন। হাসান যে ক মাস মেলবোর্নে ছিলেন, সে ক মাস আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে রাজশাহীতে ফিরে যান। ৮০ সালের শেষ দিকে আমি রাজশাহীতে ফিরে আসি। ৮৩ সালের শেষে আবার লন্ডনে চলে আসি। হাসানকে একটি সাহিত্য চক্রের মাধ্যমে লন্ডনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি। তিনি দুতিন মাস আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। লন্ডনে দেখার এতো জিনিশ আছে যে, হাসান এ সময়ে একটি ডাইরি রাখেন। পরে তিনি এই ডাইরির ভিত্তিতে একটি বই লেখেন। বইটি তিনি আমার স্ত্রী এলিজার নামে উৎসর্গ করেন।


আমার কাছে সে সময়কার যে-স্মৃতি সবচেয়ে উজ্জ্বল, তা হলো আমাদের দুজনের প্যারিস ভ্রমণ। ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হাসানের বন্ধু আমাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। পাঁচ দিন আমরা সেখানে ছিলাম। শেষ দিন গিয়েছিলাম ভার্সাইতে। ভার্সাই-এর রাজপ্রাসাদ তার সৌন্দর্য ও বিশালতার জন্যে বিখ্যাত। কিন্তু আমার মনে ছিলো ভিন্ন এক উদ্দেশ্য। আমি তখন গবেষণা করছিলাম মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে। তাঁর স্ত্রী, হেনরিয়েটার পরিচয় জানা যায় না। লোকে বলতো, তিনি ছিলেন ফরাসী। মাইকেল সপরিবারে ভার্সাইতে ছিলেন প্রায় তিন বছর। তাঁর দুটি সন্তানের জন্ম সেখানে। আমি চেয়েছিলাম, সেখানকার মিউনিসিপাল আর্কাইভস থেকে কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায় কিনা। পেয়েছিলাম। জানতে পাই, হেনরিয়েটা ফরাসী নন, ইংরেজ। তাঁর বাবা-মায়ের পরিচয়ও জানতে পেরেছিলাম। পরের দিন আমরা লন্ডনে ফিরে আসি।
হাসান গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। গল্প করতে ভালোবাসতেন। বাঙালি আড্ডাবাজ, তিনি ছিলেন বাঙালি-শ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ আড্ডাবাজ। তাঁর আর-এক পরিচয় তিনি ছিলেন দেশের বিবেক। যে-কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংকট-কালে তিনি কলম হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আগুনের অক্ষরে বিবৃতি দিতেন, জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা করতেন। কী পূর্ব পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলে, কী স্বাধীন বাংলাদেশ কালে শত রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে তিনি নিজে এগিয়ে গেছেন, অন্যদের এগিয়ে দিয়েছেন। ছোটোগল্পকার হিসেবে আরও কেউ হয়তো এসে তাঁর পাশে দাঁড়াবে, কিন্তু এমন বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ, এমন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, আবার আসবে কিনা, কে জানে? আমি হাসানকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।
ভেবেছিলাম তাঁকে নিয়ে অনেক লম্বা একটা লেখা লিখবো। পঞ্চাশ বছরে তো অনেক কথাই জড়ো হয়েছে! কিন্তু আমার মনের অবস্থা তেমন নয়। তাঁর পুরস্কার, তাঁর স্বীকৃতি, তাঁর কীর্তি ইত্যাদির কথা তো অন্যরা লিখবেন। আমি আপাতত আমার এই প্রিয় বন্ধুর প্রয়াণে শোক ও শ্রদ্ধা জানাই।