সাহিত্য চুলায় যাক, আমরা নিঃসঙ্গ আজ বুলবুল ভাই

ইমতিয়ার শামীম
Published : 29 August 2021, 01:36 AM
Updated : 29 August 2021, 01:36 AM


আলোকচিত্র: ২০২০ সালেও বুলবুল চৌধুরী ছিলেন ছুটে বেড়ানো প্রাণবন্ত মানুষ। ছবি তুলেছেন কামরুল মিথুন

সকালেই কথা হচ্ছিল ধ্রুব এষের সঙ্গে–শুক্রবার ও গিয়েছিল বুলবুল ভাইয়ের বাসায়। একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন তিনি, ডাকলে এত আস্তে 'উ' বলে উত্তর দেন যে, মনে হয় অনেক-অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে দূরগামী কারো কণ্ঠস্বর। ওর মধ্যেই তাঁকে দেখতে আসা আরেকজন বার বার জিজ্ঞেস করছেন তাঁকে, 'বুলবুল ভাই, আমাকে চিনতে পারছেন?… বুলবুল ভাই, আমাকে চিনতে পারছেন?' ধ্রব বলছিল, আমার খুব রাগ হচ্ছিল, আরে ব্যাটা, এই প্রশ্ন করার দরকার আছে নাকি? উনি যে কী অবস্থায় আছেন, তা তো নিজের চোখেই দেখতে পারছিস!

না, এমন নয় যে, বুলবুল ভাই কাউকে চিনতে পারছিলেন না; 'বুলবুল ভাই, তা হলে আজকে আসি' বলে ধ্রুব যখন বেরিয়ে আসছিল, বুলবুল ভাই নাকি তখন হঠাৎ সজোরে বলে উঠেছিলেন, 'এ্যা?' বলে পূর্ণ দুই চোখ মেলে তাকিয়েছিলেন তিনি। ধ্রুব বলছিল, বাসায় ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই ভাবী টেলিফোন করেছিলেন, বলেছিলেন, 'আপনি যাওয়ার সময় সেই যে তাকিয়েছিল, আপনার চলে যাওয়া দেখছিল, তখন থেকে সেই একইভাবে তাকিয়ে আছে।'

দৃশ্যটি চিন্তা করতে করতে মন বড় ভারী হয়ে গিয়েছিল। আমাদের কথাবার্তা আর বেশিক্ষণ এগোয়নি। ধ্রুব বলছিল, 'আপনার কাছে তো ভাবীর মোবাইল নাম্বারটা নাই বোধহয়। আমি মেসেজ করে দিচ্ছি।' উত্তরে আমি বলেছিলাম, 'এইরকম সময়ে কী কথা আর বলব, ধ্রুব?' 'সেটাই শামীম ভাই। ফোন করে কী বলব? অবস্থা তো জানাই! মনে হয় বড় জোর আজ আর কাল!' আমাদের কথাবার্তা আর এগোয়নি। আর এরকম কথাবার্তার পর কেন যেন কোনো কাজকর্মও এগোচ্ছিল না। তারপর দুপুরেই মৃত্যুসংবাদ এলো শেখ আব্দুল হাকিম ভাইয়ের। আর সন্ধ্যা ছয়টা বাজতে না বাজতেই খবর পেলাম, বুলবুল ভাইও চলে গেছেন। সকালে এইসব কথাবার্তা আর বিকেলেই তার চলে যাওয়া! আমার কানে বার বার বাজছিল ধ্রুবকে বলা ভাবীর কথাটা– '…সেই যে তাকিয়েছিল, আপনার চলে যাওয়া দেখছিল, তখন থেকে সেই একইভাবে তাকিয়ে আছে…'। বুলবুল ভাই, আপনি কি কিছু টের পেয়েছিলেন? বুঝতে পেরেছিলেন আর দেখা হবে না আমাদের সঙ্গে? আপনার যে দুটো আতপ্ত চোখ চিরদিনের জন্য গতকাল গেঁথে গেল ধ্রুবর পিঠে, ঝড়বৃষ্টি, ভূমিকম্প, বন্যা কিংবা মহাপ্লাবনেও কি আর সম্ভব হবে সেগুলো উপড়ে ফেলা?

দুই.
আমরা যে যৌথ জীবন, চিরবন্ধুতার রাজত্ব শুরু করেছিলাম ১৯৯২ সালের দিকে এলিফ্যান্ট রোডের ৩৬৮-তে, সেখানেই একদিন পরিচয় হয়েছিল বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে, কেবল বিভা ছড়াতে শুরু করা ধ্রুব এষ নিম্নকণ্ঠে বলেছিল আমাকে, 'এই যে শামীম ভাই, ইনি বুলবুল চৌধুরীই যে 'টুকা কাহিনী'–
শুধু 'টুকা কাহিনী'? কিন্তু একেকজন মানুষের কোনো কোনো লেখা ট্রেড মার্ক হয়ে যায়, বুলবুল চৌধুরীর 'টুকা কাহিনী' ছিল সেরকমই কিছু একটা। কী জিঘাংসা, আবার কী আত্মদহন, কী আত্মপীড়ন! কী সুন্দরভাবেই না তা দানা বেঁধে উঠেছে তাঁর এই গল্পে। কিন্তু সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিষয় ছিল, গল্পের অনেক চরিত্রের মতো বুলবুল চৌধুরীও ছিলেন অবিশ্বাস্য কোনো জগতের মানুষ। নির্লিপ্ত, কখনো আকাশের দিকে থির, কখনো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে যেন, এরকমভাবে বসে থাকতেন তিনি আমাদের মধ্যে, আমাদের মধ্যে থেকেও যেন থাকতেন অন্য কোথাও। স্মৃতিবিভ্রম এসে লয় করে দিলেও আমি ভুলতে পারব না, আমাদের ৩৬৮-তে, দরজার চৌকাঠের ওপর গুটিশুটি হয়ে বসে হাঁটুর ওপর একটা হার্ডবোর্ডের ক্লিপে কয়েকটা কাগজ এঁটে সিগারেট টানতে টানতে বলপেন দিয়ে লিখে চলেছেন তিনি। ওই বাসাটাই ছিল অমন–হঠাৎ প্রচণ্ড আড্ডায় কেঁপে উঠছে, আবার আড্ডা দেয়ার মতো সুপ্রচুর মানুষ থাকার পরও সবাই যার যার কাজে এত বেশি আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছে যে, মনে হচ্ছে জীবনের প্রথম এসএসসি পরীক্ষা দিতে এসেছে সবাই। আবার এককোণে দু'তিনজন বসে হয়তো কুট কুট করে গল্প করছে আর হাসাহাসি করছে, কিন্তু ধ্রুব এষ তার মতো ছবি এঁকে চলেছে, বুলবুল ভাই আপন মনে লিখে চলেছেন, ছড়াকার আমিরুল ইসলাম ভালোবাসার টানে রান্নাঘরে গিয়ে শওকত আলী তারার সঙ্গে গল্প করছেন আর খোলা গলায় গেয়ে চলেছেন, 'আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ…'। কিন্তু বুলবুল ভাই এসেছেন, বসেছেন, নিচু কণ্ঠে কিন্তু খুব স্পষ্ট করেই কথা বলেছেন, অদ্ভূত রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসেছেন, আমাদের সঙ্গে মিলেমিশে এত টানাটানি করেছেন, কিন্তু কখনোই বেসামাল হননি; তবে অদ্ভূত সব অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে দিয়েছেন আর হঠাৎ করেই কথাবার্তা বলা বন্ধ করে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে গেছেন।

এইভাবে বুলবুল ভাই নিঃস্তব্ধে আমাদের মধ্যে ফুটে উঠেছেন, ফুটে উঠেছেন রাতের ফুলের মতো, যার রং চোখে পড়ে না, কেবল যার সুবাস বুকের কৌটায় এসে থমকে থাকে।
একবার জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর 'নির্বাচিত গল্প' নিয়ে এসেছি এক বন্ধুর কাছ থেকে পড়ব বলে। ধীরেন শাসমলের আঁকা কী সুন্দর প্রচ্ছদ! ধ্রুব তা দেখতে দেখতে পড়তে লেগে গেল। মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে দেয়ালে পা দুটো ঠেকিয়ে সেই বই পড়তে পড়তে ওর একটু রাতই হয়ে গেল।
আর অনেক রাতে যা হতো,– পানপাত্র নিয়ে ছাদে যাওয়ার পর, ছাদেরও জলছাদে ওঠার পর হাঁটু মুড়ে একপাশে গ্লাসটা রেখে বলল, 'আপনি নন্দীর 'গিরগিটি' পড়েছেন?
পড়েছি। কেন?
ওই লোকটা–বুড়োটাকে– বলেন তো, কার মতো মনে হয়?
কার মতো? বুলবুল ভাইয়ের মতো?
একদম–ঠিক ধরেছেন– অবিকল বুলবুল ভাইয়ের মতো, আয়না, নিজেই একটা আস্ত আয়না।
বুলবুল ভাইকে আমরা চিনতে শুরু করি এইভাবে। কিংবা কখনো তাকে তুলনা করে দেখতে থাকি নন্দীরই 'সমুদ্র' গল্পের সেই মামার সঙ্গে। কিন্তু তুলনা করার মতো কত চরিত্র যে এসে জোটে, কোনো কূল পাই না।


আলোকচিত্র: ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট জন্মদিনে একত্রিত বুলবুল চৌধুরী (মাঝখানে), ইমতিয়ার শামীম (বামে) ও ধ্রুব এষ (ডানে)। ছবি তুলেছেন শওকত আলী তারা

তিন.
বুলবুল চৌধুরীর গল্পে রাষ্ট্র নেই, রাজনীতি নেই; কিন্তু গ্রামেরই হোক আর শহরেরই হোক, মানুষের যে প্রকৃতি আর মনোস্তত্ব টলোমলো করে, তাতেই বোঝা যায় এই রাষ্ট্র-রাজনীতির হালচাল কী। গ্রাম আর ঋতুউপস্থিতি তার গল্পে যত প্রবলই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষের মনোস্তত্বই সেখানে বড় কিছু। আর প্রেমের মধ্যে দিয়েও এত প্রেমহীনতা বোধহয় খুব কমই আছে কারও গল্পে। এত সরল ভাষ্যে সম্পর্কের এত জটিল টানাপড়েন তুলে আনায় শৈল্পিকতা হারানোর ঝুঁকি থাকে। কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছেন, সেই ঝুঁকি পেরুতে পারেন। আমাদের কাছে একাধিকবার বলেছেন তিনি, তার গল্প কোনো না কোনো সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। বাস্তবের সত্যের সঙ্গে গল্পের সত্যের দূরত্ব কোনখানে, সে কথায় যাব না। কিন্তু এই প্রসঙ্গে মনে করতে চাই বিশেষত তার 'বেলী' নামের গল্পটিকে। পৃথিবীর এইসব বেলীদের জন্যে কোথায় যেন একটা মায়া ছিল তাঁর। বুলবুল চৌধুরীর অধিকাংশ লেখাই শেষ পর্যন্ত এরকম মায়া দিয়ে ভরা। ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের মতো প্রখর দীপ্তি তার লেখায়। এরকম আরেকটি মনে দাগ কেটে যাওয়া গল্প 'ওই তব ভোর'। রহস্যময়ী এক সময় খেলা করে তার গল্প-উপন্যাসে; কখনো বিল-নদী-মাছে, কখনো বাঈজির মৃত চোখে সেই রহস্য দৌঁড়ে ফেরে। কিন্তু এখন কি আর সেই সব গল্প মনে করার সময়?

কবিদের মধ্যে খুব সহজে মিললেও বুলবুল চৌধুরীর মতো বোহেমিয়ান এমন কথাসাহিত্যিক দ্বিতীয়টি মেলা ভার। যখন তাঁকে কাছে পেয়েছি, তখন মাঝেমধ্যে এই চকিত ভাবনা হতচকিত করে ফেলত–আশ্চর্য, এই মানুষটি কায়েস আহমেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, আমাদের সঙ্গেও দিচ্ছেন! তারই সান্নিধ্যে তিনি লিখে ফেলেছিলেন আস্ত একটি গল্প 'জোনাকি ও সন্নিকট কেন্দ্র'। কায়েস আহমেদের সান্নিধ্যে না এলে হয়তো বুলবুল চৌধুরীর কথাসাহিত্যিকই হয়ে ওঠা হতো না কোনোদিন।

জীবনের পাত্র শূন্য থাকেনি বুলবুল চৌধুরীর। কিন্তু শেষদিনগুলোয় তার মধ্যে যেসব নতুন নতুন স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, তা স্বপ্নই থেকে গেল। দিনযাপনের যন্ত্রণাও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সারা জীবন। কখনো কখনো লেখালেখিও থেমে গেছে। কিন্তু তিনি আবারও জেগে উঠেছেন নতুন করে। এইবার তার আর জেগে ওঠা হলো না। সাহিত্য চুলায় যাক, আমরা কয়েকজন মানুষ বড় বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম। এই নিঃসঙ্গতা কেউ দূর করতে পারবে না। কেউ না।