ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ: “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা”

মোস্তফা সারওয়ার
Published : 13 July 2021, 04:46 PM
Updated : 13 July 2021, 04:46 PM

লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদেছিলেন মা-বাবা; কেঁদেছিল ছোটভাই বাবলা এবং বোনেরা – নার্গিস, মালা ও আইরিন। উনিশশো সাতষট্টি সালের জুলাই মাসের এক খরতপ্ত দুপুরে লঞ্চটি পটুয়াখালীর ঘাট ছেড়ে রওয়ানা হয়েছিল বরিশালের উদ্দেশ্যে। বরিশালে লঞ্চ পরিবর্তন করে অন্য এক বৃহত্তর লঞ্চে আমার গন্তব্য ছিল ঢাকার সদর ঘাট। আমার আজীবন পথ চলার মাঝে ছ'টি বছরের দীর্ঘ বিরতির এক সম্মোহনী সরাইখানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছিল আমার যাত্রা বিরতি।

যশোর বোর্ডে মাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান ও উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান লাভের সুবাদে মহসিন হলে আমার পছন্দ মত পেয়েছিলাম ৩৫৬ নম্বর নামের এক-শয্যা বিশিষ্ট কক্ষ। প্রধান দেউরির মুখোমুখি ছিল কক্ষটির বিস্তৃত বাতায়ন।

শুরু হোল আমার উচ্চ মানের জ্ঞানের সাধনা। পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স ছিল আমার শিক্ষার প্রধান বিষয়। সাবসিডিয়ারি গণিত ও পরিসংখ্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক অনার্সে ভর্তি ছিল সেকালে দারুণ প্রতিযোগিতামূলক। গোটা পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন চারটি বোর্ডের মেধা তালিকার আশি জনের মধ্যে ষাটেরও বেশি এসে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান অনার্সে। আমাদের ব্যাচটি ছিল ব্যতিক্রমী। মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকারীদের কেউ উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করতে পারেনি। এদের মধ্যে তিন জন মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকারী শহিদুল্লাহ খান (ঢাকা বোর্ড), মনোয়ার হোসেন (যশোর বোর্ড), আহমেদ ফজল সিদ্দিকী (কুমিল্লা বোর্ড) এসে জুটল আমাদের ক্লাসে। উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকারী আমি মোস্তফা সারওয়ার (যশোর বোর্ড), খন্দকার রেজাউল করিম (রাজশাহী বোর্ড) এবং আব্দুল মতিন ((ঢাকা বোর্ডের দ্বিতীয় স্থান অধিকারী) হলাম একই ক্লাসে সহপাঠী।

শিক্ষক হিসেবে পেলাম বিশ্বমানের প্রথিতযশা পদার্থ বিজ্ঞানী ইন্নাস আলী, মতিন চৌধুরী, বেলায়েত হোসেন, সুলতান আহমেদ, হারুনর রশীদ, মুহাম্মদ রফিকুল্লাহ, হীরনময় সেন গুপ্ত, কাইয়ুম সরকার, মোহতাশেম হোসেন, সামসুল ইসলাম, কামরুন নাহার, অজয় রায়, মাজহারুল ইসলাম, ললিত মোহন নাথ, শমশের আলী, ওয়াজেদ মিয়া, এ কে এম সিদ্দিক, এবং দিলারা বেগমকে। মেনটর হিসেবে পেয়েছিলাম অধ্যাপক মোহাম্মদ ইমরানকে। আমাদের সৌভাগ্য গণিতের অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছিলাম এ. এন. এম শহীদুল্লাহ, সিরাজুল হক মিয়া, এবং আবদুর রহমান স্যারকে। পরিসংখ্যানের অধ্যাপক মাহবুবুদ্দিন, আসকার ইবনে সাইয়েক, গোলাম মোস্তফা এবং এ এন এম মনিরুজ্জামান ছিলেন শিক্ষক হিসেবে তুলনা বিহীন।

আমাদের পথিকৃৎ ছিলেম পদার্থ বিজ্ঞানের অন্যতম জ্যোতিষ্ক এক কালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো দ্বারা তৈরি, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশের নামকরণ করা হয়েছে "বোজন"—সত্যেন বোসের নামে। বোস-আইনস্টাইন থিওরি ও কনডেনসেটের উপর গবেষণাকারীদের গত কয়েক বছরে দুবার নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ব্রম্মান্ড সৃষ্টির আদি-কণা "ঈশ্বর কণা" র নাম হোল হিগস-বোজন। সত্যেন্দ্রনাথ বোস শুধু বিজ্ঞানী হিসেবেই বরেণ্য নন, কবি ও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও সমাদৃত।

আমাদের পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও আমরা জড়িয়ে পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আমাদের অবসরে বিহার ছিল সঙ্গীত, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি এবং সমসাময়িক বিষয়ে। পুঁজিবাদী দৈত্যের এক বিশাল যন্ত্রের হৃদয়হীন স্ক্রু অথবা নাট না বানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পরিবেশ ছিল হৃদয়বৃত্তির মাধুরী মিশিয়ে জীবিকার দক্ষ কারিগর এবং সমাজ ও প্রকৃতির হিতৈষী হিসেবে ছাত্রদের গড়ে তোলা।

হৃষ্টচিত্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রারম্ভেই আমি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম জ্ঞানের সাধনা ও তার বস্তুগত প্রকাশে। সম্ভাবনার সিংহদ্বার খুলেছে মহান বিদ্যাপীঠ। আমি তার সব সম্ভার লুফে নেব। যেমন চিন্তা তেমন কাজ।

মহসিন হলে আবাসন শুরু হওয়ার পাঁচদিন পর ১৯৬৭ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত আন্তঃ হল বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। মহসিন হলের উদ্বোধনী উৎসবে সভাপতির ভাষণে প্রভোস্ট অধ্যাপক ইন্নাস আলী আমার অর্জনটিকে গুরুত্ব দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন। ঐ একই অনুষ্ঠানে হাজী মহসিনের উপর আমার লেখা গানটি সুর দিয়ে এবং গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন তখনকার নামজাদা গায়ক ফররুখ আহমেদ ও গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন। ঐ গানটি মহসিন হলের প্রথম প্রকাশিত ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। শুনেছি, এখন ও ঐ গানটি মহসিন হলের অনুষ্ঠানে গাওয়া হচ্ছে মহসিন হল সঙ্গীত নামে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং জ্ঞান চর্চার সকল দিক ছিল উন্মুক্ত। ক্লাসের পড়ার বাইরে আমি ঐ সুযোগগুলোর সৎব্যবহার করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাত্র এক বছরের কম সময়ে মহসিন হলে আয়োজিত সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিন সদস্য বিশিষ্ট মহসিন হল টেলিভিশন কুইজ টিমে যুক্ত হয়েছিলাম। একটানা কয়েক মাস ধরে ঢাকা টেলিভিশনে সপ্তাহে একদিন প্রাইম টাইমে অনুষ্ঠিত হত নিখিল পাকিস্তান টেলিভিশন কুইজ প্রতিযোগিতা। মহসিন হল টিমের সদস্য হয়ে অংশগ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তান রানার আপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সৌভাগ্য হল। ঢাকা টেলিভিশনে আমি বিজ্ঞান শিক্ষার আসরও উপস্থাপনা করেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে পরিচয় হয়েছিল অনেক ছাত্রছাত্রীদের সাথে। মহসিন হলে, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে, কার্জন হলে, এবং কলা ভবনে। অনেকের সাথে বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হয়েছে। কারও কারও সাথে শুধু পরিচয় ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা" এর মত স্থান কালের অমোঘ পরিবর্তনের বহমান নির্ঝরে অনেকে হারিয়ে গেছে। পরিচয় অথবা বন্ধুত্ব হয়েছিল এবং এখনও যোগাযোগ রয়েছে পদার্থ বিজ্ঞানের সালেহ, মনোয়ার, মাহফুজুর রহমান, শফিক, শফিক-উদ-দওলা, রাব্বানী, বাসারাত, মিনু, খুকু, শামিমা, বাবলী, লুসি, জলি, রেজিনা, ফ্লোরা, ফজলে সোবহান, স্বপন গায়েন, রকিব, হারুনুজ্জামান, ইকবাল, কামাল, লতিফ, মাসুদ, এবং মঈন খান। কর্মজীবনে এরা সকলেই রেখেছে প্রশংসনীয় অবদান – বিশ্ব মানের। এদের অনেকেই আমার মত যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হয়েছেন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সহ আইভি লীগের নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড, এবং কেম্ব্রিজে উচ্চ শিক্ষিত। কেহ কেহ বিশ্ব-মানের উদ্যোক্তা। হারুনুজ্জামানের মেয়ে হল অস্কার বিজয়ী – নিদারুণ কম বয়সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিঞ্জান বিভাগে আমরা পেয়েছিলাম মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ শিক্ষা। তারই প্রতিধ্বনি আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জীবনে মেলেছে মুক্ত বিহঙ্গের অনিরুদ্ধ পাখা। আমার ব্যথিত পৃথিবী থেকে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে নীলা, নাদিরা, শহীদুল্লা, শফিক জুনিয়র, টিপু, দিলরুবা, রেজাউল, দিদার, জাহাঙ্গীর, এবং আরও অনেকে। অকালে প্রাণ হারিয়ে অসীম শূন্যে নির্বাসনে রয়েছে তারেক, ইফতি, সাইফুল, মহিউদ্দিন, মতিন, সলিমুল্লাহ, রিজওয়ানুল সহ আরও অনেকে। পদার্থ বিজ্ঞানে আমাদের সহপাঠী যশোর বোর্ডের মাধ্যমিকে হিউম্যানিটিস বিভাগের প্রথম স্থান অধিকারী নূর মহম্মদ উন্মাদ হয়ে এখনও ভিক্ষা করছে কি না আমার জানা নেই। আজ প্রাণ ভরে বেদনার্ত হৃদয়ে শুনবো 'মান্না দে' র অবিস্মরণীয় গান "কফি হাউসের সেই আড্ডাটা …"

মহসিন হল ছিল বিচিত্রতার এক স্বপ্ন পূরী। কলাভবনের কাছে এবং কার্জন হল থেকে অনেক দূরে থাকার কারণে এখানে স্বভাবতঃ বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্রদের বাস করার কথা ছিল না। কিন্তু প্রভোস্ট ইন্নাস আলী এবং সিনিয়র হাউস টিউটর মুহম্মদ ইমরানের দূরদৃষ্টিমূলক পলিসির জন্য বিঞ্জানের অনেক মেধাবী ছাত্ররা মহসিন হলকে বেঁছে নিয়েছিল। যাদের অনেককেই এক-শয্যা বিশিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল। যারা নিজেদের বাসায় থাকতো তাদের অনেকেই যুক্ত ছিল মহসিন হলে। তাই মহসিন হল ছিল সকল বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রদের মিলন মেলা। দালানটির ছোটো উইং এ আমার প্রতিবেশী ছিল কলা অনুষদের সোহেল ও হক ভাই, বাণিজ্যের জাফর ও মান্নান (পরে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রান্টস কমিশনের চেয়ার), এবং পদার্থ বিঞ্জানের আদম শফিউল্লাহ ভাই ও সাজ্জাদ ভাই (পরে আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ার ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা)। ঐ হলে অন্তরঙ্গতা হয়েছিল অনেকের সাথে যারা স্বাধীন বাংলাদেশে নামজাদা অধ্যাপক, বিপ্লবী নেতা, জাঁদরেল সাংবাদিক, বিখ্যাত লেখক ও কবি, মন্ত্রী, বিচারপতি, সচিব, রাষ্ট্রদূত, উপাচার্য, সামরিক জেনারেল, এবং কর্পোরেশনের চেয়ারের পদ অলংকৃত করেছে। বন্ধু কবি নুরুল হুদা, লেখক হুমায়ুন, সাংবাদিক মুহম্মদ জাহাঙ্গীর থাকতো আমাদের হলে। নির্মলেন্দু গুন থাকতো আকতারুন্নবীর অতিথি হিসেবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আজন্ম বিপ্লবী, মহসিন হলে ছিল তার আনাগোনা। এক সময় চিনতাম। এরা চির ভাস্বর। আবার কেহ কেহ হারিয়ে গেছে মহাকালের নিষ্ঠুর গহ্বরে। এখনও আমার সাথে যোগাযোগ রয়েছে অর্থনীতির মতি (বিশিষ্ট বন্ধু এবং আমেরিকায় অধ্যাপক), আবদুল্লাহ শিবলী এবং মোস্তাক (উভয়ে কিংবদন্তীর মেধাবী ছাত্র), মহিউদ্দিন বুলবুল (নামজাদা লেখক), হুমায়ুন (পরে জাতিসংঘে পরিচালক), কিংবদন্তীর বিতর্কবাগীশ মাহফুজ আনাম (বর্তমানে তার পত্রিকায় লিখছি মাঝে মাঝে), রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আহরার (রেনেসান্স ম্যান), এবং বাণিজ্যের মান্নান ও মান্নান চৌধুরী (বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ)। বিস্মৃতির অন্তরালে আমার পৃথিবী হতে হারিয়ে গেছে বাণিজ্যের জাফর (উচ্চ মাধ্যমিকে কুমিল্লা বোর্ডে বাণিজ্যে প্রথম) ও এম এ কামাল (উচ্চ মাধ্যমিকে কুমিল্লা বোর্ডে বাণিজ্যে তৃতীয়), অর্থনীতির সোহেল (উচ্চ মাধ্যমিকে কুমিল্লা বোর্ডে বিজ্ঞানে প্রথম), এবং অনুজ অর্থনীতির আতিউর (গভর্নর) ও মাসুদ (বিপ্লবী)। কতবার এসেছে আমার কক্ষে হিসেব রাখিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি বুকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রার্থিত নির্বাসনে উপাচার্য, উপ উপাচার্য, ডীন, অধ্যাপক হয়েছি; হয়েছি ইউরোপে এ্যাকাডেমিক ডিরেক্টর; সম্পাদনা করেছি বিশ্ব বিখ্যাত এ্যাকাডেমিক জার্নাল; পরিচালনা করেছি আন্তর্জাতিক চেয়ার হিসেবে আমার বিষয় ভূপদার্থ বিজ্ঞানের অন্যতম প্রফেশনাল সমিতি। এমনকি এই ভিন দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় আমৃত্যু নিয়োগ পেয়েছি রিজিওনাল ট্রানজিট অথরিটির কমিশনার হিসেবে। তবুও হৃদয়ে এক শূন্যতা থেকে যায়। মনে হয় নিভৃতে উচ্চারণ করি আমার রচিত কবিতা:

প্রবাসের আনন্দ, বিলাস, আর কর্মদীপ্ত দিনগুলো

নিমেষে একাকার হয়ে যায় …

শুধু ফুটে ওঠে এক মাতাল সঙ্গীত …

জেগে ওঠে এক অতি পৃথিবী

যেখানে বাংলা নামের মেয়েটির চোখে

অভিমানের মেঘ জমে থাকে,

ঠোঁটে থাকে সহস্র বেদনার অমৃত রজ্ঞন

(কবিতার শিরোনাম এবং বই এর নাম: প্রার্থিত নির্বাসনের উন্মাদ পদাবলী। লেখক: মোস্তফা সারওয়ার)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই আল মুজাহেদী প্রায়ই আমাকে নিয়ে যেতেন বায়তুল মোকাররম মার্কেটের দোতলায় একটি কক্ষে কবি জসীম উদ্দিন প্রতিষ্ঠিত সাধনা সঙ্গের সাহিত্য আসরে। আলী ইমামের কঠোর সমালোচনা আমার কবিতা লেখার খাদগুলো অপসারণে সহায়তা করেছিল। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিতর্ক সমিতির সভাপতি হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। হাসানুজ্জামান, ফজলে সোবহান, ফ্লোরা, বাবলি, মুত্তালিব, রকিব এদের সহায়তায় নিয়মিত বিতর্ক সভা হত।

তৎকালীন ডিআইটি ভবনে অবস্থিত ছিল ঢাকা টেলিভিশনের অফিস ও স্টুডিও। এটাই ছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র টেলিভিশন স্টেশন। ওখানে আমি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়েছিলাম। খালিদা ফাহমী ও মোস্তফা মনোয়ারের মত গুণীজনদের প্রযোজক হিসেবে পেয়েছিলাম। একটি গীতিনাট্যের গান ও ধারা বর্ণনা আমি রচনা করেছিলাম। সহপাঠী অর্থনীতি বিভাগের হাফিজুল কবির (অবসরপ্রাপ্ত বোর্ড অব রেভিনিউর কর্মকর্তা) গানগুলোর সুর সংযোগ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবনে তখন নতুন ইন্টার-কম স্থাপন করা হয়েছিল। মধ্যাহ্নভোজনে মাঝে মাঝে যেতাম টিএসিসিতে। কখনও কখনও শুনতাম স্পীকারে বাজছে আমার লেখা গানগুলো। বেবি জামান স্যারের সাথে জমে উঠেছিল হৃদ্যতা। ওই সময় আমার লেখা কবিতা ছাপা হত দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক সংবাদ, ইত্যাদি পত্রিকার সাহিত্য পাতায় এবং কতিপয় লিটল ম্যাগাজিনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে ছিল বিশাল বিশাল জারুল, কৃষ্ণচূড়া, অশ্বত্থ গাছের সমারোহ। ফুলার রোড, নীলক্ষেত, রেসকোর্স হতে কার্জন হল এবং হাই কোর্ট পর্যন্ত পথে, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখানের রাস্তার পাশে ছিল দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষরাজি। রাস্তাগুলো থাকত ছায়ায় ঘেরা। এমনি মোহনীয় পরিবেশ বান্ধব পারিপার্শ্বিকতার মাঝখানে কলাভবন ও প্রশাসনিক ভবনের মধ্যবর্তী চত্বরে ভোর বেলায় প্রাতঃভ্রমণে আসতেন অর্থনীতির রেহমান সোবহান, গণিতের হাফিজুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, এবং আরও অনেক অধ্যাপকরা। আমরা কতিপয় ছাত্ররাও হাটতে যেতাম।

বিভিন্ন সেমিনারে সুযোগ হত ঞ্জানের বিবিধ পৃথিবীর জোতিষ্কদের বক্তৃতা শোনার। এত বছর পরও ভুলিনি ইংরেজির সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও রাজিয়া খান আমিন, বাংলার আহমেদ শরীফ, বাংলা ও ইংরেজির মুনির চৌধুরী, দর্শনের জি সি দেব, অর্থনীতির আনিসুর রহমান ও রেহমান সোবহান, পদার্থ বিজ্ঞানের হারুনর রশীদ ও অজয় রায়, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আবদুর রাজ্জাক, এবং আরও অনেকের অমৃত বাণীর কিছুটা অংশ।

জ্ঞানচর্চা ও মানবিক বিকাশের এমনি এক প্রগাঢ় শান্তিময় পরিবেশ বিঘ্নিত হতে শুরু হল ১৯৬৮ সালের শুরুতেই। রাজনীতির ঈশান কোনে জমতে শুরু করেছিল ঝঞ্ঝা ও দুর্যোগের কালো মেঘ। ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হল। ১৮ই জানুয়ারি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙ্গালী শেখ মুজিবকে দু বছর সাত মাস চৌদ্দ দিন বিনা বিচারে কারাভোগের পর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এক প্রহসন নাটকের নিষ্ঠুর প্রহেলিকায়। মুক্তির পর মুহূর্তেই জেল গেট থেকে তাঁকে বন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হল ঢাকা সেনানিবাসের বন্দীশালায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বভাবত:ই ছিল রাজনীতি-সচেতন। আইয়ুবশাহীর অন্যায় স্পর্ধায় গর্জে উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ গোটা দেশ। এর মাঝেই ছদ্মবেশী সামরিক একনায়কতন্ত্র আইয়ুবশাহীর তল্পিবাহক দালাল ছাত্র সংগঠন এন.এস.এফ এর গুণ্ডারা ছাত্র নেতা ও কর্মী সহ সাধারণ ছাত্রদের হেনস্থা করছিল বিভিন্ন আবাসিক হলে। খোকা নামে এক গুণ্ডা ফজলুল হক আবাসিক হলে সাপ পুষত ছাত্রদের মনে ত্রাস সঞ্চারের নিমিত্ত।


১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসটি ছিল এক ক্রান্তিকাল। আমি নিদারুণ ব্যস্ত। অক্টোবরের শেষ দিকে মহসিন হল টেলিভিশন কুইজ টিমটিকে (আমি সদস্য) যেতে হবে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে, পূর্ব পাকিস্তান রানার আপ পুরষ্কার গ্রহণ করতে। এ মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আর এ মাসেই অর্থনীতি বিভাগের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের কাছে শরীফ ক্যান্টিনে এনএসএফের গুণ্ডা বাহিনী মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের রিজওয়ান ও নুরুল আমিন সহ কয়েকজন মেধাবী ছাত্রদেরকে মারধর করেছিল। ছাত্র ইউনিয়ন ঐ ঘটনার উত্তর দিয়েছিল সলিমুল্লাহ হলের বাৎসরিক সান্ধ্য ভোজনের দিন। মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক বাহিনী সান্ধ্য ভোজন শেষে দ্বিতলের কয়েকটি কক্ষে মদ্যপান রত এনএসএফ গুণ্ডাদের আক্রমণ করেছিল। ছুরিকাঘাতে দারুণ আহত অবস্থায় গুণ্ডাদের পালের গোদা পাচপাত্তুকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সে মৃত্যুবরণ করে। এনএসএফের গুণ্ডারা ক্ষিপ্ত হয়ে মহসিন হল সহ বিভিন্ন হলের সাধারণ ছাত্রদের মারধোর করে এবং তাদের কক্ষ লুট করে। আমার দুর্ভাগ্য, ঐ দিন আমার দরজা ভেঙ্গে আমার কক্ষটি লুট করেছিল। ১৬ই অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা এবং আবাসিক হলগুলো পরিত্যাগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। আমি ফিরে গিয়েছিলাম পটুয়াখালীতে। তারপর প্রভোস্টের টেলিগ্রাম পেয়ে ঢাকায় ফিরে জীবনে প্রথম বার বিমানের যাত্রী হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে গিয়েছিলাম। পরে ইসলামাবাদের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করি।

১৯৬৯ সালের প্রথম তিন মাস পূর্ব বাংলা রূপান্তরিত হয়েছিল গন অভ্যুত্থানের এক বহ্নি শিখায়। আর এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ৪ঠা জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এগারো দফা দাবী গ্রহণ করে। এর মুলে ছিল শেখ মুজিবের ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, যা প্রায় স্বাধীনতার সমতুল্য। আরও দাবী ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নাকচ সহ সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি। বিশ এ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শাহাদাত বরন করেন। গন আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। আমি ও আমার সহপাঠী সালেহ আহমেদ প্রায় প্রতিটি আন্দোলন, জনসভা, ও মিছিলে যোগদান করতাম। ১৫ই ফেব্রুয়ারি সেনানিবাসে বন্দী অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। ঐদিন রাতে গন আন্দোলন গন বিপ্লবে পরিণত হয়।

পরদিন ষোলোই ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের জানাজার পর মাওলানা ভাসানী, আমেনা বেগম, ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলন পরিণত হল গন অভ্যুত্থানে। পল্টনে ভাসানীর জ্বালাময়ী ভাষণের পর গুলিস্তানে দেখা হল মহসিন-হল ছাত্র সংসদের তৎকালীন সহ সভাপতি কামাল ভাই (পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) এর সাথে। তিনি পরিস্থিতি বিষয়ে আমাদের সাবধান করে দিলেন। ততক্ষণে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে। আমি ও সোহেল যখন কার্জন হল চত্বরে, তখন গুলির শব্দ আসছিল সেক্রেটারিয়েট ভবন সন্নিহিত মন্ত্রীদের বাড়ীগুলো হতে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারক বিচারপতি এস এ রহমান এবং সরকারি সহ-প্রধান কৌঁসুলি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনজুর কাদের থাকতেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। ক্ষুব্ধ জনতা ঐ ভবন আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিচারক এবং সরকারি কৌঁসুলি পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। বর্ধমান হাউস (বর্তমানের বাংলা একাডেমী) ভবনের একটু দূরে বিপ্লবী জনগণ অস্ত্রসহ দখল করেছিল একটি আধা-সামরিক ট্রাক। পাক সৈন্যরা রেস কোর্সে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। আমি ও আমার বন্ধু সোহেল যখন শামসুন্নাহার হলের কাছে তখন চারিদিকে বারুদের গন্ধ। ঐ দিন ঢাকায় মন্ত্রীদের এবং মুসলিম লীগ নেতাদের বাসস্থানে অগ্নি সংযোগ করা হয়।

আমি, সালেহ ও জাফর কারফিউ ও দেখা মাত্র গুলির আদেশ তোয়াক্কা না করে তৎকালীন জিন্নাহ হলের আফম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে বর্তমানের খ্যাতনামা লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বুলবুল সহ আরও অনেক ছাত্রদের সাথে মিছিল করেছিলাম। ঐ দিন রাতে খসরু, মন্টু, ও সেলিমের নেতৃত্বে ঢাকায় বন্দুকের দোকানগুলি লুট হয়েছিল। সমস্ত রাতভর মহসিন হলের সন্নিহিত নীলক্ষেতের ভবনগুলো থেকে ক্ষুব্ধ মা-বোনেরা সাড়ি ও কাপড় পুড়িয়ে এবং স্লোগান দিয়ে আইয়ূবশাহীর অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আমাদের করিডোরে দাড়িয়ে চিৎকার করে মহসিন হলের ছাত্ররা স্লোগানে যোগ দিয়েছিলাম। সন্নিহিত হাতির পুল ও নীলক্ষেতে চলছিল চোরাগোপ্তা লড়াই। আমরা স্বচক্ষে দেখলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান যোদ্ধা খসরু মহসিন হল ভবনের পাইপ বেয়ে উঠেছিলেন। বারুদ আর পোড়া টায়ার এবং কাপড়ের গন্ধ ও ক্ষণে ক্ষণে গুলির শব্দে পুরো এলাকা এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।

আঠারোই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামসুজ্জোহাকে বেয়োনেট চালিয়ে হত্যা করা হয়। প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ গোটা দেশ গর্জে উঠলো। এর চার দিন পর শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিব বলাকা ভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিস পরিদর্শনে এসেছিলেন। আবদুর রাজ্জাক ভাই আমাকে বঙ্গবন্ধুর কোলে তুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের দলের বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্র। ঐ মহা মানবের স্নেহের আলিঙ্গন জীবনে কোনদিন ভুলবার নয়। ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে শুনেছি, আমিই সর্ব প্রথম বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকার প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। আমি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র, তখন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরাজুল আলম খান, ফেরদৌস কোরেশী, ও আবদুর রাজ্জাক আমাকে চিনতেন। ১৯৬৫ সালের ১১ই মের প্রলয়ঙ্করী ঝরের পর বাবার সাথে রাগ করে ঘর পালাই। আমি জল বসন্ত নিয়ে নিদারুণ অসুস্থ অবস্থায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী আমার মেধা তালিকায় থাকার কথা। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আব্বা বলতেন আমার ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার কথা তাই পাব। অসুস্থতা তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু আব্বার ঐ কথা গুল আমার কাছে ছিল নিদারুণ অপমান জনক। মনে হয়েছিল অসুস্থ না হলে মেধা তালিকায় আমার স্থান সম্পর্কে আব্বার সন্দেহ রয়েছে। তাই আমি নিরুদ্দিষ্ট হতে গোপনে লঞ্চ ঘাটে এলাম। সেখানে দেখা হল কাজী আরিফ, আমির হোসেন আমু, সুধীর কুমার হাজরা, শহীদুল হক মুন্সী, ও আবদুল্লা হাসনাতের সাথে। আমু ভাই আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। আমি লক্ষ্যচ্যুত। ভিড়ে গেলাম মানিক মিয়াঁ বরিশাল বাত্যা বিধ্বস্ত রিলিফ কমিটির ঐ সকল নেতাদের সাথে খেপুপাড়ার উদ্দেশ্যে। সেখানে কর্ণফুলী জাহাজে দেখা হল বর্তমানের স্পীকার শিরীন চৌধুরীর পিতা রিলিফের প্রধান কর্মকর্তা সিএসপি রফিকুল্লা চৌধুরীর সাথে। রিলিফ কাজ শেষ করে চলে গেলাম ঢাকায়। আশ্রয় মিলল কাজী আরিফের বাসায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা বুঝে গেছেন, আমি বাউন্ডেলে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে করাচীর রেডিও পাকিস্তানের জাতীয় খবরে একদিন দুপুরে, সন্ধ্যায়, ও রাতের খবরে আমার দ্বিতীয় স্থান লাভের খবর বেরিয়ে ছিল। ছাত্রলীগ মহলে হইচই পড়ল বাউন্ডেলে ছেলের কাজ কারবারে। সেই সুবাদেই ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগতদের জন্য ছাত্রলীগ আয়োজিত ইকবাল হল (বর্তমানের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এ অনুষ্ঠিত সভায় আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম নবাগতদের পক্ষ হতে। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের নবাগত সম্বর্ধনায়ও আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম নবাগতদের পক্ষ হতে।

ছাত্রলীগের সাথে সম্পর্ক এবং মুজিবের টানে ১৯৬৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি হাজির হলাম রেস কোর্সে মুজিবের সম্বর্ধনায়। মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা সেরাজুল আলম খানের বাছাই করা বঙ্গবন্ধু উপাধিতে জাতীর জনক মুজিবকে ভূষিত করলেন তৎকালীন পূর্ববাংলার মুকুটহীন শাসক (মুজিবের অবর্তমানে) মহান ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ। রাজনৈতিকভাবে পর্যদুস্ত এবং হার্ট এ্যাটাকে হুইল চেয়ারে থিতু পাকিস্তানের এক দশকের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ২৫শে মার্চ আরেক সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। এক দশকের অমারাত্রির প্রহসনমূলক পট পরিবর্তন হল। এ সব কিছুর কেন্দ্রে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমি নিজে সাক্ষী হয়ে রইলাম বাংলার ইতিহাসের এক বিপ্লবী স্বর্ণ যুগে।

১৯৭০ সালের প্রথমার্ধে নবাগত গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষোলো জন ছাত্রকে গভর্নরের প্রাসাদ (বর্তমানের বঙ্গভবন) এ নিমন্ত্রণ করেছিলেন সান্ধ্য ভোজনে। মহসিন হলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম আমি – মোস্তফা সারওয়ার এবং কামালুদ্দিন আহমেদ (সাবেক রাষ্ট্রদূত)। মাহবুব ভাই (তখন গভর্নরের এডিসি এবং বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে ঢাকার জাঁদরেল এসপি) আমাদের স্বাগতম জানিয়েছিলেন প্রাসাদের প্রবেশ দ্বারে। আমাদের মধ্যে একজন ইসলামী ছাত্রসঙ্গের সদস্য ছাড়া সকলেই মিলিত কণ্ঠে ছাত্র আন্দোলন এবং এগারো দফা দাবীর সপক্ষে আমাদের শর্তহীন সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিলাম। আমার এক বছর সিনিয়র অর্থনীতি বিভাগের সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বিরতিহীন ধূমপান করছিলেন। এক পর্যায়ে গভর্নর আহসান লাইটার দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন।

১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন, ৭ই ডিসেম্বরের জাতীয় এবং ১৭ই ডিসেম্বরের প্রাদেশিক নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর নিরঙ্কুশ বিজয়, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার বেঈমানি, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ – এ সবই ঘটেছিল আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে। ১৯৭১ সালের ৩১শে জানুয়ারি যাচ্ছিলাম লঞ্চে পটুয়াখালী। পরের দিন কোরবানির ঈদ। প্রথম শ্রেণীর দোতলার কেবিনগুলোতে ছিলেন এয়ার মার্শাল নূর খান। আমি ছিলাম তৃতীয় শ্রেণীর ডেকে। আমার সাথে সহযাত্রী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র। আমার এক বছর সিনিয়র হুদা ভাই (বর্তমানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার)ও সহযাত্রী ছিলেন । আমি নূর খানের সাথে দেখা করার চেষ্টা করে প্রথম ব্যর্থ হলাম। দ্বিতীয় বার আমি কাগজে আমার পরীক্ষার কৃতিত্ব সহ পরিচয় লিখে দিয়েছিলাম তাঁর সেক্রেটারিকে। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডাকলেন। দারুণ অমায়িক। অনুযোগ করলাম, লাখ লাখ মানুষ মারা গেল ১২ই নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাসে। তখন আপনাদের করো টিকিটি দেখা গেল না। লঞ্চটি বগা বন্দরে লঙ্গর করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে মুক্তির স্লোগানে লঞ্চটি কেঁপে উঠল। ঘাটের লোকরাও আমাদের সাথে যোগদান করেছিল। পরদিন ঈদের বড় ময়দানে আমাকে খোঁজ করছিলেন নূর খান। আমি ছিলাম অন্য ময়দানে। আমার ছোটবেলার বন্ধু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী নিজামুল হক নাসিম (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং সাবেক যুদ্ধ অপরাধ বিচার কমিশনের চেয়ারম্যান) ওখানে ছিল নূর খানের কাছে। নাসিম বলেছে, নূর খান আমার প্রশংসা করেছিলেন। ভদ্রলোক ভাল মানুষ। তিনি গণহত্যার বিরোধিতা করেছেন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দিন পোডিয়ামের কাছাকাছি ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সেই অগ্নিগর্ভ বানী তুলনা বিহীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হলে ঐ সৌভাগ্য হত কিনা সন্দেহ রয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের পটুয়াখালী শহরের বাসা দুই বার সামরিক বাহিনী ঘেরাও করেছিল। দ্বিতীয় বার আমার ছোটো ভাই ষোলো বছর বয়সের যুবক বাবলাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৬ই ডিসেম্বর ওকে মুক্ত করে আনার সময় নির্যাতনে এতটাই অসুস্থ ছিল যে, ওকে পরে ঢাকার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল। নয় নম্বর সেক্টরের পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে দৈনিক গনবাংলার প্রথম পাতায় ছাপিয়ে ছিলাম আটারও সংখ্যায় "অপারেশন সেক্টর নম্বর নয়"। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েশন পিছিয়ে গেল। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে এমএসসি সমাপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক পদে যোগদান করেছিলাম এবং কয়েক মাস পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের তরুনতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম।

পথের ক্লান্তি ভুলে অল্প সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালের জুলাই এর এক অশ্রুঝরা দুপুরে। সে যাত্রার অশ্রুসিক্ত কুয়াশার আভরণে এখনও আমি নিরুদ্দিষ্ট এবং নির্বাসিত।